জেলিফিসে শত কোটি টাকার হাতছানি

বোরির বিজ্ঞানীদের বহুমাত্রিক গবেষণা জাহাজ না থাকায় সাগরে জরিপ চালানো যাচ্ছে না আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ১১শ টাকা দেশে পোকা-মাকড়ের খাদ্য

কক্সবাজার প্রতিনিধি | মঙ্গলবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:০৮ পূর্বাহ্ণ

শত শত বছর ধরে কক্সবাজার সৈকতে ভেসে আসছে জেলিফিশ বা ‘নুইন্যা’। তবে অযত্ন, অবহেলায় পচে-গলে সৈকতের মাটিতেই নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক এই প্রাণীটি। খাদ্য হিসাবে এবং ওষুধ ও প্রসাধন তৈরিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেলিফিশের বহুল ব্যবহার রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এক কেজি জেলিফিশের দাম ১০ ডলার বা প্রায় ১১শ টাকা। আমাদের দেশে সৈকতের পোকা-মাকড়ের খাদ্য হওয়া জেলিফিশের শেষ পরিণতি।
সম্প্রতি কঙবাজার সৈকতে শত শত মৃত জেলিফিশ ভেসে আসার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) বিজ্ঞানীরা এমন চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারেন। এখন জেলিফিশকে নিয়ে সুনীল অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচনেরও স্বপ্ন দেখছেন তারা।
গত ১১ নভেম্বর সকাল ৬টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা ধরে শহরের কলাতলী বেইলি হ্যাচারি পয়েন্ট থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার
সৈকতে সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে শত শত মৃত জেলিফিশ ভেসে আসে। এসব জেলিফিশের একেকটির ওজন ১০ কেজি থেকে ৭০-৮০ কেজি। এর আগে ৩ ও ৪ আগস্টও একইভাবে কয়েকশ মৃত জেলিফিশ ভেসে এসেছিল কঙবাজার সৈকতে। তবে কঙবাজারে ভেসে আসা জেলিফিশটি ক্ষতিকর প্রজাতির নয়, বরং খাওয়ার উপযোগী বলে জানান বোরির বিজ্ঞানীরা।
বোরির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, ৩ আগস্ট কঙবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে অসংখ্য মরা জেলিফিশ ভেসে আসে। এ নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হলে এবং পর্যটকদের মাঝে আতংক ও পরিবেশবাদীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হলে আমরা বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে অনুসন্ধান শুরু করি। ঘটনাস্থলে গিয়ে জেলিফিশের নমুনা সংগ্রহ করি। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হই, কঙবাজার সৈকতে ভেসে আসা জেলিফিশটি ‘লবণেমইড্‌স রোবাস্টাস’ প্রজাতির, যেটি স্থানীয়ভাবে ‘ধলা নুইন্যা’ বা ‘সাদা নুইন্যা’ হিসাবে পরিচিত। কেউ কেউ এটিকে ‘বর্‌ নুইন্যা’ও বলে।
তিনি জানান, বিশ্বে অন্তত দুই হাজার প্রজাতির জেলিফিশ রয়েছে, যার মধ্যে ১২টি প্রজাতি খাওয়ার উপযোগী। এসব প্রজাতির মধ্যে একটি হলো ধলা নুইন্যা বা হোয়াইট টাইপ জেলিফিশ। এটি কঙবাজারসহ দেশের অন্য উপকূলে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, এক কেজি জেলিফিশের দাম ১০ ডলার বা প্রায় ১১শ টাকা। বিশ্বে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে জেলিফিশের। সেই জেলিফিশ সৈকতের পোকা-মাকড়ের খাদ্য হচ্ছে।
জানা যায়, একসময় মৃত জেলিফিশ জমা হতো শহরের উত্তরাংশে বাঁকখালী নদী ও সমুদ্র মোহনার চরে। সেই নুইন্যা থেকে শহরের বিমানবন্দর সংলগ্ন ২ নং ওয়ার্ডের নাম হয়েছে নুনিয়ারছড়া, যা স্থানীয়ভাবে নুইন্যাছরা নামে পরিচিত।
সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, একটি ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থানতন্ত্রে কোনো একক প্রজাতির প্রাণীর আধিক্য বেড়ে গেলে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয় ও ওই পরিবেশে প্রাণের বৈচিত্র্য কমে যায়। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে বঙ্গোপসাগর থেকে জেলিফিশ আহরণ করতে হবে। অন্যথায় এটি সাগরের ইকোসিস্টেম ও প্রাণবৈচিত্র্য প্রভাবিত করতে পারে।
বোরির বিজ্ঞানীরা জানান, জেলিফিশ রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। সুনীল অর্থনীতিতেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
৩ নভেম্বর বিশ্ব জেলিফিশ দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সেমিনারে জেলিফিশ নিয়ে বোরির বিজ্ঞানীদের গবেষণা অগ্রগতি এবং এর সম্ভাবনা ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয়। বর্তমানে বোরির বিজ্ঞানীরা সাগর থেকে এর আহরণ, প্রক্রিয়াজাত, বাজারজাত ও খাবার রেসিপি কৌশল নিয়ে গবেষণা করছেন। গবেষণা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া জেলিফিশে খাদ্য, ঔষধি ও প্রসাধনীসহ অন্যান্য জৈব-রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতির হার জানতে চেয়ে বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল মেজারমেন্ট (বিআরআইসিএম) কর্তৃপক্ষের কাছে প্রায় দুই ডজন পরীক্ষার নমুনা পাঠানো হয়েছে এবং হচ্ছে।
বোরির মহাপরিচালক জানান, বিআরআইসিএমের কাছে ধলা নুইন্যা নামের জেলিফিশে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেড, লিপিড, অ্যাশ, ময়েশ্চার, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক, সোডিয়াম, আয়োডিন, আয়রন, কপার, ফ্যাটি এসিড, অ্যামাইনো এসিড, লেড, ক্যাডমিয়াম, মার্কারি ও আর্সেনিকসহ বিভিন্ন খাদ্য, ঔষধি ও প্রসাধনী গুণের উপস্থিতি ও এর মাত্রা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। জেলিফিশের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে এ প্রাণীটিকে নিয়ে বহুমাত্রিক গবেষণা করা হচ্ছে। তবে বঙ্গোপসাগরে এখনো জেলিফিশের স্টক নির্ধারণ করা যায়নি।
তিনি বলেন, সমুদ্রে গবেষণার জন্য জাহাজ না থাকায় আপাতত জেলিফিশ নিয়ে জরিপ চালানো যাচ্ছে না। তবে জেলেদের মাধ্যমে আমরা নিয়মিত সাগরের পরিস্থিতি যাচাই করছি।
বিজ্ঞানীরা জানান, ডাইনোসর যুগের আগের প্রাণী জেলিফিশ। পৃথিবীতে এদের আবির্ভাব প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে। ইংরেজি নামে মাছ হিসাবে অভিহিত করা হলেও জেলিফিশ কোনো মাছ নয়। এটি একটি অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এর কোনো হৃদপিণ্ড নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজ থেকে নতুন অফিসসূচি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা
পরবর্তী নিবন্ধছাত্রলীগ নেতাকে মারধর করে দোকানে বন্দি