জেলা মন্ত্রী, উন্নয়ন সমন্বয় এবং প্রসঙ্গ কথা

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | মঙ্গলবার , ২৫ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম দিনদিন রিক্ত, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। সময় যতই এগিয়ে যাচ্ছে, চট্টগ্রাম ততই পিছিয়ে পড়ছে। ফজল করিম যখন চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন চট্টগ্রামে অক্ট্রয় বা নগর শুল্ক প্রথা চালু ছিলো। আন্দরকিল্লায় পুরোনো চট্টগ্রাম পৌরসভার পূর্ব পাশে সিরাজদ্দৌলা রোডে লেবেল ক্রসিংয়ে রেলের গুমটি ঘরের ন্যায় একটি ঘর ছিলো, বাঁশ বা কাঠ দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে যানবাহন থেকে নগর শুষ্ক আদায় করতে আমি দেখেছি। অক্সিজেন চত্বরেও একটি দেখেছি মনে পড়ছে। চকবাজারেও সম্ভবত ছিলো, নিঃসন্দেহ হতে পারছিনা।

জিয়ার শাসনের অন্তিমকালে অথবা এরশাদের শাসনকালের প্রথমভাগে একটা জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি ছিলো। একজন মন্ত্রী ছিলেন কমিটির প্রধান, তবে সমন্বয়ের কাজটা করতেন জেলা প্রশাসক। পরে পৌরসভার কাঠামো বিবর্তনের ধারায় প্রথমে পৌর কর্পোরেশন, তারপর সিটি কর্পোরেশন হলো। তখন নগর পিতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমল চলছে, তিনি সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকারের ধারণার বশবর্তী হয়ে সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয়ে নগর উন্নয়ননের জন্য দায়ী সকল মন্ত্রণালয়, সংস্থা, বিভাগ, দপ্তর ও অধিদপ্তরকে একই ছাতার নিচে এনে একটি উন্নয়ন সমন্বয় সভা করতে চাইলেন। সম্ভবত দু’একবার হয়েছিলো, কিন্তু ফলপ্রসূ কিছু হলো না। আমাদের ভুল হলো কিনা বুঝতে পারছিনা। এমন সভা কি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বা মীর নাছিরের আমলেও হয়েছিলো? সন্দেহের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি।

অনেকের ধারণা সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকারের কথা মহিউদ্দিন চৌধুরীই প্রথম বলেছেন। অথবা ঢাকায় সাদেক হোসেন খোকা প্রথম বলেছিলেন। কোনটাই ঠিক নয়। নগর উন্নয়ন চিন্তায় নগর সরকারের কথা যাঁর মাথা থেকে বের হলো, তিনি হচ্ছেন জিয়া হোসাইন। তাঁরই ব্রেইন চাইল্ড। তিনি সেটা লন্ডন, আমেরিকার নগর প্রশাসন ব্যবস্থা স্টাডি করে পেয়েছিলেন।

এরশাদ আমলের প্রথম দিকে জাপানে নগর প্রশাসনের ওপর একটা সেমিনার হয়েছিলো। চট্টগ্রাম পৌরসভাকেও সেই সেমিনারে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। জিয়া হোসাইন সাহেব তখন সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী। পৌরসভার চেয়ারম্যান ফজল করিম সাহেব তাঁকে সেমিনারে পড়ার জন্য একটি পেপার তৈরি করতে বললেন। জিয়া হোসাইন সাহেব অনেক খেটে খুটে চট্টগ্রাম শহরের উদ্ভব ও বিকাশ এবং বিকাশের ধারায় চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ, সিডিএ’র প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা ইত্যাদির ওপর বিস্তারিত আলোচনা করে চট্টগ্রাম শহরের সমস্যাগুলি কি কি তা চিহ্নিত করে নগর সরকারের ধারণা উপস্থাপন করলেন। একটি পুস্তকের আকার পাওয়া সেমিনার পেপারটি তিনি ফজল করিম সাহেবকে জমা দিয়েছিলেন। তিনিই সেমিনারে পেপারটি নিয়ে যান। জিয়া হোসাইন সাহেবকে যেতে দেয়া হয়নি।

আশির দশকে ডিস্ট্রিক্ট মিনিস্টারের একটা কনসেপ্টও ছিলো। কনসেপ্ট নয়, বাস্তবেও চট্টগ্রামের মন্ত্রীদের মধ্য থেকে সিনিয়র কোন মন্ত্রীকে ডিস্ট্রিক্ট মিনিস্টারকে মর্যাদা দেয়া হতো। নব্বইয়ের দশকেও ডিস্ট্রিক্ট মিনিস্টার দেখেছি; তারপর ক্রমান্বয়ে হারিয়ে গেল ডিস্ট্রিক্ট মিনিস্টার। বিএনপির আমলে নোমান ভাই, আওয়ামী লীগের আমলে মান্নান ভাই ডিস্ট্রিক্ট মিনিস্টার ছিলেন। ডিস্ট্রিক্ট মিনিস্টার থাকলে সুবিধা হয় সরকারী কর্মকর্তাদের। জেলা প্রশাসনের কথা ধরি। জেলায় যখন কোন গুরুতর সমস্যা উপস্থিত হয়, তখন শাসক দলের নেতারা স্ব স্ব মতামত নিয়ে জেলা প্রশাসকের অফিসে ভিড় করতে থাকেন। কারো মতের সঙ্গে কারো মিল নেই, পরস্পরিরোধী এমনকি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মতামতও থাকে। ফলে ডিসি পড়েন বিপদে। কার কথা ঠিক, কার কথা বেঠিক, সেটা অনেক সময় বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না তাঁর পক্ষে। ডিস্ট্রিক্ট মিনিস্টার থাকলে তাঁর কাছ থেকেই চূড়ান্ত মত নিয়ে ডিসি কাজ করতে পারেন। এমনি বিপদে থাকেন বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি, কাস্টম কশিমনার, বন্দর চেয়ারম্যান, ডিআইজি, স্বাস্থ্য উপপরিচালক, উপাচার্য, শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান।

এখন চট্টগ্রামে মন্ত্রী আছেন তিনজনতথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এর মধ্যে উন্নয়ন সমন্বয় সভা আহবান এবং ডিস্ট্রিক্ট মিনিস্টারে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে ড. হাছান মাহমুদকে। কারণ তিনি একজন পেশাদার রাজনীতিক; অসুস্থ কাদের ভাইয়ের পাশাপাশি দল ও সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কেন্দ্রে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান; রাঙ্গুনিয়ার গর্বিত ভূমিপুত্র। কম করে হলেও সপ্তাহে একদিন চট্টগ্রামে আসেন। দু’দিন অবস্থান করে চট্টগ্রামবাসীর দুঃখ, দুর্দশার অংশিদারই হতে চান, তাঁদের নানা সমস্যা, অভাবঅভিযোগ সম্পর্কে অবগত হয়ে প্রতিনিধানের ব্যবস্থা করেন।

চট্টগ্রামের মানুষের বহুমুখী সমস্যা সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন সূত্র, মাধ্যম, চ্যানেল থেকে অবহিত হতে পারেন। আমি সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সুশীল সমাজের কিছু কথা তাঁর সমীপে নিবেদন করতে চাই। ডিস্ট্রিক্ট মিনিস্টার বা উন্নয়ন সমন্বয়ক নিযুক্ত করা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ নাই বা হলেন ডিস্ট্রিক্ট মিনিস্টার কিংবা উন্নয়ন সমন্বয় সভা আহবানের ক্ষমতার অধিকারী; কিন্তু তিনি যে একজন পূর্ণ মন্ত্রী, সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, এটা কে অস্বীকার করতে পারবে; তিনি সরকারী দল আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা, নীতিনির্ধারক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক। চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামবাসীর জন্য কাজ করার পক্ষে যথেষ্ট ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী তিনি। এতদসত্ত্বেও তিনি যে চট্টগ্রামের সাংবাদিক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী তথা সমগ্র সুশীল সমাজের সম্মান, স্বীকৃতি, নিয়োগ নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন না, এটা শুধু বিস্মরয়কর নয়, বেদনাদায়কও। তিনি করতে পারেন এমন কিছু বিষয়ের কথা এক এক করে বলি,

.বাসস পরিচালনা বোর্ডচট্টগ্রামের সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক কেন সদস্য থাকবেন না। শুধু ঢাকা থেকে লোক নিয়ে গঠন করলে সেটা জাতীয় বার্তা সংস্থা হয় কিভাবে ?

. বাসস’র প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকচট্টগ্রামের কোনো সাংবাদিক কেন কখনো বাসস’র চিফ এডিটর ও এমডি হলেন না? ডিপি বড়ুয়া হয়েছিলেন, কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে যান নি। তিনি সেখানেই ছিলেন। নুরুল ইসলাম সাহেব, মঈনুল আলম সাহেব কি হতে পারতেন না?

. প্রফেসর ড. অনুপম সেনকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে সম্মান করেন বলে জানি। সে কারণে তাঁকে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দান করেছিলেন। পরে তাঁকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদে নিযুক্ত করে অদ্যাবধি উক্ত দায়িত্বে নিয়োজিত রেখেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তিনি তাঁর যোগ্যতার উপযুক্ত স্বীকৃতি পান নি। স্বীকৃতি পেলে তাঁকে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচর্যের পদ নিয়ে চট্টগ্রামে পড়ে থাকতে হতো না। তিনি বর্তমানে দেশের একজন বিশিষ্ট বিদ্বান, পণ্ডিত ব্যক্তি। তাঁর যা বিদ্যাবত্তা, জ্ঞান, তাতে অনেক দিন আগেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ইউজিসির চেয়ারম্যান কিংবা জাতীয় অধ্যাপক পদে বৃত হতে পারতেন। কিন্তু তিনি কিছুই হতে পারেন নি। এটা কি তাঁর অযোগ্যতা, না তাঁর যোগ্যতা অনুধাবনে আমাদের ব্যর্থতা। তাঁর মতো মুক্ত চিন্তাবিদ, মননশীল বুদ্ধিজীবী সারাদেশ খুঁজেও দু’চারজন পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী অনুপম স্যার আপনারও শিক্ষক, কারণ আপনিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অনুপম স্যারকে কোন বিদেশি দূতাবাসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অথবা জাতীয় অধ্যাপক করা যায় কিনা সে ব্যাপারে আপনাকে কি ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করতে পারি। আপনি বিষয়টি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন এমনটা প্রত্যাশা করা কি অসঙ্গত হবে ?

. পিআইবি বা পিআইডি’র চিফ চট্টগ্রামের কোনো সাংবাদিক কখনো হননি। নুরুল ইসলাম, মঈনুল আলম, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, সাধন কুমার ধর, হাবিবুর রহমান খান হতে পারতেন।

. বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস, হাই কমিশনে প্রেস মিনিস্টার বা প্রেস অ্যাটাশে পদে সাংবাদিকদের মধ্য থেকে যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়, তারা সবাই ঢাকার। চট্টগ্রামে কর্মরত কোনো সাংবাদিকদের মধ্য থেকে যাদেরকে নিযোগ দেয়া হয়, তারা সবাই ঢাকার। চট্টগ্রামে কর্মরত কোনো সাংবাদিককে কখনো সে পদে নিয়োগ প্রদানের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়নি। কিন্তু চট্টগ্রামে যোগ্য সাংবাদিকের অভাব ছিলো না।

. রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী যখন রাষ্ট্রীয় সফরে দেশের বাইরে যান, তখন কিছু সাংবাদিককে তাদের সফরসঙ্গী হিসেবে নেয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম থেকে দু’একজন সাংবাদিক যে তাঁদের সফরসঙ্গী হননি, এমন নয়। কিন্তু মাননীয় রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর সফর ও তাঁদের সফরসঙ্গী সাংবাদিক দলের অনুপাতে চট্টগ্রাম থেকে গমনকারী সাংবাদিকের সংখ্যা নগণ্য।

আরো কিছু প্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগ আছে, যেখানে আগে সমাজসেবীদের প্রাধান্য ছিলো। এখন সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় রাজনৈতিক নিয়োগই প্রধান হয়ে উঠেছে। যেমন সিডিএ, ওয়াসা, জেলা পরিষদ ইত্যাদি।

মাননীয় তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কাঁধে অনেক কাজের বোঝা চাপিয়ে আমি বিদায় নিচ্ছি। তাঁর কাঁধ অনেক বড়, তিনি বহন করতে পারবেন বলেই আমাদের আবদারের বহর এত বেশি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তোমার পতাকা যারে দিয়েছ, তারে বহন করবার শক্তি দাও।

লেখক : সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের হাজার বছরের কৃষ্টি সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণে প্রস্তাবনা
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল