জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

এ. কে. এম. আবু বকর চৌধুরী | রবিবার , ১৭ জুলাই, ২০২২ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

জ্ঞানতাপস চলিষ্ণু প্রাচ্যবিদ্যা কল্পদ্রুম আলহাজ্ব ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিএ (অনার্স), এমএ, বিএল, ডিপ্লো ফোন, ডি-লিটের ১৩৭ তম জন্ম (১০ জুলাই ১৮৮৫, শুক্রবার) ও ৫৩ তম মৃত্যু (১৩ জুলাই, ১৯৬৯ রোববার) বার্ষিকীতে তাঁর স্মরণে আমার নিম্নে বক্ষনিবন্ধটি উৎসর্গ করছি। তিনি আমাদের জ্ঞানাকাশের তেজোদীপ্ত সূর্য।

তাঁর জন্ম ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমাধীন পিয়ারা গ্রামে। ১৯১০ সালের ১০ অক্টোবর মরগুরা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ৭ ছেলে ও ২ কন্যার গর্বিত পিতা-মাতার কনিষ্টজন বিশিষ্ট শিল্পী মতুর্জা বশীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। কলকাতা মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে প্রেসিডেন্সী কলেজ হতে ১৯০৬ সালে এফ.এ এবং ১৯১০ সালে সাংস্কৃতিতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

কিন্তু পরবর্তী শিক্ষাদ্বারে তিনি যেই বাধাগ্রন্ত হন তা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। সংস্কৃতিতে এমএ পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অধ্যাপক কাশী বিদ্যালয়ের উপাধিধারী পণ্ডিত সত্যবৃত স্বামাশ্রয়ী বাধা দেন। পন্ডিত মহাশয় ছিলেন গোড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। তিনি ঘোরতর আপত্তি তুলে শহীদুল্লাহ সাহেবকে ক্লাসত্যাগে বাধ্য করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত বাহুবল্লভ শাস্ত্রী ও পণ্ডিতজীর সাথে এক জোট হয়ে এক ঘৃণ্য, জঘন্য ও সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আপত্তি দেখান যে, অহিন্দুকে বেদ বেদান্তের তত্ত্বকথা জানতে ও শিখতে দিলে বেদ নাকি অশুদ্ধ ও ধর্মবিরোধী হবে।

শেষ পর্যন্ত জনমতের চাপে বাধ্য হয়ে তাঁকে এমএ পড়ার সুযোগ দানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের বিভাগ খুলতে হয় এবং এই বিভাগের প্রথম ও একমাত্র ছাত্ররূপে তিনি ১৯১২ সালে “তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে” কৃতিত্বের সাথে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশক্রমে ও বিশিষ্ট জননেতা তৎকালীন বঙ্গীয় আইন পরিষদের বাংলা ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবীতে প্রস্তাব উত্থাপনকারী বিশিষ্ট জননেতা টাঙ্গাইলের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৩ সালে জার্মান দেশে সংস্কৃত পড়ার জন্য ভারত সরকারের বৃত্তি লাভ করেও কলকাতা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ কর্তৃক চক্রান্তমূলকভাবে স্বাস্থ্যগত ছাড়পত্র না দেয়ায় এই জ্ঞানতাপসের ইউরোপ যাওয়া হয়নি।

বাংলা সাহিত্য ও ভাষার মহাদিকপাল ডক্টর মুহাম্মদ শহীদ উল্লাহ ১৯১৪ সালে আইনের ডিগ্রি লাভ ও কিছুকাল আইন ব্যবসাও করেন। ১৯২৬ সালে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য এশিয়ার মাটি ছেড়ে তিনি যান ইউরোপের মাটিতে সেখানে তিনি “লে শা মিস্তিক” (LEN CHANTS MYSTIQUES) বা মর্মবাদী গান, অপভ্রংশ, তিব্বতী ও বাংলায় বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করে মৌলিক গবষণামূলক গ্রন্থ ফরাসী ভাষায় রচনা করেন। প্যারিস সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯২৮ সালে প্রথম শ্রেণি ‘ডক্টরেট’ লাভ করে এবং ধ্বনিতত্ত্বে গবেষণামূলক আরেক প্রবন্ধ লিখে ডিপ্লোমা পান। তাঁর পূর্বে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় হতে এই উপমহাদেশীয় কোন মুসলমান এই গৌরবজনক উপাধি লাভ করেনি তেমনি তাঁর পূর্বকোণ এশীয়বাসী প্যারিস হতে ধ্বনিতত্ত্বে ডিপ্লোমা অর্জন করেনি।

প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জ্ঞানতাপস বৈদিক ভাষা, বৌদ্ধ, সংস্কৃত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, তিব্বতী ও প্রাচীন পারসিক ভাষা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। জার্মান ফ্রাইবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রাচীন থোতনী, প্রাকৃত ও বৈদিক ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ ও প্যারিসের আর্কিভ দ্য লা প্যারল (ARCHIVE DE LA PAROLE) নামক ধ্বনিতত্বে শিক্ষাভাবনে ধ্বনিতত্ত্ব শিক্ষা সম্বন্ধে শিক্ষার্জন করেন।

জ্ঞান তাপস ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা, ইংরেজী, আরবী, ফার্সী, উর্দু, ফ্রান্স, জার্মান, সিংহলী, হিন্দু, সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, বৈদিক, আবেস্তান, তিব্বতী, মৈথিলা, আসামী, উড়িয়াসহ ৩৬টি ভাষায় অনর্গল পড়তে, লিখতে ও কথা বলতে পারতেন।

বাংলা সাহিত্যে ও ভাষার ইতিহাসে এই অমর জ্ঞানতাপস বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভাষা ও সাহিত্যের উপর গবেষণা করেন। তাঁর মতে পৃথিবীতে ২৭৯৬টি ভাষা আছে। তবে মৌলিক সবগুেিল ভাষা নয়। যেমন বাংলা, আসামী, উড়িয়া, বিহারী, হিন্দী, উর্দু, মারাঠী, গুজরাটী, নেপালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, কাশ্মিরী, সিংহলি প্রভৃতি একটি মূলভাষা থেকে এসেছে। সেই মূল ভাষাকে আমরা আদিম প্রাকৃত ভাষা বা কথ্য প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা বলতে পারি। অন্যদিকে পশতু, ওড়মুরী, বেলুচি, পারসী, কুর্দিস্থানী এগুলি প্রাচীন ইরানী আর্য ভাষা থেকে জন্মেছে। ভারতবর্ষের অপভ্রংশ, প্রাকৃত, পালি, সংস্কৃতি ও বৈদিক এবং ইরানের প্রাচীন ফারসী, পাহলভী ও আবেস্তানের ভাষা এই সকলের মূল ভাষাকে আমরা হিন্দু-ইরানী বা আর্য ভাষা বলতে পারি। এসব ভাষার সাথে আরমানী, আলবানী, রুশ, চেক, ফারসী, ইতালীয়ান, স্পেনিশ, পতুর্গীজ, জার্মান, সার্বোক্রোয়াট, ওস্কিয়াম, ডাচ, ইংরেজি, ব্রিটানিক প্রভৃতি ভাষার মূলে সাদৃশ্য আছে। সেজন্য এগুলিকে হিন্দু-য়ুরোপায়াম বা হিন্দু-জার্মান মূল ভাষার শাখা-প্রশাখা বলা হয়েছে।

মনে প্রাণে বাংলা ভাষার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর ভাষা সম্পূর্ণ অলংকার বর্জিত অথচ প্রাঞ্জল। অতুক্তি, অতিরঞ্জন, অতিভাষণ তাঁর ভাষায় প্রকৃতি বিরুদ্ধ ছিল। প্রকৃতপক্ষে এমন ভাষাই বাংলায় গবেষণালব্ধ ফল প্রকাশের উপযুক্ত বাহন। তিনি অধিকক্ষেত্রে অতি সহজ আধু ভাষা স্বীয় রচনায় ব্যবহার করতেন। লেখ্য ভাষা সম্পর্কে তাঁর বিশেষ মত হল যে রচনায় কোন উপভোগ বা উপাষিক বৈশিষ্ট্যের আমদানী, এমনকি ভাষায় অযথা বা অকারণে বিদেশী অলঙ্কার, বাকভঙ্গি, পদবিন্যাস প্রণালী, শব্দ সম্ভার প্রভৃতি প্রয়োগ করা বাঞ্চনীয় নয়, তাঁর বিশ্বাস এতে ভাষার বিকাশ সঠিক না হয়ে পঙ্গুতা বৃদ্ধি পায় এবং ক্রমশ ভাষা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে।

সাহিত্য সাধনায় ড. শহীদুল্লাহর অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল রবীন্দ্র সাহিত্য। তাঁর পরিস্কার উপলব্ধি হল যে, বাঙালি হয়ে যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা করি তবে রবীন্দ্রনাথকে কখনও অস্বীকার করা যায় না। কারণ যেই ভাষা রবীন্দ্র ভাষা স্বীকৃত এবং যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আমরা গর্ব করি, রবীন্দ্রনাথের কাছে তার ঋণ অপরিসীম।

তাঁর ৬৩ খানা গ্রন্থ এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। তৎমধ্যে লে শা মিস্তিক, les sons du Bengali, ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা সাহিত্যের কর্তা, ১ম ও ২য় খণ্ড, বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, দিওয়ান-ই-হাফিজ, শিকওআহ ও জওআব-ই-শিকওআহ, রুবাইয়াত-ই-ওমর খয়্যাম, পদ্মাবতী, বিদ্যাপতি শতক, অমর কাব্য, মহাবাণী, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে শেষ নবী, শেষ নবীর সন্ধানে, ইসলাম প্রবন্ধ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

জ্ঞানাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ শিক্ষকতা জীবনের দীর্ঘ তিনটি যুগের মধ্যে (১৯২১-১৯৫৮) তিনবার অবসর গ্রহণ ১৯৪৪’র ৩০ জুন : ১৯৫৪’র ১৫ নভেম্বর ও ১৯৫৮ করেন।

উপমহাদেশের এই জ্ঞানাধারের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে, ভাষা ও সাহিত্য এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অপরিসীম অবদান রাখা সত্ত্বেও ঢাকা বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনটিতে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এই পণ্ডিত ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রফেসার এমেরিটাস’ পদে মৃত্যুক্ষণ (১৯৬৯’র ১৩ জুলাই) পর্যন্ত আসীন ছিলেন।

তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক (১৯১১-১৫), পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি (১৯৬১-৬৪), এলায়েন্স ফ্রান্সের সভাপতি (১৯৬৩) হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

এই জ্ঞানতাপস পণ্ডিতবরকে জ্ঞান সাধনা অংশের অতুলনীয় আদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৫৮’র ৩০ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সাহিত্য পুরস্কার “প্রাইড অব পারফরমেন্স’ সহ নগদ দশ হাজার টাকা ও স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল কর্তৃক ফেলোশীপের সম্মান প্রদান করা হলে তা পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হন।

১৯৫২ সালে ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ তাঁকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধি দেয় এবং সমকালীন বিদ্যেুৎ সমাজে “চলিষ্ণু প্রাচ্য বিদ্যাকল্পদ্রুম’ হিসেবে স্বীকৃত পান। ১৯৬৩’র ১২ ফেব্রুয়ারি ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয়।

তাঁর অশীতি বর্ষপূর্তিতে বাংলা একাডেমী, ললিতকলা একাডেমি, ঢাকা ও রাজশাহী বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি, পাকিস্তান লেখক সংঘের (রাইটার্স গিল্ড) পূর্বাঞ্চল শাখা, গুণমুগ্ধজন প্রভৃতি তাঁকে বিশেষভাবে গভীর শ্রদ্ধার সাথে সম্বর্ধিত করেন।

অধ্যাপক সম্পর্কে প্রশ্নে উঠলে ড. সুনীতি চট্টোপাধ্যায় প্রায় নাকি বলতেন ব-ব-ব-ব অর্থাৎ অধ্যাপক হতে হলে চারটি ‘ব’ এর প্রয়োজন। তাহল বপু, বিনয়, বক্তৃতা ও বদান্যতা। তিনি নাকি প্রায় সময় ড. শহীদুল্লাহকে চারটি ‘ব’ দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহান গবেষক জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র নামানুসারে ঢাকা বা চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কাছে আকুল আবেদন রইল।

লেখক : জীবন সদস্য-বাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২-৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধস্বর্ণমুদ্রা, ডলার ও চলমান মুদ্রা সংকট