জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২২ মার্চ, ২০২৪ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে যাকাতের বিধান

যাকাত অর্থ: যাকাত শব্দটি আরবি, পবিত্র কুরআন ও হাদীসে যাকাত শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যাকাত একাধারে পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা, বর্ধিত হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়। শরয়ী পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ধনসম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব মিসকীন তথা নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে অর্পণ করাকে যাকাত বলে। পবিত্র কুরআনে বত্রিশবার যাকাতের কথা বলেছেন এর মধ্যে আটাশবার নামায ও যাকাত একত্রে উল্লিখিত হয়েছে। আল কুরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৮২বার যাকাতের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াত অবতরণের মাধ্যমে যাকাতের বিধান ফরজ করা হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রোযা ফরজ হওয়ার পরপর শাওয়াল মাসে যাকাত ফরজ করা হয়। নবম হিজরিতে পূর্ণাঙ্গরূপে যাকাতের বিধান কার্যকরী হয়। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ২১শ খন্ড)

আল কুরআনের আলোকে যাকাতের বিধান: যাকাত একটি আর্থিক ইবাদত। সমাজের দরিদ্র নিঃস্ব অভাবী জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি। যাকাতের উপযোগিতা ও তাৎপর্য সুদুর প্রসারী। এটা ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়। এটা আল্লাহর নির্দেশিত মুসলমানদের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়। এটা সমাজের অভাবী জনগোষ্ঠীর প্রতি নিছক কোনো দান অনুদান উপহার বা হাদীয়া নয় বরং এটা বান্দার উপর বাধ্যতামূলক ফরজ ইবাদত। পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতে সালাতের সাথে যাকাত আদায়ের নির্দেশ এসেছে, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমরা সালাত কায়েম করো যাকাত দাও এবং রাসূলের অনুগত্য করো যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার। (আল কুরআন, সূরা: নূর, ৫৬)

আল কুরআনে বর্ণিত যাকাতের খাতসমূহ: আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “যাকাত তো ঔসব লোকেরই জন্য যারা অভাবগ্রস্ত নিতান্ত নিঃস্ব, যাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, যাদের অন্তর সমূহকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়, ক্রীতদাস মুক্ত করনে, ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহ পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা বিধান আল্লাহর আর আল্লাহ জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। (আল কুরআন, সূরা: আত্‌ তাওবা, আয়াত: ৬০)

যাকাতের শরয়ী বিধান: যাকাত ফরজ, অস্বীকারকারী কাফির, অনাদায়কারী ফাসিক হত্যারযোগ্য, আদায়ে বিলম্বকারী গুনাহগার ও সাক্ষ্যের অনুপযোগী। (ফতোওয়ায়ে আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৫ম, পৃ: ২৭)

যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী: মুজতাহিদ ফকীহগণের বর্ণনামতে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার কয়েকটি শর্ত রয়েছে ১. মুসলমান হওয়া, . প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া, নাবালেগের উপর যাকাত ওয়াজিব নয়, . জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া, পাগলের উপর যাকাত ওয়াজিব নয়, . নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বৎসর তার মালিকানায় থাকা। নিসাব হলো সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অথবা সেই পরিমাণ ব্যবসায়িক মালামাল বা সেই পরিমান অর্থে যাকাত ফরজ। (তানভীর, আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:, পৃ: ২৯, আনোয়ারে শরীয়ত) . নিসাব ঋণমুক্ত হওয়া। নিসাবের মালিক বটে কিন্তু ঋণ এতটুকু পরিমাণ রয়েছে যে ঋণ পরিশোধ করার পর নিসাব পরিমাণ থাকেনা তখন যাকাত ওয়াজিব নয়। ৬. নিসাব প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক সামগ্রী থেকে মুক্ত হওয়া। ব্যবহারিক সামগ্রী বলতে জীবন যাপনের জন্য মানুষের জন্য যে সব জিনিসের প্রয়োজন হয় যেমন বসবাস করার ঘর, শীতে গ্রীষ্মে পরিধানের কাপড়, গৃহের ফার্নিচার আসবাবপত্র, ব্যবহারের গাড়ী, যুদ্ধের হাতিয়ার, পেশাজীবীদের যন্ত্রপাতি, জ্ঞানী মানুষের গ্রন্থাবলী কিতাবসমূহ, ঔসব জিনিসের উপর যাকাত ওয়াজিব নয়। (হেদায়া, আলমগীরি, রদ্দুল মোহতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:, পৃ: ৩৪)

হাদীসের আলোকে যাকাতের বর্ণনা: যাকাত অনাদায়ে পরকালে ভয়াবহ শাস্তির কথা হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ যাকে ধন সম্পদ দিয়েছেন তারপর সে এর যাকাত আদায় করলনা, কিয়ামতের দিন ঐ ধন সম্পদ এমন বিষধর সর্পে পরিণত হবে যার মাথার উপর থাকবে দুটি কালো দাগ। এ সর্প সে ব্যক্তির গলায় পেছিয়ে দেয়া হবে। এবং সে সর্প ঐ ব্যক্তির দুই চোয়ালে দংশন করতে থাকবে এবং বলতে থাকবে আমি তোমার সম্পদ আমি তোমার সঞ্চিত ধন। (বুখারী শরীফ, হাদীস, ৪৫৬৫)

যাকাত আদায়কারীর জন্য ফেরেস্তাদের দুআ: যাকাত দাতা ও দ্বীনি কাজে অর্থ ব্যয়কারীর জন্য ফেরেস্তারা দুআ করতে থাকেন। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেস্তা অবতরণ করেন, তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ দাতা কে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন, আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ কৃপণকে ধ্বংশ করেদিন। (বুখারী শরীফ, হাদীস: ১৩৫১)

যাকাতের হিকমত: বাৎসরিক যাকাত প্রদান করা প্রকৃত অর্থে মুসলমানদের কে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, বান্দার মালিকানাধীন সম্পদ সত্যিকার অর্থে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি পবিত্র আমানত ও পরীক্ষা স্বরূপ। সম্পদ শুধু ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে উপভোগের জন্য নয় বরং সমাজের নিঃস্ব দুস্থ দরিদ্র পীড়িত, মানুষের কল্যাণের জন্যও সম্পদকে ব্যয় করতে হবে। আর্থ সামাজিক কল্যাণের উপর ভিত্তি করে মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠিত, মানবতার কল্যাণের কথা বিবেচনা করেই শতকরা আড়াই ভাগ হারে যাকাত প্রদানের বিধান দেয়া হয়েছে। যে সম্পদের যাকাত আদায় হবে না ঔই ব্যক্তির সঞ্চিত সম্পদ কিয়ামত দিবসে বিষাক্ত সাপের আকৃতি ধারণ করবে এবং তাকে ক্রমাগত দংশন করতে থাকবে এবং বলতে থাকবে আমিই তো তোমার সম্পদ আমিই তো তোমার গুপ্ত ধনভান্ডার, এভাবেই ঐ ব্যক্তির পুরো শরীরকে ভক্ষণ করবে। (ফাতাওয়া রযভিয়্যাহ, খন্ড: ১০, পৃ: ১৫৩)

যাকাত দেয়ার সময় নিয়ত শর্ত: যাকাত দেয়ার সময় বা যাকাতের মাল বা অর্থ পৃথক করার সময় যাকাতের নিয়ত শর্ত। বছরব্যাপী দান করেছে এখন নিয়ত করল যে, যা কিছু দিয়েছি তা যাকাত। যাকাত আদায় হবে না। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: , পৃ: ৪০)

যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে এবং দেয়া উত্তম: নিজের ভাই বোন, ভাই বোনের ছেলে মেয়ে, নিজ চাচা, ফুফু, তাদের ছেলে মেয়ে, নিজ মামা খালা ও তাদের ছেলে মেয়ে অতপর অন্যান্য আত্মীয় স্বজন অতঃপর প্রতিবেশীকে দেয়া উত্তম।

যাদেরকে যাকাত দেয়া জায়েজ হবে না। ১. নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া যাবেনা। ২. নিজের মূল যেমন পিতা মাতা, দাদা দাদী, নানা নানী, ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনী প্রৌপুত্র প্রৌপুত্রী এদেরকে যাকাত দেয়া যাবেনা। অনুরূপ সাদকা ফিতরা মান্নত কাফফারা ওদেরকে দেয়া যাবেনা, তবে নফল সাদকা ওদেরকে দেয়া যাবে বরং দেয়াটা উত্তম। (আলমগীরি, রদ্দুল মোহতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ), স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে যাকাত দিতে পারবেনা। ইসলামের মৌলিক বিষয়ে বাতিল আকিদা পোষণ কারীকে যাকাত দেয়া যাবেনা। (দুররে মুখতার আলমগীরি)

যাকাতের টাকা দিয়ে বেতন ভাতা দেয়া যাবেনা: মাদরাসা মসজিদে কর্মরত শিক্ষককর্মচারী, খতীব ইমাম মুয়াজ্জিনের বেতন ভাতা যাকাতের টাকা থেকে আদায় করা জায়েজ নেই। যাকাতের ক্ষেত্রে শর্ত হলো যাকাত বিনিময় ছাড়া দিতে হবে, কাজের বিনিময়ে যাকাত দেয়া শরীয়তে জায়েজ নেই। (দুররুল মুখতার, খন্ড: , পৃ: ৩৪৪, ফাতওয়ায়ে আলমগীরি, খন্ড:, পৃ: ১৯০)

গরু ও মহিষের যাকাত: গরু বা মহিষ ত্রিশটির কম হলে যাকাত ওয়াজিব হবে না। প্রতি ত্রিশটি গরু ও মহিষের জন্য ১ বছর বয়সী ১টা গরুর বাছুর দিতে হবে। প্রতি ৪০ টার জন্য ২ বছর বয়সী ১টা গরুর বাছুর দিতে হবে। যদি গরু মহিষ উভয়টি থাকে তাহলে যাকাত একত্রে দিতে পারবে যেমন বিশটি গরু এবং ১০টি মহিষ আছে তাহলে একত্রে মিলায়ে যাকাত দেয়া ওয়াজিব হবে। গরু সংখ্যা বেশী হলে গরুর বাচুর, মহিষ বেশী হলে মহিষের বাচুর যাকাত দিতে হবে। গরু মহিষের যাকাতে নরমাদী উভয়টি দেয়া যাবে। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:, পৃ: ৪৯)

ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার যাকাত: ছাগলের সংখ্যা চল্লিশের কম হলে যাকাত নেই। চল্লিশটি হলে একটি ছাগল যাকাত দিতে হবে। ১২০টার জন্য ২টা, ৩০০টার জন্য ৩টা, এরপর প্রতি ১০০টাতে ১টি করে বৃদ্ধি পাবে। ভেড়া দুম্বা ছাগলের অন্তর্ভুক্ত। তবে বয়স যেন এক বছরের কম না হয়।

উটের যাকাত: উট পাঁচটির কম হলে যাকাত ওয়াজিব নয়। পাঁচটির জন্য একটি ছাগল। দশটি হলে দুটি ছাগল, এভাবে প্রত্যেক পাঁচটিতে একটি বকরী ছাগল ওয়াজিব। এ হিসেবে গণ্য হবে। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: , পৃ: ৪৭)

আল্লাহ তা’আলা কুরআন হাদীসের আলোকে শরয়ী নির্দেশনা মোতাবেক যাকাতের বিধান অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র মাহে রমজানুল মোবারক
পরবর্তী নিবন্ধপঞ্চকবির গীতিধারা