জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাএলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২২ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে ই’তিকাফের গুরুত্ব ও মাসায়েল

পবিত্র কুরআনের আলোকে ইতিকাফের গুরুত্ব:
ইতিকাফের গুরুত্ব ও ইতিকাফকারীদের মর্যাদা পবিত্র কুরআনের আলোকে প্রমাণিত। একাগ্রতার সাথে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সাধনার নাম ইতিকাফ। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলের নিকট অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী ও ইতিকাফকারী এবং রুকু সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ। (সূরা: বাকারা, ২:১২৫)
ইতিকাফ পালনকারীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পার্থিব জীবন থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে মসজিদে অবস্থান করতে হয়। আল্লাহ তা’আলা ইতিকাফ প্রসঙ্গে আরো এরশাদ করেছেন, তোমরা মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় তাদের সাথে (স্ত্রীদের) সহবাস করোনা। (সূরা: বাকারা, ২:১৮৭)
হাদীস শরীফের আলোকে ই’তিকাফ: ইসলামী জীবন বিধানের দ্বিতীয় উৎস পবিত্র হাদীস শরীফের অসংখ্য বর্ণনায় ইতিকাফের ফযীলত ও ইতিকাফ পালনকারীর করনীয় সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি হাদীস শরীফ উপস্থাপন করা হলো, “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ই’তিকাফ পালন করতেন। (বুখারী শরীফ, হাদিস: ২০২৫, মুসলিম শরীফ: ১১৭১)
নবীকরিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিনী হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এ নিয়মই ছিল এর পর তাঁর সহধর্মিনীগনও ইতিকাফ করতেন। (বুখারী শরীফ, হাদীস ২০২৬, মসলিম, হাদীস: ১১৭২)
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন কিন্তু যে বছর তিনি ওফাত বরন করেছেন সে বছর বিশদিন ইতিকাফ করেছেন। (বুখারী শরীফ)
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশক আগমন করলে সাড়া রাত জেগে থাকতেন। নিজের পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে রাখতেন। কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং উম্মুল মু’মিনীনগন থেকে দূরে থাকতেন। (মুসলিম শরীফ)
ইতিকাফ অর্থ : ইতিকাফ শব্দটি আরবি “আকফুন” শব্দ থেকে নির্গত, এর অর্থ অবস্থান করা। শরয়ী পরিভাষায় আল্লাহর রেজামন্দি অর্জনের লক্ষ্যে রোযা রেখে নিয়ত সহকারে পুরুষ মসজিদে অবস্থান করা। মহিলা নিজ ঘরে নামাযের স্থানে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলা হয়।
ইতিকাফের হিকমত: অন্তরকে পার্থিব জীবনের ঝামেলা থেকে মুক্ত করে নিভৃতে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে নিজেকে নিয়োজিত রাখার এক উৎকৃষ্ট আমলের নাম ইতিকাফ। ইতিকাফ কালীন অধিক ইবাদত যিকির আযকার তিলাওয়াত ও দুআ দরুদ পাঠে লিপ্ত থাকার কারণে বান্দা বহু ধরণের গুনাহ ও পাপাচার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হন। নিজকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করার কারনে বান্দা আল্লাহর নিকট সম্মানিত ও মর্যাদা মন্ডিত হয়। (বাদায়েউস সানায়ে, ২য় খন্ড, বাহরুর রায়েক, ২য় খন্ড)
ইতিকাফের প্রকারভেদ ও বিধান: শরয়ী মাসআলা: ইতিকাফ তিন প্রকার। ১. ওয়াজিব ইতিকাফ, যেমন কেউ মান্নত করল আমার উদ্দেশ্য পূরণ হলে আল্লাহর ওয়াস্তে আমি ইতিকাফ পালন করব। মান্নতের কথা মুখে বলবে তখন ইতিকাফ ওয়াজিব হবে। মান্নতের ইতিকাফ সহীহ হওয়ার জন্য রোজা রাখা শর্ত।
২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া, রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ পালন করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। মহল্লার একজন পালন করলে সকলে দায়মূক্ত হবে। অন্যথায় সকলেই গুণাহগার হবে। ইতিকাফকারী ব্যক্তি বিশ রমজান সূর্যাস্তের পূর্বে ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করবে। ত্রিশে রমজান সূর্যাস্তের পর বা উনত্রিশ তারিখ চাঁদ দেখার পর মসজিদ থেকে বের হবে। সুন্নাত ইতিকাফের জন্য রোযা রাখা শর্ত। (দুররুল মোকতার, আলমগীরি বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৮১)
৩.নফল ইতিকাফ, ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করে যতক্ষণ মসজিদে অবস্থান করবে ইতিকাফ হিসেবে গন্য হবে। এর জন্য রোযা শর্ত নয়। নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণও শর্ত নয়। মসজিদ থেকে বের হলেই ইতিকাফ শেষ হয়ে যাবে। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৮২)
ইতিকাফের মান্নত সংক্রান্ত মাসআলা: ১. কোন ব্যক্তি এক মাসের ইতিকাফের মান্নত করল এবং মারা গেল তাহলে প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে ফিতরা পরিমান সাদকা মিসকীনকে দান করবে। এ ব্যাপারে ওয়ারিশদেরকে ওসীয়ত করে যাওয়া ওয়াজিব। ওসীয়ত না করে থাকলে ওয়ারিশগন তার পক্ষ থেকে ফিদয়া দিলে সেটাও জায়েজ হবে।
২. অসুস্থ ব্যক্তি ইতিকাফের মান্নত করল একদিনের জন্য হলেও সুস্থ হয়ে মারা গেল, তাহলে প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে সাদকায়ে ফিতর পরিমাণ দান করতে হবে। আর একদিনের জন্য হলেও সুস্থ না হলে কিন্তু ওয়াজিব হবে না। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড)
ইতিকাফের কাযা সংক্রান্ত মাসআলা: ১. কেবল ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিকাফ ভঙ্গ করলে কাযা ওয়াজিব নয় বরং যদি কোন ওজরের কারণেও ইতিকাফ ছেড়ে দেয়া হয় যেমন অসুস্থ হয়ে পড়লো অথবা অনিচ্ছাকৃত ছেড়ে দিল যেমন মহিলার মাসিক ঋতুস্রাব হল, অথবা দীর্ঘ পাগলামী বা সংজ্ঞহীনতা সৃষ্টি হল ওসব অবস্থায়ও কাযা ওয়াজিব।
২. মান্নতের ইতিকাফ ভঙ্গ করলো যদি কোন নিদ্দিষ্ট মাসের মান্নত হয়ে থাকে তাহলে অবশিষ্ট দিন সমূহের কাযা দিবে। (রদ্দুল মোখতার)
৩. নফল ইতিকাফ ছেড়ে দিলে সেটার কাযা নেই।
৪. রমজানের শেষ দশকের সুন্নাত ইতিকাফের যে দিনটির ইতিকাফ ভঙ্গ করেছে কেবল সেদিনটির ইতিকাফ কাযা করবে, দশ দিনের কাযা করা ওয়াজিব নহে। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরায়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৮৯)
মাসআলা: ইতিকাফ আবস্থায় যদি কারো স্বপ্নদোষ হয় এর দ্বারা ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না। (আলমগীরি ১ম খন্ড)
ইতিকাফ অবস্থায় যদি কোন মহিলার মাসিক এসে যায় তার ইতিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে। পরবর্তীতে কাযা দিতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ২য় খন্ড)
ইতিফাক অবস্থায় কথা না বলা বা চুপ থাকা প্রসঙ্গ: ইতিকাফ পালনকারী যদি ইবাদতের নীয়তে চুপ থাকে কথা না বলে নিরব থাকাকে যদি সওয়াব মনে করে তাহলে মাকরূহ তাহরীমি হবে। তবে গুনাহ জনিত কথা পরিহার করা ওয়াজিব। (আলমগীরি, ১ম খন্ড)
নিবর থাকাটা সওয়াব মনে করে না হলে ক্ষতি নেই। যে কথায় সওয়াব ও হবে না গুনাহও হবেনা অর্থাৎ মুবাহ কথা বলা ইতিকাফ পালন কারীর জন্য মাকরূহ। অপ্রয়োজনে মসজিদে মুবাহ কথা বললে সওয়াব সমূহ এমনভাবে ভক্ষণ করে যেমন আগুণ লাকড়ীকে (দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড)
ইতিকাফ অবস্থায় করণীয়: ইতিকাফ অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত, হাদীস শরীফ পাঠ, অধিকহারে দরুদ শরীফ পাঠ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য নবী আলাইহিমুস সালাম এর জীবনী গ্রন্থ পাঠ করবে। যিকর আযকার তাসবীহ তাহলীল পাঠে মশগুল থাকা, আউলিয়ায়ে কেরামের জীবনী পাঠ করা ও শরয়ী মাসআলা মাসায়েল জানা ও চর্চা করার মধ্যে সওয়াব রয়েছে। (দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত ৫ম খন্ড, আলমীরি ১ম খন্ড)
ইতিকাফের জন্য উত্তম স্থান: ইতিকাফের শ্রেষ্ঠ স্থান হলো ১. মসজিদুল হারাম, ২. মসজিদে নববী শরীফ, ৩. বায়তুল মুকাদ্দাস শরীফ, ৪. জামে মসজিদ, ৫. যে মসজিদে মুসল্লী সংখ্যা বেশী হয়। ইতিকাফকারীদের জন্য জুমা মসজিদ হওয়া শর্ত নয়। প্রত্যেক মসজিদে ইতিকাফ সহীহ যদিও সেটা জামাত বিশিষ্ট মসজিদ না হয়। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত)
হে আল্লাহ আমাদের সালাত, সিয়ম, কিয়াম, ইতিকাফ ও নেক আমল সমূহ কবুল করুন। আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইতিকাফ পালন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম, খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
কলসী দিঘীর পাড়, বন্দর, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: মৃত ব্যক্তির নামায রোযার কাফফারা সম্পর্কে ইসলমী সমাধান জানালে উপকৃত হব।
উত্তর: কোন পুরুষ বা মহিলার দায়িত্বে নামায রোযা অনাদায়ী থাকলে মৃত্যু আসন্ন অবস্থাতে অনাদায়ী নামায রোযার পরিবর্তে কাফফারা আদায় করার জন্য নিজ উত্তরাধিকার ওয়ারিশদেরকে ওসীয়ত করে যাওয়া ওয়াজিব। ওয়ারিশগন মরহুম বা মরহুমার পরিত্যক্ত সম্পদের এক তৃতীয়াংশ হতে মৃত ব্যক্তির কাযা নামায ও কাযা রোযার কাফফারা প্রদান করবে। (আলমগীরি ১ম খন্ড), মৃত ব্যক্তি কতদিন নামায পড়তে পারেনি তার হিসাব বের করুন। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ, ওয়াজিব ও বিতরসহ দিনে ছয় ওয়াক্ত নামায হিসেব করুন। প্রতি ওয়াক্ত নামাযের জন্য একটি ফিতরা পরিমান সর্বসাকূল্যে ৭৫ টাকা ৭৫+৬=৪৫০/- আদায় করুন। এভাবে প্রত্যেক দিনের রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে দুবেলা পেটভরে আহার করাবে। বা সমপরিমান অর্থ মিসকীনকে প্রদান করবে। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৬৫)
মৃত ব্যক্তি যদি ওসীয়ত নাও করে যান কিন্তু সম্পদ রেখে যান তখন ওয়ারিশগন মৃত ব্যক্তির কাযা নামায ও কাযা রোযার ফিদিয়া আদায় করা উত্তম ও মৃত ব্যক্তির জন্য খুবই ফলপ্রসু উপকারী। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড)
যারা অতিশয় বৃদ্ধ অসুস্থ ভবিষ্যতেও রোযা রাখার সামর্থ আশা করা যায়না তাদের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের মহত্তম আয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে