পবিত্র কুরআনের আলোকে ক্বাবা শরীফের মর্যাদা: বিশ্ব মুসলিমের ঈমান, ইসলাম ও হিদায়তের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র ক্বাবা শরীফ এর প্রতি মুসলিম উম্মাহর অকৃত্রিম ভালোবাসা সম্মান ও মর্যাদা প্রতিটি মুসলিমের অন্তরের গভীরে প্রোথিত। এটি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ পবিত্র ঘরের মর্যাদা প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, “আমি এ নগরীর প্রভুর ইবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি, যেটিকে তিনি সম্মানিত করেছেন, নিষিদ্ধ ঘোষনা করে, বস্তুত তাঁরই জন্য সবকিছু। আর আমাকে আত্মসমর্পনকারীদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (সূরা: নমল, আয়াত: ৯১)
মক্কা নগরীর জন্য হযরত ইবরাহীম (আ.)’র দুআ: হযরত ইবরাহীম (আ.) পবিত্র মক্কা নগরীকে “বালাদিল আমীন” তথা শান্তির নগরী করার জন্য আল্লাহর দরবারে এ মর্মে প্রার্থনা করেছিলেন। স্মরণ করুন! যখন ইবরাহীম বলল, হে প্রভূ, এ স্থানটিকে শান্তির নগরী বানিয়ে দিন আর ফলমুল দিয়ে এখানে অবস্থান কারীদের রিযিকের ব্যবস্থা করে দিন। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১২৬)
ক্বাবা গৃহে প্রবেশ কারীর নিরাপত্তা: বায়তুল্লাহ তথা আল্লাহর ঘর ক্বাবা শরীফের অসংখ্য বৈশিষ্ট রয়েছে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আর যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। (সূরা: আল ইমরান, আয়াত: ৯৭)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে এ প্রসঙ্গে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি কোন অপরাধ করে বায়তুল্লাহ তে আশ্রয় গ্রহণ করবে, সে নিরাপদ হয়ে যায়, তাকে সেখানে শাস্তি দেয়া যাবেনা বরং হেরম থেকে বের হওয়ার পর তাকে দন্ডবিধি কার্যকর করা হবে। (তারিখে মক্কা মুকাররমা, পৃ:২১)
এমনকি কোনো ব্যক্তি কাউকে খুন করে জঘন্য অপরাধ করার পরও ক্বাবা শরীফে আশ্রয় নিলে তার থেকে ভেতরে প্রতিশোধ নেয়া যাবেনা। ৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের সময় যারা হেরমে আশ্রয় নিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিরাপত্তা দান করেছেন।
পবিত্র কুরআন আরো এরশাদ হয়েছে, ‘(ঐ ঘটনাকে স্মরণ করুন) যখন আমি উক্ত গৃহ ক্বাবা কে মানবজাতির জন্য কেন্দ্র ও শান্তির স্থানে পরিণত করেছি।’ (সূরা: আল বাক্বারা, আয়াত: ১২৫)
অবিশ্বাসীরা মক্কার প্রতিবেশী হলেও তারা তাদের কর্মফল ভোগ করবে: ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে সমগ্র মানবজাতি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে মু’মিন কাফির বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলে আল্লাহর রিযক প্রাপ্ত হবে। পার্থিব জীবনের সুখ শান্তি ও ধন সম্পদের প্রাচুর্যতা পেতে পারে। কিন্তু পরকালে অবিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর রহমতের কোন অংশ থাকবেনা। আখিরাতের উত্তম প্রতিদান কেবল মুমিনদের জন্যই। তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাত ও কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক কঠিন শাস্তি। এটা হলো হযরত ইবরাহীম (আ:)’র দুআর বাস্তব প্রতিফলন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “স্মরণ করুন! যখন ইবরাহীম বলেছিল, হে প্রতিপালক! এ নগরীকে একটি নিরাপদ শহরে পরিণত করুন। এর বাসিন্দাদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে এবং পরকালে বিশ্বাসী হবে তাদেরকে নানারূপ ফলমূল দিয়ে রিযক দান করুন। আল্লাহ বললেন তবে যারা কুফরি করবে তাকেও আমি স্বল্পকালের জন্য (পার্থিব জীবনে) উপভোগের সামগ্রী দান করব। অত:পর (মৃত্যুরপর) তাকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে হেচড়িয়ে নিয়ে যাব যা কতই নিকৃষ্টতম ঠিকানা। (সূরা: আল বাক্বারা: ১২৬)
হাদীস শরীফের আলোকে বায়তুল্লাহর মর্যাদা: বরকতময় গৃহ ক্বাবা শরীফ এতই মর্যাদাপূর্ণ যার দিকে দৃষ্টিপাত করলেই অসংখ্য সওয়াব রয়েছে ও ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হযরত মুসায়্যাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, “যে ব্যক্তি ঈমান ও বিশ্বাসে ক্বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করল সে সদ্য প্রসূত নবজাত সন্তানের ন্যায় সকল গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। (নুযহাতুল মাজালিস, পৃ: ১৫২)
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে ক্বাবা শরীফ দেখামাত্রই যে দুআ করা হয় তা কবুল করা হয়। (কানযুল উম্মাল,খন্ড: ০৪, পৃ: ৪৫৮)
উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “ক্বাবা শরীফের প্রতি দৃষ্টিপাত করা ইবাদত।” (কানযুল উম্মাল, কিতাবুল আমল, খন্ড:৪, পৃ: ৪৫৮)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা বায়তুল্লাহ শরীফে প্রতিদিন একশত বিশটি রহমত নাযিল করেন, তন্মধ্যে ষাটটি রহমত তাওয়াফকারীদের জন্য, চল্লিশটি রহমত নামায আদায়কারীদের জন্য, বিশটি রহমত ক্বাবা দর্শনকারীদের জন্য। (বায়হাকী, ফজায়েলে হজ্ব, পৃ: ১০৫, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড:৩, পৃ: ২৮১)
মক্কা শরীফে আল্লাহর কুদরতী নিদর্শন: বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ক্বিবলা বাইতুল্লাহ তথা ক্বাবা শরীফকে কেন্দ্র করে পুণ্যভূমি মক্কা মুকাররমায় রয়েছে আল্লাহর অসংখ্য কুদরতী নিদর্শন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “সেটার মধ্যে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি রয়েছে ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থান।” (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখায় প্রখ্যাত তাফসীরকার হাকিমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র.) প্রণীত “তাফসীরে নূরুল ইরফানে” উল্লেখ রয়েছে, এতে রয়েছে বহু বরকতময় নিদর্শন যেমন মাক্বাম–ই ইবরাহীম, হাজরে আসওয়াদ, সাফা মারওয়া, রুকনে ইয়ামানী, আরাফাত, মিনা, মুযদালাফা ইত্যাদি।
হাদীস শরীফের আলোকে মাক্বামে ইবরাহীমের পিছনে দু’রাকাত নামায আদায় করা: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় আগমন করে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করেন এবং মাক্বামে ইবরাহীমের পিছনে দু’রাকাত নামায আদায় করেন এবং সাফা মারওয়ার মাঝে সাতবার সাঈ করেন। [বুখারী শরীফ, ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার ১ম খন্ড, পৃ: ৫০৫, কৃত: মুফতি সাইয়্যেদ আমীমুল ইহসান (র.)]
মাক্বামে ইবরাহীম ও হাজরে আসওয়াদ দু’টি জান্নাতি পাথর: “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি হাজরে আসওয়াদ এবং মাক্কামে ইবরাহীম জান্নাতের ইয়াকুত পাথর সমূহের দুটি ইয়াকুত পাথর। আল্লাহ তা’আলা এর নূরকে নিস্প্রভ করে দিয়েছেন যদি এ দুটি পাথরের নূর নিস্প্রভ না করতেন তাহলে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত আলোকিত হয়ে যেতো।” (মুসনাদে আহমদ২/২১৪, সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস নং: ২৭৩১, তারিখে মক্কা মুকাররমা, পৃ: ৬৮, তিরমিযী শরীফ, খন্ড ২, পৃ: ২৪৮, হাদীস নং: ৮৭৯, বাহারে শরীয়ত, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ: ১০৯২)
হাজরে আসওয়াদ জান্নাতী পাথর: হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথরটি) জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। সেটা দুধের চেয়েও অধিক সাদা ছিল, আদম সন্তানের গুনাহ সেটাকে কালো বানিয়ে দিয়েছে। (তিরমিযী শরীফ, খন্ড ২য়, পৃ: ২৪৮, হাদীস নং: ৮৭৮, বাহারে শরীয়ত: ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ: ১০৯২)
হাজরে আসওয়াদের অবস্থান: হাজরে আসওয়াদ কালো পাথরটি বাইতুল্লাহ শরীফের দক্ষিণ পূর্ব কোণে মাতাফ (তাওয়াফের জায়গা) থেকে দেড় মিটার উপরে স্থাপিত। এটি স্বর্গীয় পাথর, এর দৈর্ঘ্য ৮ইঞ্চি ও প্রস্ত ৭ইঞ্চি, এটি ক্বাবা ঘরের দেয়ালের বাহির্দিকে প্রোথিত। হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা সুন্নাত। হাজরে আসওয়াদের কোণ থেকে তাওয়াফ শুরু করতে হয়। আবার হাজরে আসওয়াদে শেষ করতে হবে। এভাবে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে এক তাওয়াফ বলে। ভীড় থাকলে ধাক্কাধাক্কি না করে ইশারায় চুমো দিতে হবে।
হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা ও চুমু দেওয়া নবীজির সুন্নাত: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) কে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি তিনি তা স্পর্শ করেছেন ও চুম্বন করেছেন। (বুখারী শরীফ, ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার, ১ম খন্ড, পৃ: ৫০২)
হে আল্লাহ আমাদের সকলকে পবিত্র ক্বাবা শরীফের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করার তাওফিক দিন। আপনার ঘর বায়তুল্লাহ শরীফের ফযীলত নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ
আবদুল্লাহ আল মাহমুদ
দোহাজারী, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: অনেক আলেমকে বলতে শুনেছি, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পৃষ্ঠদেশে মুহ্রে নবুওয়ত ছিল। এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: আলহামদুলিল্লাহ! আপনি যা শুনেছেন তা সত্য। মুহ্রে নবুওয়ত সম্পর্কে হাদীস শরীফে এবং বহু প্রামাণ্য কিতাবে বর্ণনা এসেছে, মুহ্রে নবুওয়ত ছিল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নবুয়তের সমুজ্জ্বল প্রমাণ ও বিশেষ নিদর্শন। যা নবীজির পৃষ্টদেশে দু’কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে ডান কাঁধের কিছুটা কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। সহীহ মুসলিমের হাদীসে এরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দু’কাঁেধর মধ্যবর্তী স্থানে কবুতরের ডিমের মত লাল গোশতের টুকরা ছিল। (সীরাতুল মোস্তফা, খন্ড: ৩য়, পৃ: ৩২২)
ইয়াহুদী আলেমগণ মুহ্রে নবুওয়াত দেখে নবীজিকে শনাক্ত করতেন। পূর্ববতী নবীগণ মুহরে নবুয়তের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নবীজির মধ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুয়তের প্রমাণ স্বরূপ সীল ও সনদ স্বরূপ ছিল। (মাদারেজুন নবুয়ত, খন্ড: ১, পৃ: ২১), হাফেজ ইবন আসাকির ও হাকেম “তারীখে নিসাপুরে” হযরত ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, নবীজির পৃষ্টদেশে মুহ্রে নবুওয়াত মাংসের পিন্ডের মত ছিল। এ গোশতের মধ্যেই “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” লেখা ছিল। (যারকানী ও শরহে মাওয়াহিব, ১ম খন্ড, পৃ: ১৫৬, সীরাতুল মুস্তফা, খন্ড ৩য়, পৃ: ৩২৩)