শাওয়াল মাসে নফল রোযার ফযীলত
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা:
আল্লাহতা’আলাকে ভয় করুন! তাঁরই ইবাদত করুন। নামায রোযা, হজ্ব, যাকাত, ফরজ ইবাদত। যা সুনির্দিষ্ট বিধান ও শর্তাবলীর আলোকে মুসলিম নরনারীর উপর অপরিহার্য। পবিত্র কুরআনের বিরাশি আয়াতে নামাযের নির্দেশ করেছেন, ফরজ নামায পরিত্যাগ বা বর্জন করার কোন সুযোগ নেই। ফরজ ইবাদত বর্জন করা কবীরা গুনাহ। যে কারণে বান্দাকে অনন্তকাল জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। এভাবে একমাসব্যাপী সিয়াম সাধনা করা ফরজ। এ কারণে কেউ যদি বিনা প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃত রমজানের একটি রোযা ভঙ্গ করে একটি রোযার পরিবর্তে একটি কাযা রোযা ও ষাটটি একাধারে কাফফারার রোযা আদায় করতে হবে। মাঝখানে ফাঁক দিতে পারবেনা। কোন কারণে মাঝখানে বাদ দিলে পুনরায় ষাটটি রোযা নতুন করে একাধারে আদায় করতে হবে। (রদ্দুল মুখতার, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, কিতাবুল ফিকহ আলাল মাযাহিবিল আরবাআ)
নফল নামায, নফল রোযা, বান্দার জন্য ঐচ্ছিক ইবাদত। নফল ইবাদত যত বেশী হবে বান্দা ততবেশী আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হবে। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, নফল ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা আমার নিকটবর্তী হতে থাকে। (বোখারী শরীফ)
রোযা ছয় প্রকার:
ইসলামী শরীয়তে কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুজতাহিদ ফকীহগণের বর্ণনা মতে রোযা ছয় প্রকার। ১. ফরজ, ২. ওয়াজিব, ৩. সুন্নাত, ৪. নফল, ৫. মাকরূহ, ৬. হারাম। ১. মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতের বর্ণনামতে পবিত্র রমজানে পূর্ণ একমাস রোযা রাখা ফরজ। ২. মান্নতের রোযা ও কাফফারার রোযা পালন করা ওয়াজিব। ৩. মহররম মাসের আশুরার ৯ ও ১০ তারিখের ২টি রোযা রাখা সুন্নাত। আরাফা দিবসের জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখের রোযা রাখা সুন্নাত, শাওয়াল চাঁদের ৬ রোযা সুন্নাত। প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখের রোযা সুন্নাত। ৪. নফল রোযা, যেমন শাবানের ১৫ তারিখ শবে বরাতের রোযা, ২৭ রজব শবে মিরাজের রোযা রাখা নফল। ৫.মাকরূহ, স্বামীর বিনা অনুমতিতে নফল রোযা রাখা মাকরূহ, আশুরার একটি রোজা রাখা। এভাবে শুধুমাত্র জুমাবার দিবসে রোযা রাখা মাকরূহ, তবে নির্দিষ্ট কোন তারিখের রোযা যেমন ১৫ শাবান শবে বরাতের রোযা, ২৭ রজব শবে মেরাজের রোযা ইত্যাদি যদি জুমাবারে এসে যায় তাহলে ঐদিন রোযা রাখা মাকরূহ নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন “জুমার দিন তোমাদের জন্য ঈদের দিন, সুতরাং তোমরা ঐ দিন রোযা রেখোনা এর আগের দিন বা পরের দিন রোযা রাখো। (আত্তারগীব ওয়াত তারহীব ২য় খন্ড, পৃ: ৮১, হাদীস ১১)
৬. হারাম রোযা: ইসলামী শরীয়তে নির্দিষ্ট কতগুলো দিনে রোযা রাখা হারাম, যেমন ঈদুল ফিতরের দিন, ঈদুল আযহার দিন, আইয়্যামে তাশরীক তথা জিলহজ্ব মাসে ১১,১২,১৩ তারিখে রোযা রাখা হারাম। (ফাতওয়া-এ রিজভীয়্যাহ, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড)
শাওয়ালের ছয় রোযার ফযীলত:
ঈদুল ফিতরের মাস পবিত্র শাওয়ালের গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনের প্রত্যয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার ঈমানী চেতনা, রমজানের অর্জিত তাকওয়া ও শিক্ষাকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান পরবর্তী শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযার বিধান দিয়ে আমাদেরকে আত্মশুদ্ধি ও খোদাভীতি অর্জনের পথ সুগম করে দিয়েছেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখবে সে সারা বছর রোযা রাখার সওয়াব লাভ করবে।” (মুসলিম শরীফ)
ইমাম নাসাঈ ইবনে মাযাহ ইবনে খোজায়মা ইবনে হিব্বান প্রমুখ হযরত সওবান (রা.) থেকে ইমাম আহমদ, ইমাম তাবরানী (রা.) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ঈদুল ফিতরের পর শাওয়ালে ছয় রোযা রাখল সে পূর্ণ বছরের রোযা রাখলো যে একটি নেক কাজ করল সে বিনিময়ে দশটি প্রতিদান পাবে। রমজান মাসের রোযা দশ মাসের সমান এবং শাওয়ালের ছয়দিনের ছয় রোজা দুই মাসের সমান পূর্ণ এক বৎসরের রোযা হয়ে গেল। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৭০)
মাসআলা: ছয় রোযার জন্য কোন দিন নির্দিষ্ট করা নেই। মাসের যে কোন সময় রাখা জায়েজ। উত্তম হলো ছয় রোযা পৃথকভাবে রাখবে। ঈদের পর লাগাতার ছয়দিন এক সাথে রাখলেও কোন ক্ষতি নেই। (বাহারে শরীয়ত)
মাসআলা: শ্রমিক বা কর্মচারী নফল রোযা রাখার কারণে কাজ যদি পূর্ণভাবে করতে না পারে সে ক্ষেত্রে রোযা রাখার ব্যাপারে মালিকের অনুমতি নিতে হবে। আর যদি রোযা রেখে কাজ পূর্ণরূপে করতে পারে সেক্ষেত্রে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৬৭)
মাসআলা: নফল রোযা শুরু করার দ্বারা আবশ্যক হয়ে যায়। যদি ভঙ্গ করে কাযা দেওয়া ওয়াজিব হবে। (দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৬৬)
মাসআলা: মাতা-পিতা যদি নিজ সন্তান-সন্ততিকে রোগ ব্যাধির ভয়ের কারণে নফল রোযা রাখতে নিষেধ করে সেক্ষেত্রে মাতা-পিতার কথা মেনে নিবে। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত)
মহররম মাসের নবম ও দশম তারিখ রোজা রাখা উত্তম:
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রমজান মাসের পর সর্বোত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মহররম মাসের রোযা। ফরজ নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হল রাতের নামায তথা তাহাজ্জুদের নামায। (মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড, পৃ: ৩৮৮৮, হাদীস নং: ১১৬৩, বাহারে শরীয়ত ৫ম খন্ড, পৃ: ১৬৮)
“প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার রোযা রাখেন এবং রাখার আদেশ করেন সাহাবারা বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা এমন একটি দিন যে দিনকে ইয়াহুদী, খৃষ্টানরা সম্মান করে রোযা পালন করে তদুত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি নবম তারিখও রোযা রাখবো।” (মুসলিম শরীফ, ১ম খন্ড, হাদীস নং: ১১৬৪)
এ রোযার ফযীলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে নবীজি এরশাদ করলেন, আল্লাহর কাছে আশা করি তিনি বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (মুসলিম শরীফ)
মহররম মাসে দু’টি রোযা রেখে ইয়াহুদীদের বিরোধিতা করা:
ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম বিজাতীয় সভ্যতা ও আদর্শ অনুকরণে মুসলমানদের কোন কল্যাণ নেই। মুসলমানদের রয়েছে স্বতন্ত্র আদর্শ পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক আদর্শ সংস্কৃতি অনুসরণ ও প্রতিপালনে রয়েছে মুসলমানদের কল্যাণ ও গৌরবময় ঐতিহ্য। ইয়াহুদীরা যেহেতু দশম তারিখে রোযা পালন করে তাই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিজাতীয় সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ইসলামের আদর্শিক ভিন্নতা উপহার দিয়ে ইসলামের সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বিকশিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা নবম ও দশম তারিখে রোযা পালন করো এবং ইয়াহুদীদের বিপরীত করো। (তিরমিযী শরীফ, ১ম খন্ড, হাদীস নং: ৭৫৫)
সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোযা:
সুনানে তিরমিযী শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সোমবার ও বৃহস্পতিবারে বিশ্ব জাহানের প্রতিপালকের দরবারে আমল সমূহ পেশ করা হয়। আমি পছন্দ করি আমার আমল যেন এমন সময় পেশ করা হয় যখন আমি রোযাদার হই। অনুরূপ হাদীস হযরত উসামা ইবনে যায়েদ, জাবের (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সোমবার দিবসে রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে তদুত্তরে নবীজি এরশাদ করেন, এদিনেই আমি জন্মগ্রহণ করেছি এ দিনে নবুওয়াত পেয়েছি, এদিনে আমার উপর কুরআন মজীদ অবতীর্ণ হয়েছে। (সহীহ মুসলিম শরীফ, ২/৮১৯)
হে আল্লাহ আমাদের কে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমাদের নামায, রোযা, দান-সাদকাসহ নেক আমলগুলো কবুল করুন। পবিত্র কুরআনের হেদায়ত ও বরকত নসীব করুন। নিশ্চয় আপনি মহান দানশীল রাজাধিরাজ, পুনবান, অতি দয়ালু ও পরম করুণাময়। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
[ইসলাম সম্পর্কিত পাঠকের প্রশ্নাবলি ও নানা জিজ্ঞাসার জবাব দিচ্ছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি। আগ্রহীদের বিভাগের নাম উল্লেখ করে নিচের ইমেলে প্রশ্ন পাঠাতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
Email : azadieditorial@gmail.com]
তাওহীদুল ইসলাম নূরী
শাহারবিল সদর, চকরিয়া, কক্সবাজার।
প্রশ্ন: মালিকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আংশিক জায়গা দখল করে নির্মিত মসজিদে (সীমানা বিরোধ সম্পর্কিত) নামায পড়া কি জায়েজ হবে।
উত্তর: জবর দখলকৃত বা ছিনতাইকৃত জায়গায় নির্মিত মসজিদে নামায পড়া মাকরুহ। (বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ:২৭০), এমনকি সীমানা বিরোধ সংক্রান্ত জটিলতা নিষ্পত্তি না করে মসজিদের জন্য ওয়াক্ফ করলেও ওয়াকফ সহীহ হবে না। (ফাতহুল কদীর, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ: ২১৫), ইসলামী আইনজ্ঞ ফকীহগন বলেন, কারো সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল করে এতে মসজিদ, মাদরাসা নির্মাণ করা জায়েজ হবে না। (আলমগীরি, ২য় খন্ড)
জমির মালিকের অনুমতি ছাড়া নির্মিত মসজিদে নামায পড়া মাকরুহ হবে। (ফাতওয়া আলমগীরি, ২য় খন্ড, পৃ: ৩৪৮), মসজিদ নির্মাণের জন্য ওয়াকফ হওয়া জরুরি। (দুররুল মুখতার, ১ম খন্ড, পৃ: ৩৮১)
রিফাত চৌধুরী
জামাল খান, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: কুরআন মাজীদ চুম্বন করা বা চুমু খাওয়া জায়েজ কিনা?
উত্তর: পবিত্র কুরআন আল্লাহর কালাম। আল্লাহর কিতাবের প্রতি তাজিম ও সম্মান করা ঈমানের পরিচায়ক। ভক্তি, শ্রদ্ধা, তাজিমের উদ্দ্যেশ্যে কুরআনুল করীমে চুমু দেয়া জায়েজ ও শরীয়ত সম্মত। সাহাবায়ে কেরাম ভক্তি, শ্রদ্ধার নিয়্যতে কুরআন মাজীদ চুমু দিতেন মর্মে হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হযরত ইকরামা (রা.) কু্রআন মাজীদ চেহারায় লাগাতেন ও চুমু দিতেন। (সুনানে দারিমি, হাদীস নং: ৩৩৫৩, দুররুল মুখতার ৬/৩৮৪), এভাবে হযরত ওমর (রা.) প্রতিদিন সকালে কুরআন মাজীদ চুমু দিতেন। হযরত ওসমান জিন্নুরাইন (রা.) ও কুরআন মাজীদ চুমু দিতেন এবং চেহারায় লাগাতেন। (দুররুল মুখতার, বাহারে শরীয়ত, ৬ষ্ঠ দশ খন্ড, পৃ: ৮৫)










