ইসলামের দৃষ্টিতে চিকিৎসা ও রোগীর সেবা
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, শারীরিক সুস্থতা ও রোগমুক্ত জীবন গঠনে কুরআন সুন্নাহর বিধি–নিষেধ মেনে চলুন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল করীম বিশ্ব মানবজাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান । এতে মানুষের জীবন পরিচালনার প্রতিটি বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিধি বিধান বিধৃত হয়েছে। ইসলামে স্বাস্থ্য সম্মত জীবন পেতে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা হলে হালাল পবিত্র সুষম খাদ্য গ্রহণের নির্দেশ মেনে চলা, শরীরের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য থেকে আত্মরক্ষা ও নেশাজাতীয় দ্রব্য বর্জন ও সর্বপ্রকার অপচয় ও অপব্যয় থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আল কুরআনের নির্দেশনা:
পবিত্র কুরআনে রয়েছে মু’মিনদের জন্য শেফা, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, এতে মু’মিনদের জন্য রয়েছে হিদায়ত ও রোগ থেকে আরোগ্য। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে ৯৭টি সুরার ৩৫৫টি আয়াতে চিকিৎসা বিদ্যা সংক্রান্ত নির্দেশনা রয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের পর শ্রেষ্ঠতম হাদীসগ্রন্থ বুখারী শরীফে “তিব্বুন নববী” অধ্যায়ে ৮০টি পরিচ্ছেদে বিভিন্ন প্রকার রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি রোগ নিরাময়, রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও রোগ নিরাময়ে ঔষধ ব্যবহার করেছেন। অসুস্থ সাহাবাদের নিরাময়ে চিকিৎসার নির্দেশনা দিয়েছেন। অসুস্থ রোগীদের সেবা যত্ন করেছেন, সাহাবাদেরকেও অসুস্থদের সেবা যত্নে মানবিক দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য রক্ষায় সুষম খাদ্য গ্রহণের গুরুত্ব:
দৈনন্দিন জীবনে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য বিধি পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণের ফলে মানবদেহ বিবিধ রোগ ব্যাধি থেকে রক্ষা পায়। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। অসুস্থ ব্যক্তি নিজের জন্য ও পরিবারের জন্য বোঝা। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন মানুষের কর্মস্পহা ও কর্মোদ্দীপনা বৃদ্ধি করে। মহান আল্লাহ তা’আলা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় হালাল ও পবিত্র খাদ্য গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ করেছেন, হে মানব জাতি! পৃথিবীতে যে সব হালাল ও পবিত্র খাদ্য রয়েছে তা খাও। অপবিত্র অপরিচ্ছন্ন পচা বাসী ভেজাল নোংরা ও সন্দেহযুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে নানাবিধ রোগ ব্যাধি সৃষ্টির আশংকা রয়েছে।
অধিক ভোজন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও রোগ বৃদ্ধির কারণ:
আল্লাহ তা’আলা সুস্থ দেহ গঠনে যে সব নীতিমালা আরোপ করেছেন তন্মধ্যে একটি হলো অধিক ভোজন পরিহার করা, আধুনিক স্বাস্থ্যবিদ ও চিকিৎসাবিদরা এ সত্যকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আর খাও এবং পান করো, তবে অপব্যয় (প্রয়োজনের অধিক প্রয়োগ) করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপব্যয় কারীদের ভালোবাসেন না। (সূরা: আ’রাফ, ৭:৩১)
একদিক আল্লাহ তা’আলা যেমন রোগ সৃষ্টি করেছেন, অপরদিকে তার নিরাময়েরও ব্যবস্থা রেখেছেন। কাজেই রোগের কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া কিংবা ঔষধ সেবন করা শরীয়তের পরিপন্থি নয়। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি যা ঈমানদারদের জন্য শিফা ও রহমত।” (সূরা: বনী ইসরাঈল, ১৭:৮২)
হাদীস শরীফের আলোকে রোগের চিকিৎসা:
শরীর সুস্থ থাকলে মন ভালো থাকে। আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী ও দ্বীনের খিদমতের জন্য শারীরিক সুস্থতা প্রয়োজন। সুস্থতা মহান আল্লাহর এক বড় নিয়ামত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর দরবারে সুস্থতার প্রার্থনা করার তালিম দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই মানুষকে স্বাস্থ্য ও সুস্থতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো নি’আমত দান করা হয়নি। (সুনানে নাসাঈ)
স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে কোনো কাজে একাগ্রতা ও আগ্রহ থাকেনা। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। বিভিন্ন প্রকার দুঃচিন্তা ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। মানসিক সুস্থতার জন্য দৈহিক সুস্থতা শর্ত।
প্রত্যেক রোগের চিকিৎসা রয়েছে:
রোগ যতই জটিল বা ভয়াবহ হোক, পৃথিবীর কোথাও না কোথাও এর চিকিৎসা আছে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের রোগের চিকিৎসক অনুসন্ধান করে তাঁর শরণাপন্ন হতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি যার নিরাময়ের ব্যবস্থা অবতীর্ণ করেননি। (সহীহ বুখারী)
ঔষধ, চিকিৎসক সবগুলো ওসীলা। মহান আল্লাহই একমাত্র শিফাদানকারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “প্রত্যেকটি রোগেরই ঔষধ রয়েছে, যখন রোগের সঠিক ঔষধ প্রয়োগ করা হয়, তখন রোগী আল্লাহর ইচ্ছায় নিরাময় হয়ে যায়। (সহীহ মুসলিম)
হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা করো না:
হারাম জাতীয় কোনো বস্তুর মধ্যে আল্লাহ তা’আলা রোগীর আরোগ্য রাখেন নি, যে বস্তু আহার করা হারাম শরীয়তে নিষিদ্ধ সে হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা করাও নিষিদ্ধ। এতে আল্লাহ তা’আলা কোনো প্রকার শিফা বা নিরাময় রাখেননি। হাদীস শরীফে হযরত ওয়াইল ইবন হাযরামী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “তারিক ইবন সুয়ায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট মদ ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তা ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বললেন আমি তো এটা ঔষধ হিসেবে তৈরী করেছি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন শরাব ঔষধ নয় বরং এটা নিজেই রোগের কারণ। (সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ: ১৬৩)
জ্বরের চিকিৎসায় ঠান্ডা পানি ব্যবহার:
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জ্বর সারানোর পদ্ধতি আবিস্কারের আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেড় হাজার বৎসর পূর্বেই পানি দিয়ে জ্বর সারানো বা শরীরের তাপমাত্রা কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আয়েশা (রা.) ও হযরত রাফি ইবন খাদীজা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জ্বরের উৎপত্তি জাহান্নামের তাপ হতে সুতরাং তোমরা পানি দ্বারা তা ঠান্ডা কর। (ইবনে মাযাহ, আহমদ নাসাঈ)
জ্বর নিবারণের জন্য শরীরে পানি ঢালা, ভেজানো কাপড় দ্বারা শরীর বারবার মুছে নেওয়া, জলপট্টি ব্যবহার করে জ্বর নামিয়ে আনা বর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই চিকিৎসা নিয়েছেন এবং চিকিৎসা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ রোগ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই ঔষধ সৃষ্টি করেছেন। রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওবাই ইবনে কাব–এর নিকট একজন ডাক্তার পাঠিয়েছিলেন যে তাঁর একটি রগ কেটেছিল এবং তাতে সেক দিয়েছিল। (সহীহ মুসলিম) অর্থাৎ তাঁর অপারেশন কার্য সম্পন্ন করেছিল।
চিকিৎসায় মধুর ব্যবহার:
পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে মধুর উপকারিতা ও গুণাগুণ আলোকপাত হয়েছে। মৌমাছি নানা প্রকৃতির ফুল ও ফলের রস পান করে এবং তা দেহের অভ্যন্তরে নিয়ে মধু তৈরী করে, পরে মৌমাছি তা চাকের মধ্যে সঞ্চার করে। মাত্র দু’শত বৎসর আগে পৃথিবীর মানুষ মৌমাছির পেট থেকে মধু নির্গত হওয়ার বিষয়ে জানতে পারে। ইসলাম সাড়ে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বেই এ তথ্য পবিত্র কুরআনে পেশ করেছে। এরশাদ হয়েছে, মৌমাছির পেট থেকে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয় যাতে মানুষের জন্য রয়েছে আরোগ্য। অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য। (সূরা নাহল, আয়াত: ৬৯)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে রুশরা ক্ষত–নিবারণে মধু ব্যবহার করেছিল। মধুর ঘনত্বের কারণে ক্ষতস্থানে কোন রকম ছত্রাক বা জীবানু জন্ম নিতে পারেনা। ফলদ শর্করা ও ভিটামিন (কে)র ক্ষেত্রে মধু এক মূল্যবান উপকারী পানীয়। পেটের অসুখ নিবারণে মধুর ব্যবহার ফলপ্রসূ ও উপকারী। হাদীস শরীফে উল্লেখ হয়েছে, হযরত আবু সাঈদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট এসে বলল, আমার ভাইয়ের পেটের অসুখ হয়েছে, তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে মধু পান করাও, এরপর লোকটি দ্বিতীয়বার এলে তিনি বললেন তাকে মধু পান করাও, অত:পর তৃতীয়বার এলে তিনি বললেন তাকে মধু পান করাও এরপর লোকটি এসে বলল, আমি অনুরূপই করেছি, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন আল্লাহ সত্য বলেছেন, তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যা বলছে, তাকে মধু পান করাও, অত:পর সে তাকে মধু পান করাল। এবার সে রোগমুক্ত হলো। (সহীহ বুখারী: ৫৬৮৪)
কালোজিরা সর্ব রোগের ওষুধ:
কালোজিরার উপকারিতা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমানিত এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা, রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, কালোজীরা একমাত্র মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের মহৌষধ। ইবন শিহাব (রা.) বলেন। সাম অর্থ মৃত্যু (বুখারী, মুসলিম)
কালোজিরা ব্যবহারের নিয়ম সম্পর্কে হাদীস শরীফে উল্লেখ হয়েছে হযরত খালিদ ইবনু সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধের অভিযানে বের হলাম, আমাদের সঙ্গে ছিলেন গালিব ইবনু আবজার। তিনি পথে অসুস্থ হয়ে গেলে এরপর আমরা মদীনায় ফিরলাম তখনও তিনি অসুস্থ ছিলেন ইবনু আবি আবিক তাঁকে দেখতে আসেন তিনি আমাদের বললেন তোমরা কালো জিরা সাথে রেখো। কালোজিরার পাঁচটি বা সাতটি দানা নিয়ে পিষে ফেলবে। তন্মধ্যে যয়তুনের কয়েক ফোঁটা তৈল ঢেলে দিয়ে তার নাকের এদিক ওদিকের ছিদ্র দিয়ে ফোঁটা করে প্রবিষ্ট করাবে। কেননা আয়েশা (রা.) আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, এই কালোজিরা মৃত্যু ছাড়া সব রোগের ঔষধ। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫৬৮৭)
ইসলামে রোগীর সেবা নবীজির আদর্শ:
রাসূলুল্লাহ রোগীর সেবা শুশ্রূষার ছিলেন উম্মতের জন্য অনুকরনীয় আদর্শ। অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া, তার সেবা করাকে পুণ্যময় আমল হিসেবে ঘোষনা দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু মুসা আশয়ারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমার ক্ষুধার্তকে খাদ্য দিবে। রোগীর সেবা করবে এবং বন্দিকে মুক্ত করে দিবে। (বুখারী)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে রোগীর সেবায় ইসলামের আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।