এলিজাবেথীয় নাট্যকার জর্জ চ্যাপম্যান কর্তৃক খ্রীস্ট পূর্ব অষ্টম বা নবম শতকের সর্বকালের সেরা প্রাচীন গ্রীক মহাকবি অন্ধ হোমার রচিত মহাকাব্য ‘ইলিয়াড‘( যা গ্রীক পুরাণতত্ত্বের মতে ট্রোজান যুদ্ধ যা গ্রীস ও স্পার্টার মধ্যে সুদীর্ঘ ২৯ বছর চলেছিল তার নায়ক গ্রীসের শ্রেষ্ঠ বীর আকিলেসের প্রতিশোধ প্রবণতার উপর ভিত্তি করে রচিত) ‘ইলিয়াড‘ ও ‘ওডিসি‘ (ট্রোজান যুদ্ধের আরেক বীর ট্রয় দখলকারী রোমান ইউলিসিস এর শৌর্য বীর্যের কাহিনীর মহাকাব্য) এবং তার স্তোত্রাবলির অনুবাদ পড়ে ব্রিটিশ কবি ও সনেট লেখক জন কীটস (১৭৯৫–১৮২১) যে বিস্ময়কর অনুভূতি ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন তা আমরা দেখি তাঁর সনেট ‘On first looking into Chapman’s Homer’ (১৮১৬ ইংরেজী ) এ।
সীমিত জ্ঞানের পরিসরে তার রচনার বিশালত্ব ও চমৎকারিত্ব দেখে কীটস অনড়, স্থির চক্ষে বিমূঢ়, বিমূর্ত, তার মনে হয়েছিল এ যেন দেব দেবী বা ঈশ্বরের অনিন্দ্যসুন্দর কোন সৃষ্টি, সুপ্রাচীর যুগের কোন নিদর্শন বা প্রাচীন যুগের বিস্ময়কর সুবিশাল রত্ন ভান্ডার। জন কীটস চ্যাপম্যান কর্তৃক হোমারের কর্মের অনুবাদ দেখে অনুপ্রাণিত, অত্যধিক উত্তেজিত, বিস্মিত, এ যেন দর্শনীয়, রোমাঞ্চকর, দুঃসাহসিক কোন অভিযাত্রা। জন কীটস মহানন্দিত হৃদয়ে বিস্ময়াভিভূতিতে কী যেন ধনভান্ডার আবিষ্কার করল।
বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ও ড. আহমদ শরীফ সম্পাদিত মীর সৈয়দ সুলতান এর রচনা ‘জ্ঞান চৌতিশা’ পড়ে অধ্যাপক আসদ্দর আলী তেমনি বিস্ময়কর অনুভূতিতে তাঁর গবেষণা ভিত্তিক রচনায় মীর সৈয়দ সুলতান কে ‘মহাকবি’ আখ্যা দেন। অনুরূপ আমাদের, লোক কবি, লোকশিল্পী, অসংখ্য মরমী গানের রচয়িতা, কিংবদন্তি গীতিকার, পদকার, পুঁথিকার ও কন্ঠ শিল্পী, বহু গ্রন্থের লেখক, সুফীবাদী দার্শনিক ও প্রেমিক কবি, মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতানের ভাব শিষ্য গুণী মহাপুরুষ আশকর আলী পন্ডিতের অনেক রচনার একটি ‘জ্ঞান চৌতিশা’ (যদিও অনেকাংশই পুড়ে, অযত্ন অবেলায় হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে গেছে) তার কিছু খণ্ডিত অংশ পড়ে আমরা বিস্মিত, অভিভূত, উচ্চসিত ও আন্দোলিত।
আশকর আলী পণ্ডিত কি কারণে তার গ্রন্থের নাম ‘জ্ঞান চৌতিশা’ রেখেছিলেন (মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতানের ভাব শিষ্য বলে) তার ব্যাখ্যা বা অন্তর্নিহিত কাহিনী এখনো অন্ধকারের তিমিরে যা উদঘাটিত হয়নি।
কিন্তু অক্ষর জ্ঞানবিহীন, গেঁয়ো গায়েন, পদকার, আশকর আলী পণ্ডিতের অনেক সৃষ্টির মধ্যে ‘জ্ঞান চৌতিশা’ দেখে আসলে অবাক হতে হয়। তাঁর এ সৃষ্টি, এ রচনা আসলে পুঁথি আকারে একটি প্রণয় কাহিনী কাব্য।
আনুমানিক ১৮৫৫ সনে ( মতান্তরে ১৮৪৬) জন্ম মৃত্যু ১১ মার্চ ১৮৮২ইংরেজী সনে গুণী পুরুষ আশকর আলী পন্ডিত চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার উত্তর সীমান্তে, পটিয়া উপজেলার শোভনদ্ন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কারো কারো মতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন সাতকানিয়া উপজেলার পুরানগড় গ্রামে এবং ১৮৮২ সনের ১১ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আশকর আলী পণ্ডিতের বাল্য কাল, শিক্ষা জীবন ও জ্ঞান সম্পর্কে তেমন কিছু জানার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি, যা এখনো তিমিরে রয়ে গেছে। তবুও তাঁর রচনা ‘জ্ঞান চৌতিশা’র প্রতি কিছুটা দৃষ্ট নিবদ্ধ করা প্রয়োজন মনে করছি।
‘চৌতিশা শব্দের অর্থ চৌত্রিশ,
‘চৌতিশা‘ অর্থ দুঃখের বিলাপ,
‘চৌতিশা‘ হল চিন্তার ছন্দ, ও আনন্দ ।
চৌত্রিশটি বাংলা বর্ণের (ক–হ) এক একটিকে চরণের প্রথম শব্দের আদ্যক্ষর রূপে প্রয়োগ করে বিভিন্ন মাস বা ঋতুতে নায়ক নায়িকার বিরহের বর্ণনার উদ্দেশ্যে যে পদ ব্যবহার করা হয় তাই চৌতিশা বা এক এক মাসের প্রকৃতিক প্রভাব বর্ণনার উদ্দেশ্যে একাধিক চরন রচনার শৈল্পিক রীতিকে চৌতিশা বলে।
আবার দেখা যায় ভারতীয় সাহিত্যে সাহিত্য রচনার একটি ধারা ‘চৌতিশা‘।এটি মধ্যযুগীয় কবিতা লিখন শৈলীর এটা একটি রূপ যেখানে প্রতিটি পংক্তি বর্ণমালার প্রথম ব্যঞ্জন বর্ণ দিয়ে শুরু হয়। মধ্যযুগীয় এক প্রকার খণ্ড কবিতার নামও ‘চৌতিশা‘। মধ্যযুগের কবি শেখ ফয়জুল্লাহর বিখ্যাত রচনার নাম ‘জয়নবের জ্ঞান চৌতিশা‘।
পনেরো শতকের কবি শেখ ফয়জুল্লাহ রচনার নাম ‘জয়নবের চৌতিশা‘,বাহরাম খানের রচনার নাম -‘লায়লী চৌতিশা,আঠারো শতকের কবি মহম্মদ ফসিহ ‘চৌতিশা‘ রচনা করেন, মুসলমান কবিরা আরবি, ফারসী উপাদান ব্যবহার করে ‘চৌতিশা‘ রচনা করতেন। শামীম সুলতানা রচিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে চৌতিশা ‘ বইটিতে আমরা অর্থবহ পদটির পরিচয় পাই।
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি আশকর আলী পন্ডিতের বাল্য ও শিশুকাল,শিক্ষাজীবন ও জ্ঞান সম্পর্কে তেমন কিছু জানার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি যা এখনো অন্ধকারে বিরাজমান কিন্তু তার ‘জ্ঞান চৌতিশার কিছু কিছু অংশ পাঠে আমরা তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও মেধার পরিচয় পাই।
যেমন তিনি আত্ম পরিচয় দিয়ে লিখেছেন,
‘ধনজন হীন বিদ্যা শিখিতে না পারি
কিঞ্চিত দিলেক( দিলেন) প্রভু সমাদর করি‘ ।
অন্য জায়গায় তার অবতারণা আরো আকর্ষণীয়। তিনি লিখলেন,
‘তথা হীন মুই দীন আশকর আলী নাম
দুঃখের বসতি এই শোভনদন্ডী গ্রাম ।
ধন জন হীন আর বুদ্ধি বিদ্যাহীন
তে(সেই)কারণে কাজকর্মে নয় মন লীন( মনোনিবেশ)।
জনক মোশরফ আলী গুণে সুরুচির
তান (তাঁর) পিতা নাম শ্রেষ্ঠ দোলন ফকির‘।
আশকর আলী পন্ডিত জগতের গঠন, সৃষ্টি রহস্য নিয়ে তার চিন্তা তাবৎ মরমী কবি, আধ্যাত্মিক সাধকদের লেখা ও চিন্তার সংগে দারুণ সাযুয্য পাই। যেমন তিনি চমৎকারভাবে লিখেছেন,
‘আগমেতে( তণ্ত্র শাস্ত্র বা বেদান্তী শাস্ত্র)
লেখিয়াছে শুনিবারে পাই
কি মতে করিল সৃষ্টি ত্রি–জগত গোঁসাই।
কোথাতে সৃজন হইল অগ্নি, বায়ু , জল
কোথা হন্তে( হতে) রবি শশী নক্ষত্র নির্মল
কোথা হন্তে (হতে) জন্মিয়াছে খাকের( মাটি) পতন‘ ।
ফকির লালন সাঁই, দেওয়ান হাছন রাজা, দুরবীন শাহ, রমেশ চন্দ্র শীল, মওলানা আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী, মওলানা বজলুল করিম মন্দাকিনী, শাহ আব্দুল করিম, পান্জু শাহ, দুদ্ধু শাহ, রকীব শাহ, রাধারমন দত্ত, শীতালংশাহ, মওলানা আবুল খায়ের, পন্ডিত খায়রুজ্জান, উকিল মুনশী ও অনেক বাউল, বৈষ্ণব, সুফী সাধদেকর মত তার ব্যবহৃত শব্দ ভান্ডার আরো আকর্ষণীয়, ভাবময়, মোহময়, বিনয়ে ভরপুর। যেমন; আরশীনগর, পড়শি, আয়নামহল, বাহান্ন বাজার,তিপ্পান্ন গলি,ছয় বোম্বেটে, নবদ্বার, আটকুঠুরী, চৌদ্দপোয়া, চার রং, ত্রিবেণীর ঘাট, অনাদি, নিরঞ্জন, সত্য পীর, সত্য নারায়ন, হর – পর্বতি, গোঁসাই, ভীননাঙ এ সকল অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ, নিগূঢ় অর্থ বহন কারী, রহস্যাবৃত সুচারু ও সর্বোত্তম শব্দের ব্যবহার তার গুহ্য সাধনার অনেক ইংঙিত বহন করে।
আশকর আলী সংসার ত্যাগী বাউল ছিলেন না, ছিলেন অচিন পাখীর ধারক, সম্পন্ন গেরস্থ, জমিজমা, দোতলা বাড়ির মালীক।এমন গৃহীর জীবনের অভ্যন্তরে বাউলিয়ানার বসত সমান বিস্ময়কর।
সংসারে তিন স্ত্রী, ছয় সন্তান নিয়ে জীবনযাপন করে আজীবন সঙ্গে বাউলত্বকে তিনি লালন করেছেন। বাংলার জল,মাটি, আলো, বাতাস ও ঐতিহ্য থেকে উঠে আসা স্বকীয় দর্শন, লোকসংগীতের, লোকসাংস্কৃতির, লোককাহিনির প্রকাশ এবং ধারণ তার লেখায় সুস্পষ্ট।
তার লেখা অসংখ্য গানেও আধ্যাত্মিকতা,মরমী ভাব,সুফীবাদ, বাউল ও দেহতেত্ত্বের অনেক উপাদান তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেছেন ।
যেমন তার বিখ্যাত কিছু আধ্যাত্মিক, মরমী ও দেহতেত্ত্বর গান :
‘কি জ্বালা দিয়া গেলা মোরে/ নয়নের কাজল পরানের বন্ধু রে / ন দেখিলে পরাণ পোরে‘।
আবার, ‘ডালেতে লরি চরি বইয় চাতকী ময়নারে / গাইলে রৈরাগীর গীত গাইও‘।
যদিও সময়, পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে, যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে তার লেখা সমূহের কিছু নষ্ট হয়েছে, কিছু হারিয়ে গেছে বা তথ্যমতে অনেক লেখা পুড়ে ছাই হওয়ার কারণে সে সবের পাঠোদ্ধার করা যায় নি। এ ছাড়া তাঁর আরো অসংখ্য গানে,রচনায়, লেখায় ভাব, ভাষা, শব্দ প্রয়োগে মুন্সিয়ানার ছাপ দৃষ্ট হয়।
আমরা আরো আশ্চর্যান্বিত হই, যখন দেখি তার লেখা ভারতীয় মধ্যযুগীয় সাহিত্য ধারার রীতির সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তিনি যখন মধ্যযুগীয় কোন মহাকবির ভাবশিষ্য হন,তাদের অনুরূপ ভাব,চিন্তা,ভাষার প্রয়োগ তার লেখায় অবলীলায় ব্যবহারের ধারণা পাই,যখন তিনি পনেরো শতকের কোন লেখকের লেখায় অনুপ্রাণিত হন,প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য রচনার ধারার সাথে তার লেখার সাযুজ্য পাওয়া যায়, মধ্যযুগীয় কবিতা লেখার শৈলীরূপ ও খন্ড কবিতার সাথে তার পরিচয় দেখি এবং আঠারো শতকের ‘চৌতিশা‘ র লেখক কবি মুহম্মদ ফসিহ্ র রচনার প্রভাব তার লেখায় পরিদৃষ্ট হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীত শিল্পী











