জ্বালানিতে আশ্বাস, বাণিজ্যে জোর

হাসিনা-মোদী বৈঠক কুশিয়ারায় সমঝোতা তিস্তার জট খুলবে, আশা প্রধানন্ত্রীর

আজাদী ডেস্ক | বুধবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

বৈশ্বিক সঙ্কটের মধ্যে আকাঙ্ক্ষিত জ্বালানি তেল পাওয়ার বিষয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছ থেকে এক ধরনের আশ্বাস পেয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাণিজ্য সুসংহত করার বিষয়েও তাদের মতৈক্য হয়। এদিকে কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনে প্রতিবেশী দুই দেশ সমঝোতা স্মারক সই করলেও বরাবরের মতোই ঝুলে থাকল তিস্তা নদীর বিষয়ে একই রকমের চুক্তি। তবে শেখ হাসিনা বলেছেন, তিস্তা চুক্তির জটও অচিরেই খুলবে বলে তিনি আশা রাখছেন। তিন বছর পর শেখ হাসিনার ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে দুই শীর্ষ নেতা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি একান্তেও আলাপ করেন। বৈঠক শেষে উভয় দেশের মধ্যে কুশিয়ারা নদীর ১৫৩ কিউসেক করে পানি প্রত্যাহারসহ সাতটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। খবর বিডিনিউজের।

দিল্লিতে কর্মব্যস্ত এই দিনে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও উপরাষ্ট্রপতি জগদীন ধনখড়ের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন শেখ হাসিনা। তার দিনের কর্মসূচি শুরু হয় রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে ফুল দিয়ে। এদিন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নিহত ও আহত ভারতীয় যোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্টুডেন্ট স্কলারশিপ’ তুলে দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। দুপুরের শীর্ষ বৈঠকের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মধ্যাহ্ন ভোজে যোগ দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ তার সফরসঙ্গীরা। এরপর সাংবাদিকদের সামনে এসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম কোভিড পরবর্তী এবং বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ‘আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার’ অংশ হিসেবে এই সফরের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, দুটো বিষয়ে অগ্রগতি করেছি আলোচনায়। জ্বালানি সহায়তা বিশেষ করে ভারত থেকে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ডিজেল ক্রয়ের জন্য আমাদের রিলেটেড মিনিস্ট্রি বা ডিপার্টমেন্টগুলো আলোচনা করবে এবং এই পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট জ্বালানি সঙ্কট মেটাতে ভারতের কাছে জ্বালানি তেল চাওয়া হবে বলে আগেই জানানো হয়েছিল। কেননা পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনে নিজেদের ভান্ডার মজবুত করছে ভারত। ভারতের উদ্বৃত্ত জ্বালানি তেল পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে শাহরিয়ার বলেন, জ্বালানির ক্ষেত্রে আমরা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা উদ্বৃত্ত শব্দটা ব্যবহার করিনি। বলেছি, ভারত থেকে আমরা জ্বালানি নিতে চাই। এটা শুধু ডিজেল নয়, গ্যাসের জন্যও বলা হয়েছে। এবং ভারত ইতোমধ্যে জানিয়েছেও আমাদেরকে, নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ তৈরি করছে একাধিক ভারতীয় কোম্পানি, যা পরিবেশবান্ধব, কম দামি ও নিরাপদ। তারা নেপালের বিদ্যুৎ তাদের স্ট্রাকচারের মধ্যে নিয়ে এসে তাদের কানেকশন দিতে চান। যেই অঞ্চল দিয়ে দিতে চান এই অঞ্চলে গ্রিড কানেক্টিভিটি নিয়ে হয়ত আমাদের কাজ করতে হবে। এটা নিয়ে কিন্তু বেশ অগ্রগতি আছে। সামনের দিনে ইমপোর্ট করতে পারব বলে আমরা আশা করি।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, জ্বালানিসহ অন্য অনেক বিস্তৃত ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেছেন তিনি। এক টুইটে তিনি বলেন, বৈঠকে আন্তঃযোগাযোগ জোরদার, বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব মজবুত এবং তথ্যপ্রযুক্তি, জ্বালানি ও অন্য অনেক কিছুতে সহযোগিতা ত্বরান্বিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ মোকাবেলায়ও একসঙ্গে কাজ করতে মতৈক্য হয়েছে।

জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় রামপালের মৈত্রী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভূমিকা পালন করবে উল্লেখ করে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদী বলেন, জ্বালানির ক্রমবর্ধমান দাম বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে।

এদিন দুই প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত রামপালের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উদ্বোধন করেন। সেই প্রসঙ্গ তুলে মোদী বলেন, আজ মৈত্রী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের উদ্বোধন বাংলাদেশে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ প্রাপ্তির সুযোগ বাড়াবে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র যে ক্ষেত্রে পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ তৈরি করেছে, সেই সুন্দরবন সংরক্ষণে পরস্পরের সহযোগী হয়ে কাজ করার কথাও বলেন মোদী।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্য ও জ্বালানি নিয়ে, নিরাপত্তা নিয়ে আমরা কাজ করব, বাংলাদেশ সবসময় অগ্রাধিকার পাবে।

বাণিজ্য, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও স্থিতিশীলতা : দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকে বাণিজ্য সুসংহত হওয়ার আলোচনার কথা উল্লেখ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যার মধ্যে আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশের বহুল প্রতীক্ষিত সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির (সেপা) বিষয়টিও।

বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এশিয়ার মধ্যে ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার বাংলাদেশ। এই অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করতে দ্বিপক্ষীয় সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সেপা) করার আলোচনা দ্রুত সময়ের মধ্যে শুরু করতে চান তারা। দুই দেশের সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, আজ বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী এবং এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। মানুষে মানুষে সংযোগের ক্ষেত্রে অব্যাহত উন্নতি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে আমাদের সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি বহু দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছি।

মোদী বলেন, কোভিড মহামারী ও সামপ্রতিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া এবং আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা দরকার। বাংলাদেশের পাটের উপর থেকে ভারতে অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি উঠিয়ে নেওয়ার বিষয় সমাধানে প্রধানমন্ত্রী মোদী নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান শাহরিয়ার।

ভারত ও বাংলাদেশের পাশাপাশি পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী। শেখ হাসিনা বলেন, গত ৫০ বছরের গড়ে ওঠা শক্তিশালী অংশীদারিত্বের উপর ভর করে উভয় দেশ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিস্তৃত সব বিষয় নিয়ে কাজ করছে। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখা এবং দুই দেশ ও এ অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমি ও প্রধানমন্ত্রী মোদী একমত হয়েছি।

নরেন্দ্র মোদী তার বক্তৃতায় বলেন, সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সহযোগিতার বিষয়ে তারা জোর দিয়েছেন আলোচনায়।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আশ্বাস : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কাজ করার বিষয়ে ভারতের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে বলে জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার। তিনি বলেন, মিয়ানমারে বর্তমানে যে অস্থিরতা চলছে, সে বিষয়ে ভারতও ওয়াকিবহাল। প্রত্যাবাসনের আলোচনাটি যে বিভিন্ন পর্যায়ে এসে থেমে গেছে, এটা যাতে পুনরায় চালু হয় এ ব্যাপারে তারা তাদের অবস্থান থেকে সহযোগিতা করবেন।

সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার দাবি বাংলাদেশ পুনর্ব্যক্ত করেছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সীমান্তে হত্যা আগের তুলনায় অনেকখানি কমে এসেছে।

কুশিয়ারায় সমঝোতা স্মারক, ঝুলে থাকল তিস্তা : দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে কুশিয়ারা নদীর ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশ ও ভারত একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে। তবে প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তির বিষয়টির সুরাহা হয়নি।

তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিসহ ভারত ও বাংলাদেশের অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুত সমাধান হবে বলে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে অনেক অনিষ্পন্ন সমস্যার সমাধান ইতোমধ্যে করেছি। আমি আশা করি তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তিসহ অন্যান্য অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো শিগগির সম্পন্ন করতে পারব। আমি প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ধন্যবাদ জানাই, আজকে আমরা কুশিয়ারা ইস্যু সমাধান করেছি এবং আমি আশাবাদী, মোট যে ৫৪টি নদী আছে, সেগুলোআমি জানি, যতক্ষণ পর্যন্ত মোদী আছেন, বাংলাদেশভারত আমরা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলব।

তিস্তা চুক্তি নিয়ে অগ্রগতির বিষয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, তিস্তা নিয়ে আমাদের যে প্রয়োজনীয়তা ও এক্ষেত্রে ভারত যে আরেকটু উদার মনোভাব দেখাতে পারে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই এএনআইয়ের সাক্ষাৎকারে বলেছেন। সেটা ওইভাবেই আলোচনা হয়েছে এবং আমরা অ্যাশিওরেন্সের জায়গাতেই আছি এখনও এবং আমরা বিশ্বাস করি যে, তারা যে প্রতিশ্রুতিটা দিয়েছেন, দেরি হলেও এটা ডেলিভারড হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজমজ নবজাতকের মৃত্যুর দায় কার
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা