জেন্ডারভিত্তিক শ্রমবিভাজন এবং কর্মজীবী নারী

কোভিড ১৯

তানিয়াহ্‌ মাহমুদা তিন্নি | শনিবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

বিগত শতাব্দী থেকে আয়মূলক কাজের সাথে নারীর সম্পৃক্ততা শুরু হয়। ধারণা করা হয়েছিল আয়মূলক কাজে নারীর অংশগ্রহণ বহুবছর ধরে চর্চিত ‘জেন্ডারড স্পেস’ অর্থাৎ লিঙ্গভিত্তিক স্থান এবং ‘জেন্ডার রোল’ অর্থাৎ লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা থেকে সমাজগুলোকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করবে। আরও সহজ করে বললে নারীর স্থান ঘরে এবং পুরুষের স্থান বাইরে এই চিন্তাকাঠামোতে ভাঙ্গন ধরবে। কাজের সাথে নারীর সম্পৃক্ততা একদিকে যেমন নারীকে উপার্জন করতে সাহায্য করবে, পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা শক্তিশালী করবে অন্যদিকে পুরুষকেও গৃহকাজে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ ন্যায্যতাভিত্তিক শ্রমবিভাজনকে উৎসাহিত করবে। গবেষকরা এই মডেলকে ‘এডাপ্টিভ পার্টনারশীপ’ মডেল বলে চিহ্নিত করেন। উদারনৈতিক নারিবাদীরাও এই মডেলকে সমর্থন দেন। তাদের মতে, নারীদের শিক্ষার সুযোগ এবং কর্মক্ষেত্রে যোগদান নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সমকালীন তথ্য উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাব কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, যে হারে নারীর আয়মূলক কাজে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে একই হারে পুরুষের গৃহকাজে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে কী? গবেষকরা বলছেন, পায়নি। যেহেতু গৃহকাজে ন্যায্যতাভিত্তিক শ্রমবিভাজন এখনও বেশিরভাগ সমাজেই স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি সেহেতু কর্মজীবী নারীদের অফিসের কাজ শেষ করে এসেও বাড়িতে দ্বিতীয় শিফটে কাজ করতে হয়। যাকে সমাজতাত্ত্বিকরা ‘ডাবল বারডেন’ বা দ্বিগুণ কাজের বোঝা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বেশিরভাগ কর্মজীবী নারীরাই ঘর এবং বাইরের কাজে ভারসাম্য আনতে হিমশিম খান। ফলে একদিকে তাদের শুনতে হয়, কর্মজীবী নারীরা ভাল গৃহিণী নয়, ভাল মা নয়। অন্যদিকে শুনতে হয়, কর্মক্ষেত্রে পুরুষরা নারীদের তুলনায় বেশি দক্ষ। এই সমালোচনাগুলো থেকে রক্ষা পেতে কর্মজীবী নারীরা কাজের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেন। দু’দিকের কাজ নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করতে থাকেন । যা একইসাথে তাদের শারিরীক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ পৃথিবীজুড়ে অফিসের কাজের ধরণে বড়সড় পরিবর্তন এনেছে। যেহেতু শারীরিক সংস্পর্শ কিংবা কাছাকাছি অবস্থানে এই ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভবনা থাকে সেহেতু স্বাস্থ্যবিদরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে উৎসাহিত করছেন। ফলে অফিস কতৃপক্ষ ‘ঘরে বসে অফিসের কাজ’ পরিচালনা করতে নির্দেশ দিচ্ছেন তাদের কর্মচারীদের। অনেকেরই ধারণা ঘরে বসে কাজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের চাপ কমিয়েছে। বিশেষত কর্মজীবী নারীদের অফিস এবং ঘরের কাজে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করছে। করোনা মহামারির পূর্বে কর্মজীবী নারীদের নিয়ে যে গবেষণাধর্মী কাজগুলো হয়েছে সেগুলোতেও উঠে এসেছে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, নমনীয় কর্মঘন্টা কিংবা ঘরে বসে অফিসের কাজ নারীর কাজের চাপ কমাতে পারে। এখন যখন করোনায় সত্যি সত্যি ঘরে বসে কাজের বাস্তবতার অভিজ্ঞতা হচ্ছে তখন নারীর কাজের চাপ কী আসলেই কমেছে?
করোনা মহামারির পূর্বে সারা বিশ্বে প্রতিদিন অবৈতনিক গৃহস্থালির কাজের তিন-চতুর্থাংশই করতে হত নারীদের। করোনাকালীন সময়ে গৃহস্থালির কাজের পরিমাণ আরও বেড়েছে। ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে জীবাণু ধ্বংস, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ইত্যাদির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। জেন্ডারের উপর ভিত্তি করে শ্রমবিভাজনে এই কাজগুলো নারীদের উপরেই বর্তায়। ফলে কর্মজীবী নারীরা যতই ঘরে বসে কাজ করুক না কেন, অফিসের কাজ, গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজ এবং করোনাকালীন সময়ে উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতি সব মিলিয়ে তাদের কাজ কমে নি। করোনাপূর্ব সময়ে অনেক কর্মজীবীই নির্ভর করতেন গৃহকর্মীদের উপর। করোনাকালীন গৃহকর্মী সম্পর্কিত সামাজিক স্টিগমা, যেমন- গৃহকর্মীরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়, তারা একসাথে অনেক বাড়িতে কাজ করে ফলে তাদের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের সুযোগ বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লকডাউন, পরিবহণসেবা বন্ধ থাকার ফলে গৃহকর্মীদের অপ্রতুলতাও কর্মজীবী নারীদের কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির জরিপে উঠে এসেছে মহামারিকালীন সময়ে নারীরা সন্তান লালনপালন এবং বাড়িতে তাদের শিক্ষা সহয়তায় পুরুষের তুলনায় বেশি সময় দিচ্ছে। যারা একইসাথে কর্মজীবী এবং মা তাদের উপর করোনার প্রভাব আরও বেশি করে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর প্রকাশিত ম্যাককিনসের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যেসব মা-দের ১০ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে তারা পুরুষসঙ্গীর তুলনায় ৫ ঘন্টা বেশি কাজ করছেন। ফলে কাজ ‘দ্বিগুণেরও দ্বিগুণ’ বেড়েছে।
সমাজতত্ত্বের শিক্ষানবীশ এবং নিজে একজন শিক্ষক হওয়ায় আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নারী শিক্ষক এবং একাডেমিশিয়ানরা। সহকর্মীদের সাথে কথা বলে এবং নিজে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, শিক্ষকদের অনলাইন শিক্ষাকে শিক্ষার্থী বান্ধব করতে পাওয়ার পয়েন্ট, অডিও ভিডিও তৈরি, নতুন নতুন এপ্লিকেশনের ব্যবহার শেখা, নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ ইত্যাদিতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। যা ক্লাসরুমে পাঠদানের থেকেও জটিল। আবার পরিবারের সেবা প্রদানকারী হিসেবে একইসাথে তাদের প্রফেশনাল দায়িত্ব এবং গৃহিণীর দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে যেখানে দুটো কাজকে আলাদা করার উপায় নেই। ফলে দুটো কাজই কোন না কোনভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একাডেমিশিয়ানদের কাজ শুধু শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত থাকা নয় বরং গবেষণামূলক কাজও করা। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম এবং গৃহকর্ম এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির অতিরিক্ত কাজ সামলে গবেষণায় সময় দেয়া নারীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। সায়েন্স নিউজে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ২০১৯ এবং ২০২০ সালের মার্চ এবং এপ্রিল মাসে একই জার্নালে প্রকাশিত ১৮৯৩ টি প্রবন্ধের তুলনা করে বলা হয় ২০২০ সালে প্রথম লেখক হিসেবে নারী একাডেমিশিয়ানদের সংখ্যা ২৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি প্রতিবেদনেও একইরকম চিত্র দেখা গেছে।
জেন্ডার ভূমিকার কারণে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ যেমন- গৃহস্থালির কর্ম, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দিবাযত্ন কেন্দ্র বয়স্কসেবাদান কেন্দ্র ইত্যাদিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি এবং এই কাজগুলো ঘরে বসেও করা সম্ভব নয়। ফলে নারীই বেশি কর্ম হারিয়েছে। গত জুনে তৈরি বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার করা একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় বিশ্বে ৭২.৩% গৃহকর্মীর উপর করোনা প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশেও রিকশাচালকদের পর পরই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ গৃহকর্মীরা। সারাবিশ্বে মহামারীকালীন সময়ে পুরুষের তুলনায় ১.৮ গুণ বেশি নারী কর্ম হারিয়েছেন। এই প্রবণতাকে সমাজ গবেষক নিকোলো ম্যাসন ‘ঝযবপবংংরড়হ’ হিসেবে অভিহিত করছেন যেখানে নারীই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে। ফলে বিগত কয়েক দশকে নারীর অগ্রগতি, অর্থনৈতিক মুক্তি অনেকটাই পিছিয়ে পড়ল সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়।
সেবামূলক কাজকে জেন্ডার নিরপেক্ষ করতে না পারলে একদিকে যেমন ন্যায্যতাভিত্তিক শ্রমবিভাজন সম্ভব নয়। অন্যদিকে সংকটকালীন মুহূর্তে নারীকেই এর জের টানতে হয় যা করোনা মহামারী আরও একবার প্রমাণ করল।

লেখক: শিক্ষক, সমাজতত্ত্ব ও টেকসই উন্নয়ন বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধচকরিয়া পৌরসভা নির্বাচন হবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ
পরবর্তী নিবন্ধআফগান নারী