জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ : প্রাণের খোঁজে মহাকাশে

শঙ্কর প্রসাদ দে | মঙ্গলবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:৫৬ পূর্বাহ্ণ

গ্যালিলিও এর আবিষ্কৃত টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশে চোখ রেখে মানব জাতি বিষ্ময়ে হতবাক। দেখা গেল কোর্পানিকাসের কথাই সঠিক। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী, বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহষ্পতি, ইউরেনাস, নেপচুন ঘুরেই চলেছে। দেড় হাজার বছর ধরে মানুষ টলেমীর বক্তব্যকে সঠিক মনে করে আবর্তিত হয়েছে। টলেমি বলেছিলেন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য সহ সকল গ্রহ উপগ্রহ ঘুরে।
যাই হোক মানুষ সিদ্ধান্তে এল আমরা যে পৃথিবীতে জন্মেছি, সেটি সূর্য কেন্দ্রীক সৌর জগতের ঘুর্ণায়মান একটি গ্রহ মাত্র। চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ, সেটি পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে। জ্যোতির্বিদরা গ্যালিলিও’র টেলিস্কোপে চোখ রেখে সুবিধা করতে পারছিলেন না। পুকুরের জলের ভিতরে ক্যামেরা দিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ যেমন ঝাপসা দেখা যায় তেমিন পৃথিবীর উপরি-ভাগের গ্যাসীয় আস্তরণের জন্য মহাকাশকে ঠিক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। এবার প্রস্তাব এল টেলিস্কোপ পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করা গেলে ঝাপসা দেখার সমস্যা অনেকটাই চুকে যায়। যেমন ভাবনা তেমন কাজ।
২৪ এপ্রিল ১৯৯০, প্রেরিত হলো একটি আধুনিক টেলিস্কোপ, স্থাপন করা হল ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৫৫৯ কি:মি: উপরের কক্ষপথে। মার্কিন আইনজীবী ও জ্যোর্তিবিদ এডুউইন হাবলের নামে নামাকরণ করা হল হাবল টেলিস্কোপ। ছবি আসতে লাগল একেবারে ঝকঝকে তকতকে। ততোদিনে আবিষ্কৃত হয়ে গেছে ইনফারেট বা অবলোহিত রশ্মি (যতই এই রশ্মি দূরের পথ অতিক্রম করবে ততোই লাল আকার নেয়)। হাবল টেলিস্কোপে ধরা পড়া অবলোহিত রশ্মিকে অঙ্ক কষে দেখা গেল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে অর্থাৎ ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং বা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। আমাদের পৃথিবী বা সৌরজগৎ মিল্কিওয়ে নামক ছায়াপথের একটি অংশ মাত্র। ব্রহ্মাণ্ডে কত হাজার বা কত লাখ ছায়াপথ আছে তা এখনো অজানা রহস্য মাত্র। এবার প্রশ্ন এলো বিগ ব্যাং হওয়ার পর থেকে, কোন প্রক্রিয়ায় গ্রহ তারা নক্ষত্র বা ছায়াপথগুলো সৃষ্টি হলো। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোনো গ্রহে বা অন্য কোনো ছায়াপথের কোনো গ্রহে প্রাণ আছে কিনা, মানুষ আছে কিনা? মানুষের মতো উন্নত কোনো প্রজাতি আছে কি না? এই দু’টি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য চাই ব্রহ্মাণ্ডের বহু বহু দূরবর্তী ছায়াপথগলো পর্যবেক্ষণ। এমনিতে হাবল টেলিস্কোপের আয়ুষ্কাল ৩০ বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এর কিছু ফাংশন বন্ধ করে দিয়ে বিজ্ঞানীরা সেটিকে আবার চালু করে দিলেন। ধারণা করা হচ্ছে হাবল টেলিস্কোপ বড়জোর ২০২৫ সাল অবধি কর্মক্ষম থাকবে।
এ হিসেব মাথায় রেখে বিজ্ঞানীরা আরো একটি উন্নত টেলিস্কোপ প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হলেন। টাকার অভাব কখনোই হয়নি। কারণ উচ্চাভিলাষী এই প্রকল্পে নাসার সাথে যুক্ত হয় ইউরোপীয় স্পেস অর্গানাইজেশন ও কানাডীয় মহাকাশ সংস্থা। দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে এই অত্যাধুনিক টেলিস্কোপটি তৈরী করতে ঝরেছে কত ঘাম। কত বিনিদ্র রজনী পার করেছেন প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা তার হিসেব নেই। মোদ্দা হিসেব হল এই প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন এক হাজারের মতো বিশ্বের মেধাবী কর্মী। মহতী এই কর্মযজ্ঞে বাংলাদেশের একজনের নাম আছে। পিএইচডি থিসিস করেছেন নাসাতেই স্পেস টেকনলোজির উপর। ৫ বছর ধরে তিনি এই প্রকল্পে যুক্ত থেকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে ঢুকে গেলেন।
হাবল টেলিস্কোপের কাঁচের আয়তন ছিল ৬.৫ ফুট। বর্তমান টেলিস্কোপটি আয়তনে ৩ গুণ বড় অর্থাৎ ২১ ফুট। কিন্তু কর্মক্ষমতায় দিক থেকে হাবলের চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী। ২৫ ডিসেম্বর ২০২১ বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যে ৬.০০ টায় উৎক্ষেপিত হল। চন্দ্রাভিযানের এপোলো মিশন পরিচালক জেমস এর সম্মানার্থে বিষ্ময়কর এই দূরবীণের নাম রাখা হয়েছে, জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপ। ১৫ লক্ষ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এটি স্থাপিত হবে ‘এল-২’ কক্ষপথে। এজন্য এটি কর্মক্ষত হতে ২৯ দিন অপেক্ষা করতে হবে। অবারিত হবে ব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত জগৎ।
আমরা এখনো সৌরজগতের রহস্যও ভেদ করতে পারিনি। গ্যালাক্সি, গ্যালাক্সি ক্লাস্টার, প্যারালাল ব্রহ্মাণ্ড, ব্ল্যাক হোল, হোয়াইট হোল তো অনেক অনেক দূরবর্তী অজানা রহস্য ভাণ্ডার। এই সব মহাজাগতিক অবজেক্টের পরিচয় পেতে হলে কত নতুন নতুন তথ্য ও ফর্মূলার আর্বিভাব হবে তা শুধু কল্পনাই করা যায়। আইনস্টাইন মনে করতেন আলোর চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন কোনো বস্তুর অস্তিত্ব অসম্ভব। অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপ পদার্থ বিদ্যার এতোদিনকার বহু সূত্র পাল্টে দেবার সম্ভাবনা আছে। এমনকি আলোর চেয়ে দ্রুতগতির কোনো বস্তু আবিষ্কৃত হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
সে যাই হোক, গোটা পৃথিবীর বিজ্ঞানজগৎ মুখিয়ে আছে জেমস ওয়েভ কেমন তথ্য পাঠায় তা দেখার জন্য। অবলোহিত বা ইনফারেট রশ্মির উৎসের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে জেমস ওয়েভের দৃষ্টি যদি ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগের বিগ ব্যাং পরবর্তী মূহূর্ত্বগুলো ধরে ফেলতে পারে- তবে সত্যি সত্যি সৃষ্টি রহস্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে মানব সভ্যতা। বিজ্ঞানীদের ধারণা বিগ ব্যাং পরবর্তী মুহূর্তগুলোর অনেক গ্রহণযোগ্য উত্তর পাওয়া যাবেই। তবে ব্রহ্মাণ্ডের অন্যত্র প্রাণের অস্বিত্ব আছে কিনা- প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে লেগে যেতে পারে আরো বহু সময়। জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ৫ থেকে ১০ বছর। সুতরাং ধরে নেয়া যায় জেমসের জীবৎকালে প্রাণের সন্ধ্যান নাও মিলতে পারে। তবে টেলিস্কোপটি এমন সব নতুন অনেক তথ্য হাজির করার সম্ভাবনা আছে যা মানবজাতিকে এক লাফে এগিয়ে নেবে কয়েকশ বছর। যেমনটি নিয়েছিল গ্যালিলিও’র দূরবীণ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগৌরবের ৭৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ছাত্রলীগ
পরবর্তী নিবন্ধতালেবান-বর্ষকাঁপানো বিস্ময় : পাকিস্তান ফাটা বাঁশের চিপায়