একটি রাস্তা নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম ওয়াসার মধ্যে বিরোধের জের ধরে অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প ঝুলে যাচ্ছে। ফলে অনিশ্চিয়তার মুখে পড়ছে চট্টগ্রাম মহানগরীর সবচেয়ে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ স্যুয়ারেজ প্রকল্প। সিডিএকে ফিডার রোডের জন্য রাস্তার জায়গা দিচ্ছে না চট্টগ্রাম ওয়াসা, অপরদিকে সিডিএ ওয়াসাকে প্রয়োজনীয় এনওসি (অনাপত্তি সনদ) প্রদান করছে না। ফলে দুই সরকারি সংস্থার দুইটি প্রকল্পই ঝুলে যাচ্ছে। সিডিএর এনওসি পাওয়া না গেলে ওয়াসা পরিবেশ ছাড়পত্র ও বিদেশী সংস্থার ঋণ পাবে না বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, চট্টগ্রাম মহানগরীতে স্যুয়ারেজ সিস্টেম গড়ে তোলার জন্য নগরীর হালিশহর এলাকায় ১৯৬৩ সালে ১৬৩ একর ভূমি হুকুমদখল করেছিল ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দীর্ঘদিন পরেও প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় জায়গাটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। হালিশহরের সাগর উপকূলের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে থাকা ১৬৩ একর জায়গা একসময় জনমানবশূন্য অবস্থায় থাকলেও ক্রমে তার উপর দিয়ে মানুষের হাঁটাচলার একটি রাস্তা তৈরি হয়। আরএস খতিয়ানে কোনো রাস্তা না থাকলেও বিএস খতিয়ানে রাস্তা দেখানো হয়। প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে শত শত মানুষ ও গাড়ি চলাচল করে। পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত রিং রোড নির্মাণের পর রাস্তাটির ব্যস্ততা বেড়া যায়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান রাস্তাটিকে রিং রোডের ফিডার রোডে উন্নীত করার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এতে রাস্তাটিকে ৬০ ফুট প্রস্থ করে চার লেনের মহাসড়কে উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাস্তাটি বড়পুল থেকে রিং রোডে যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে সিডিএ। যা ভবিষ্যতে বে টার্মিনালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠবে। রাস্তাটি বড়পুল থেকে প্রথম এক কিলোমিটার ৯০ ফুট এবং পরবর্তী দুই কিলোমিটার ৬০ ফুট করে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। তবে রাস্তাটির জন্য একশ’ ফুট ভূমি সিডিএর নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে। যেখানে কোনো ধরনের স্থাপনা করতে কাউকে অনুমোদন দেওয়া হবে না। সিডিএ এই প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হলেও চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ রাস্তার জন্য কোনরূপ জায়গা দেয়া সম্ভব নয় বলে জানায়। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তাদের ১৬৩ একর জায়গার একেবারে উত্তর পাশে প্রায় ২৫ ফুট চওড়া একটি রাস্তা রাখছে যা দিয়ে স্থানীয়দের গাড়ি চলাচলসহ প্রয়োজন সারবে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলেছে, উত্তর দক্ষিণে লম্বা ১৬৩ একর জায়গার মাঝ দিয়ে কোনো ভাবেই রাস্তা করতে দেয়ার সুযোগ নেই। প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন চট্টগ্রাম মহানগরীর স্যুয়ারেজ প্রকল্পের তিনটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি হবে জায়গাটিতে। এত বড় জায়গা আর কোথাও পাওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া যেখানে সেখানে স্যুয়ারেজ প্রকল্পের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করার সুযোগ নেই। তিনটি প্ল্যান্টই করার ব্যাপারে লে আউট তৈরি করেছে মালয়েশিয়ান বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পটি একনেকেও অনুমোদন হয়। প্রকল্পটি কেপিআই। এই ধরনের কেপিআইর মাঝদিয়ে একটি রাস্তা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, বিষয়টি সরকারি সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে। চট্টগ্রাম মহানগরীর স্যুয়ারেজ প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে হলে ১৬৩ একর জায়গার মাঝ দিয়ে রাস্তা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর যদি প্রকল্প বাতিল করে দেয়া হয় তাহলে জায়গাটিতে যা ইচ্ছে করা যাবে। তিনি বলেন, আমরা ওই এলাকায় তিনটি প্ল্যান্ট করব। বর্তমানে একটি প্ল্যান্ট তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীকে ছয়ভাগে বিভক্ত করে শুধুমাত্র একভাগের বর্জ্য এই প্ল্যান্টের মাধ্যমে সাগরে ফেলে দেয়া হবে। শহরের বাকি পাঁচ ভাগের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আরো দুটি প্ল্যান্ট নির্মাণ করতে হবে। সর্বমোট তিনটি প্ল্যান্ট তৈরি করতে আমাদের আরো জায়গা লাগবে। ইতোমধ্যে আমরা আরো কিছু জায়গা হুকুমদখলের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের নিকট প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এখন বাকিটা সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে বলে মন্তব্য করেন ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম। তিনি সিডিএর রাস্তার জন্য বিকল্প আছে উল্লেখ করে বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর স্যুয়ারেজের জন্য অন্য কোনো বিকল্প নেই। এই প্রকল্পটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তালিকাভুক্ত একটি প্রকল্প।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস বলেছেন, আউটার রিং রোডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে ফিডার রোড-২। এই ফিডার রোড দিয়েই বে টার্মিনালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত হবে। বঙ্গবন্ধু টানেলের সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রেও এই রাস্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা একশ’ ফুট জায়গায় কোনো ধরনের স্থাপনার অনুমোদন দেব না। এটিই মাস্টার প্ল্যানের অংশ। সিডিএ এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করছে। রাস্তাটি বাস্তবায়ন করতে হলে ওখান দিয়েই করতে হবে। এটির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পুরো এলাকাটি ঘিরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। সিডিএ ইতোমধ্যে উচ্ছেদের চূড়ান্ত নোটিশ দিয়ে রেখেছে। অননুমোদিত স্থাপনা হিসেবে সিডিএ যে কোনো অবৈধ স্থাপনাই উচ্ছেদ করতে পারে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ যদি রাস্তা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেয় বা দেয়াল নির্মাণ করে সেক্ষেত্রে সিডিএ উচ্ছেদ অভিযান চালাবে। এখানে কোনো ধরনের স্থাপনার ব্যাপারে সিডিএ প্ল্যান অনুমোদন করতে পারে না। করবে না। তাছাড়া কোনো ধরনের এনওসিও সিডিএ দেবে না বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সিডিএর ছাড়পত্র বা অনাপত্তি পত্র না পেলে চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিবেশ ছাড়পত্র পাবে না। কোনো ধরনের ভূমিও হুকুমদখল করতে পারবে না। বিদেশী সংস্থার ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ ছাড়পত্র এবং সিডিএর এনওসির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সিডিএ থেকে প্রয়োজনীয় এনওসি না পেলে এই প্রকল্পের ভবিষ্যত অন্ধকার বলে সূত্র জানিয়েছে। অপরদিকে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ভূমি না দিলে সিডিএর রাস্তা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে আউটার রিং রোডের ফিডার রোড-২ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প অনিশ্চয়তায় পড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দুইটি প্রকল্পই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে বলছে, সুষ্ঠুভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়িত হলে দিনশেষে চট্টগ্রামই উপকৃত হবে। দুইটি সরকারি সংস্থার চলমান বিরোধে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ঝুলে গেলে চট্টগ্রামই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তারা মন্তব্য করেন।