পবিত্র রবিউল আউয়ালে সর্বশ্রেষ্ঠ নি’য়ামতের শুভাগমন : উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় রবিউল আউয়াল মাস যে মাসের ১২ রবিউল আউয়াল পুণ্যময় বরকতমন্ডিত মহিমান্বিত দিবসটির আগমনের প্রহর গুণছিল সমগ্র সৃষ্টিরাজি। যে মাসে শুভাগমন করেছিলেন, নবীকুলের সর্দার জ্ঞান বিজ্ঞানের আঁধার স্রষ্ঠার সর্বোত্তম সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, ইমামুল আম্বিয়া সৈয়্যদুল মুরসালীন মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, “লাক্বাদ মান্নাল্লাহু আলাল মুমিনীনা ইয বাআছা ফিহীম রাসূলাম মিন আনফুছিহীম।” অর্থ: নি:সন্দেহে আল্লাহ মু’মিনদের উপর অনুগ্রহ ও করুণা করেছেন যে তিনি তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূলকে তাদের মাঝে পাঠিয়েছেন। (সূরা: আল ইমরান: ১৬৪)
৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের স্নিগ্ধ প্রভাতে সমগ্র বিশ্বের সৌভাগ্যের দ্বার উন্মুক্ত হলো, ধরাধামে শুভাগমন করলেন মহা প্রতীক্ষিত নিখিল সৃষ্টির আলোক বর্তিকা, শাফায়াতের কান্ডারী, মুক্তির দিশারী নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কুল মাখলুক আনন্দে আত্মহারা, গগনে গগনে নুরানী ফেরেস্তাদের দরুদ সালামের জয়ধ্বনি। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, তৃণলতা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, নভোমন্ডল, সৌরমণ্ডল, সর্বত্র নূর নবীজির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মহাআয়োজন, যাঁর শুভাগমনে সত্যান্বেষীরা কুফর, শিরক বিদআত, ত্রিতত্ত্ব্বাদ, বহুত্ববাদ ও মানবগড়া মতবাদের শৃঙ্খল থেকে মানবতা মুক্তি পেল। মানবমনে জমাট বাঁধা অতৃপ্তি ও অপূর্ণতার পুঞ্জিভূত বেদনা অপসারিত হলো। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “ বলুন! সত্য এসেছে মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবারই।” (সূরা: বনী ইসরাঈল, পারা ১৫, আয়াত: ৮১)
আল্লাহর পেয়ারা হাবীব মদীনার তাজেদার মালিকে আবে কাউসার নবী মোস্তফার আগমন ঘটেছে রবিউল আউয়াল মাসে তাইতো প্রিয় নবীর বেলাদতের স্মৃতি বিজড়িত এ মোবারক মাসে নবী প্রেমিক মুসলমানরা হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার সওগাত ও ভক্তির নযরানা উৎসর্গে বিভোর হয়ে পড়ে। পৃথিবীর দেশে দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে সর্বত্র সাড়া পড়ে যায় ঐতিহাসিক জাতীয় ধর্মীয় আনন্দোৎসব জশনে জুলুসে ঈদ-এ মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপনে ব্যাপক প্রস্তুতি। হামদ-কেরাত, নাত-এ রসূল, ইসলামী সঙ্গীত, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, মিলাদুন্নবী, জশনে জুলুস, আলোকসজ্জা, শোভাযাত্রা, মিষ্টান্ন বিতরণ, যিয়াফতের আয়োজন ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করা মূলত প্রিয় নবীজির শুভাগমনের আনন্দ ও খুশী ঈদ উদযাপনে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া আদায়ের নামান্তর ও বহি:প্রকাশ। নিয়ামতের স্মরণ ও চর্চা করা আল্লাহর নির্দেশ। মহান আল্লাহতা’আলা এরশাদ করেছেন, “ওয়াম্মা বিনেমাতি রাব্বিকা ফাহাদ্দিস” অর্থ:-“আপনার পালন কর্তার নিয়ামতের চর্চা করুন।” (আল কুরআন, পারা: ৩০, রুকু: ১৮)
রাহমাতুল্লীল আলামীন যাঁর পরিচয় : তাজেদারে মদীনা সরকারে দো আলম বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র বিশ্ব জাহানের জন্য রহমত তথা কল্যাণের মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রেরিত, স্বয়ং আল্লাহতা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি আপনাকে সমগ্র জাহানের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)
চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান ফাযেলে বেরলভি (র.) সমগ্র সৃষ্টি কূলের রহমতের প্রাণ নবী মোস্তফার প্রতি লাখো সালাম নিবেদন করেছেন। “মুস্তফা জানে রহমত পেঁ লাঁখো সালাম, শময়ে বজমে হেদায়ত পে লাখো সালাম।” (হাদায়েকে বখশিশ, ইমাম আহমদ রেযা)
রহমত লাভে খুশী উদযাপন : মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল করীমে এরশাদ হয়েছে, “কুল বিফদলিল্লাহি ওয়াবিরাহমাতিহি ফাবিজালিকা ফালয়াফরাহু হুয়া খায়রুম মিম্মা ইয়াজমাউন” অর্থ: “হে প্রিয় হাবীব, আপনি বলে দিন তারা যেন আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত প্রাপ্তিতে খুশী উদযাপন করে উক্ত খুশী ও আনন্দ তাদের সমুদয় সঞ্চয় থেকে অতি উত্তম। (পারা: ১১, রুকু: ১১)
বর্ণিত আয়াতে দয়া অনুগ্রহ এ রহমত প্রাপ্তিতে খুশী উদযাপনের নির্দেশ রয়েছে, প্রিয়নবী যে সমগ্র জগৎবাসীর জন্য আল্লাহর রহমত এতে মুসলিম মিল্লাতের কোন দ্বিমত নেই। উভয় জাহানে তাঁরই রহমতের বারিধারা প্রবাহিত। সুতরাং তাঁর গুনগান শান মান মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্মরণ করা ও আলোচনা করা বিধাতার আনুগত্যের নামান্তর। পক্ষান্তরে এর বিরোধীতা করা অস্বীকার করা অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক। মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় রাসূলের মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, “আমি আপনার স্মরণকে সমুচ্চ মর্যাদা স্থাপন করেছি।” (সূরা: ইনশিরাহ,: ৪)
আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে এমন উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন, হাদীসে কুদসীতে স্বয়ং আল্লাহতা’আলা এরশাদ করেন, “(হে হাবীব) যেখানে যখন আমার আলোচনা হবে সেখানে আমার সাথে আপনার আলোচনা হবে।” (হাদীসে কুদসী)
কলেমা, আজানে, ইকামতে, খুতবায়, নামাযের তাশাহুদে, আল্লাহর হাবীবের নাম মোবারক যুক্ত হয়েছে। তাঁর প্রিয় হাবীবের প্রতি অশ্রদ্ধা, অসম্মান, অমর্যাদা প্রদর্শন ও আপত্তিকর ও অকৃজ্ঞতার্পূণ আচরণ এবং মন্তব্য করে আল্লাহর রহমত প্রাপ্তি ও মুমীন দাবী করার কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “ তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা রহমত লাভ করতে পার।” (সূরা: আলে ইমরান: ১৩২)
সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত প্রসঙ্গে বিশ্ব বরেণ্য মুহাদ্দিসগণের অভিমত : সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত আল্লাহর প্রিয়নবী মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জগৎ বাসীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম নিয়ামত। (সূত্র: সহীহ বোখারী শরীফ, ২য় খন্ড, পৃ: ৫৬৬)
আল্লামা কাযী সানাউল্লাহ পানিপথি (র.) প্রণীত তাফসীরে মাযহাবী খন্ড: ৬, পৃ: ৩০৬, সহীহ বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইমাম বদরুদ্দীন আঈনী হানফি প্রণীত ওমদাতুল ক্বারী শরহে বোখারী খন্ড ১৯, পৃ: ৬, আল্লামা ইমাম ফাছি (র.) প্রণীত মুতালিউল মুসিররাত পৃ: ১৫। হযরত শায়খ মুহাম্মদ বিন সুলাইমান যাযুলী (র.) এর মতে নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম মোবারক “নিয়ামাতুল্লাহ” তথা আল্লাহর নিয়ামত। (সূত্র: দালায়েলুল খায়রাত, পৃ: ৩৫, আনোয়ারুল বায়ান ১ম খন্ড, পৃ: ৪৬১)
শরীয়ত সম্মত পন্থায় জন্মদিন পালন করা নবীজির সুন্নাত : প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট সোমবার রোজা রাখার গুরুত্ব প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে নবীজি এরশাদ করেন, “এ দিনে আমি শুভাগমন করেছি এবং এ দিনে আমার উপর কুরআন অবর্তীণ হয়েছে।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, পৃ: ১৭৯)
ইমাম যাহবী ও ইমাম ইবনে কাসীর (র.)’র অভিমত : ইমাম যাহবী ও ইমাম ইবনে কাসীর বর্ণনা করেন, নেককার, পরহেজগার, ধর্মপরায়ণ শাসক আবু সাঈদ মুজাফফর প্রতি বৎসর অতীব শান শওকত ও মহা সমারোহে মিলাদ শরীফের মাহফিল আয়োজন করতেন এবং মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপনে প্রতিবৎসর তিন লক্ষ দিনার ব্যয় করতেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড: ০৯, পৃ: ১৮, সিয়রু আলামিন নুবালা, খন্ড: ১৬, পৃ: ২৭৫)
মিলাদুন্নবী উপলক্ষে কলেমা খচিত পতাকা উত্তোলন : প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আম্মাজান হযরত মা আমেনা খাতুন (রা.) বর্ণনা করেন। আমার নুরানী শিশুর ভূমিষ্ঠকালে আমার দৃষ্টি প্রসারিত হয়ে গেল, আমি সমগ্র পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত অবলোকন করলাম। “আমি তিনটি পতাকা প্রত্যক্ষ করলাম একটি পূর্ব প্রান্তে, একটি পতাকা পশ্চিম প্রান্তে, আর একটি পতাকা কাবা শরীফের ছাদের উপর স্থাপিত। (খাসায়েসে কুবরা, খন্ড:-১, পৃ: ৮১, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড:-৬, পৃ: ২৯৮, আনোয়ারে মোহাম্মদীয়া, পৃ: ২২),বর্ণিত প্রমাণাদির আলোকে মিলাদুন্নবীর শান-শওকত বৃদ্ধি করণে পতাকা উত্তোলনের বৈধতা প্রসঙ্গে বিশ্ব বরেণ্য মনীষীদের অভিমত দ্বারা প্রমানিত।
রাসূলুল্লাহ’র প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নাম ঈমান : নবীজির উম্মত হিসেবে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে নবীজির জীবনাদর্শ অনুসরণ করুন। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান প্রদর্শন প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, “আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সর্তককারী রূপে যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং রাসূলকে সাহায্য কর ও সম্মান কর সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। (সূরা: ফাতহু, ৮-৯),আল্লাহ আমাদের সকলকে কুরআনের বরকত দান করুন। কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা আমাদের নাজাত দান করুন। বিতাড়িত শয়তানের প্রতারণা থেকে আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। নিশ্চয় তিনি মহান দানশীল, রাজাধিরাজ, পুণ্যময়, অনুগ্রহশীল ও দয়ালু।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।