কুরআন ও হাদীসের আলোকে মদীনা মুনাওয়ারা’র ফযীলত
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদধূলিতে ধন্য পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারাকে ভালোবাসুন। যেখান থেকে ইসলামের হেদায়তের আলোকরশ্মি পৃথিবীর দিগ দিগন্তে ছড়িয়ে দিয়েছেন রাহমাতুল্লীল আলামীন। যেখানে শায়িত আছেন রহমতের নবী দোজাহানের সরদার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। প্রিয় রাসূলই এ শহরের প্রধান আকর্ষণ। নবীজিকে কেন্দ্র করেই এ শহরের প্রতি বিশ্ব মুসলমানদের অকৃত্রিম প্রেম ভালোবাসা ও দুনির্বার আকর্ষণ।
আল কুরআনের আলোকে মদীনা মুনাওয়ারা: মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে, এবং এভাবে আরজ করুন! হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সত্যভাবে প্রবেশ করাও এবং সত্যভাবে বাইরে নিয়ে যাও এবং আমাকে তোমার নিকট থেকে সাহায্যকারী বিজয়–শক্তি দাও। (আল কুরআন, সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত:৮০)
হযরত যায়েদ বিন আসলাম (রা.) বলেন, আয়াতে বর্ণিত, “মুদ্খালা সিদক্বিও” দ্বারা মদীনা মুনাওয়ারা এবং “মুখরাজা সিদক্বিও” দ্বারা মক্কা মোকাররমা বুঝানো হয়েছে, এ শহরের শপথ করছি কেননা হে মাহবুব! আপনি এই শহরে অবস্থান করছেন। (আল কুরআন, সূরা: বালাদ, আয়াত: ১,২)
আল বালাদ দ্বারা প্রসিদ্ধ তাফসীর মতে মক্কা মোকাররমা উদ্দেশ্য। কিন্তু আল্লামা সমহুদী (র.) “আল বালাদ” দ্বারা মদীনা মুনাওয়ারা এর অর্থও নিয়েছেন। (খোলাসাতুল ওয়াফা, পৃ: ৫, ওয়াফাউল ওয়াফা, পৃ: ১২)
এবং আরজ করো! হে আমার প্রতিপালক! আমাকে কল্যাণকর স্থানে অবতরন করাও এবং তুমি সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অবতারনকারী। আয়াতে “মুনযালাম মোবারাকা” দ্বারা মদীনা মুনাওয়ারা বুঝানো হয়েছে। (সূরা: মুমিনুন, আয়াত: ২৯, খোলাসাতুল ওয়াফা, পৃ:৫, ওয়াফাউল ওয়াফা, পৃ:১২)
“তারা বলে, আল্লাহর জমীন কি প্রশস্ত ছিলোনা যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে।” (সূরা: নিসা, আয়াত: ৯৭, আল ওয়াফাউল ওয়াফা, পৃ:১০)
হযরত যায়েদ বিন আসলাম (রা.) বলেন, আয়াতে বর্ণিত, ‘মুদ্খালা সিদক্বিও’ দ্বারা মদীনা মুনাওয়ারা এবং ‘মুখরাজা সিদক্বিও’ দ্বারা মক্কা মোকাররমা বুঝানো হয়েছে। ‘এ শহরের শপথ করছি কেননা হে মাহবুব! আপনি এই শহরে অবস্থান করছেন।’ (আল কুরআন সূরা বালাদ আয়াত: ১,২)
তারা বলে, আল্লাহর জমীন কি প্রশস্ত ছিলোনা যে? তোমরা তাতে হিজরত করতে। (সূরা নিসা আয়াত: ৯৭)
আয়াতে ‘আরদুল্লাহ’ দ্বারা মদীনা মুনাওয়ারা বুঝানো হয়েছে। (আল ওয়াফাউল ওয়াফা, পৃ:১০)
যারা মদীনা তৈয়্যবাহকে জন্মভূমি ও ঈমানকে আপন স্থায়ী ঠিকানা করে নিয়েছেন, তাদের প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে “এবং যারা প্রথম থেকে এ শহর ও ঈমানের মধ্যে গৃহ নির্মাণ করেছে।” (আল কুরআন, সূরা হাশর, আয়াত: ০৯)
ইবনে জুবালা ওসমান বিন আবদুর রহমান ও আবদুল্লাহ বিন জাফর থেকে বর্ণনা করেন ‘আদ্দার’ ও ‘আল ঈমান’ দ্বারা মদীনা মুনাওয়ারা বুঝানো হয়েছে। হে মদীনা বাসীগণ এখানে তোমাদের অবস্থানের স্থান নেই, আয়াতে বর্ণিত উক্তি মুনাফিকদেরই তারা মদীনা তৈয়্যবাহকে ইয়াসরাব বলতো। পূর্বে এ শহরের নাম ছিল ইয়াসরিব, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম রাখেন “মদীনা তাইয়্যেবা” তিনি একে ইয়াসরিব বলতে নিষেধ করেছেন, যে ব্যক্তি ইয়াসরিব বলবে সে যেন আল্লাহর দরবারে ইস্তিগফার করে। (মুসনাদে আহমদ)। যেভাবে হে মাহবুব! আপনাকে আপনার প্রতিপালক আপনার গৃহ থেকে সত্য সহকারে বের করেছিলেন। (আল কুরআন, সূরা: আনফাল, আয়াত: ৫)
হাদীস শরীফের আলোকে মদীনা মুনাওয়ারা: প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা শরীফের কল্যাণ ও বরকেতের জন্য এভাবে দুআ করতেন। “হে আল্লাহ ইবরাহীম (আ.) আপনার বান্দা বন্ধু ও নবী আমিও আপনার বান্দা ও নবী তিনি আপনার নিকট মক্কার জন্য দুআ করেছেন আমিও তাঁর অনুরূপ আপনার নিকট মদীনার জন্য দুআ করছি।” (খোলাসাতুল ওয়াফা, পৃ: ২২, কানযুল উম্মাল, খন্ড: ১ম, পৃ: ১২৭)
মদীনা শরীফের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে প্রিয় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, “মদীনা আমার হিজরতের স্থান, এখানে আমার শয়ন কক্ষ, এখান থেকেই হাশরের ময়দানে উত্থিত হব।” (সহীহ মুসলিম, খন্ড:২, পৃ: ৯৯২, ওয়াফাউল ওয়াফা, পৃ: ৪৭)
মদীনা শরীফকে অত্যধিক ভালবাসার দুআ: প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা শরীফকে অত্যাধিক ভালবাসতেন, উম্মতেরও উচিৎ মদীনাকে প্রাণাধিক ভালবাসা, নবীজি দুআ করতেন, “হে আল্লাহ মদীনা শরীফকে আমাদের নিকট মক্কা শরীফ বা তার চেয়ে অধিক প্রিয় করে দাও। (সহীহ বোখারী, খন্ড:১ম, পৃ: ২৫৩, ওয়াফাউল ওয়াফা, পৃ: ৫২)
মদীনা শরীফে হিজরত: আল্লাহ পাক নবীজিকে তিনস্থানের যে কোন একটিতে হিজরত করার এখতিয়ার দিয়েছেন। নবীজি মদীনা তৈয়্যবাকে হিজরতের স্থান হিসেবে মনোনীত করেছেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয় আল্লাহ পাক আমার নিকট ওহী করেন, আপনি তিনটি জনপদের যে কোন একটিতে যেন অবতরন করেন। তা হবে আপনার হিজরতের স্থান, মদীনা, বাহরাইন, অথবা কিন্নিসরিন। (তিরমিযী শরীফ)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, “ হে আল্লাহ তুমি আমাকে সে জমিন থেকে হিজরতের নির্দেশ দিয়েছ যেটা আমার নিকট প্রিয় ছিল। এখন এমন স্থানে আমাকে বসবাসের সুযোগ দাও যেটা তোমার কাছে অধিক প্রিয়।” (আল্লামা সামহুদী, ওয়াফাউল ওয়াফা, পৃ: ৩৪)
এতে প্রতীয়মান হলো মদীনা আল্লাহর কাছেও অধিক প্রিয় জনপদ। ইবনে জওযী হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর কোন স্থানে তাঁকে দাফন করা হবে এ নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছিলেন। সৈয়্যদানা আলী (রা.) এরশাদ করেন, “তিনি বলেন, যে জায়গায় হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেন সে জায়গার চেয়ে উত্তম জায়গা নেই। (আল্লামা সামহুদি, খোলাসাতুল ওয়াফা, পৃ: ১২)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন, আমি রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কোন নবীর প্রিয় স্থান ব্যাতীত তাঁর রূহ মুবারক কবজ করা হয় না।(প্রাগুক্ত–পৃ: ১৩)
সুতরাং যেখানে নবীজির রূহ মোবারক কবজ করা হয়েছে সেখানেই তাঁকে দাফন করার সিদ্ধান্ত। এটাই আল্লাহ ও রাসুল কর্তৃক নির্দ্ধারিত।
মদীনা শরীফে ইন্তেকালে নবীজির শাফায়াত: প্রিয়নবীর পদধূলিধন্য মদীনার পূন্যভূমিতে মৃত্যু বরণকারীর জন্য রসুলে পাকের শাফায়াতের শুভ সংবাদ রয়েছে। এরশাদ হয়েছে, “হযরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তির মদীনা শরীফে মৃত্যু বরণ করার মত সুযোগ আছে সে যেন মদীনাতেই মৃত্যু বরণ করে। আমি কিয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশকারী হব। (তিরমিযী শরীফ, কানযুল উম্মাল, খন্ড:১ম, পৃ: ১২৫, আল্লামা সামহুদি, ওয়াফাউল ওয়াফা, পৃ: ৪৯)
মদীনা মুনাওয়ারা’র প্রতি বিদ্বেষ আল্লাহর লানত উপযোগী: যারা মদীনা বাসীদের প্রতি অসম্মান দেখাবে, অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে, তাদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করবে, তাদের প্রতি জুলুম অবিচার করবে, তাদের জন্য আল্লাহর অভিসম্পাত ও ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে মদীনাবাসীদের প্রতি অন্যায়ভাবে অবিচার করল এবং তাদের প্রতি ভয় ভীতি দেখালো তার ওপর আল্লাহর ফিরিস্তাগনের এবং সকল মানুষের লানত বর্ষিত হতে থাকে। (আস সুনানুল কুবরা, মদীনাতুর রসুল, পৃ: ১২৩, খোলাসাতুল ওয়াফা, পৃ: ১৯)
হযরত সায়িদ বিন মুযায়য়্যাব (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা মুনাওয়ারায় স্বীয় নুরানী হাত মুবারক উত্তোলন করে প্রার্থনা করেন, “হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার ও আমার শহর বাসীর অনিষ্টতা ধারনা করে তুমি তাকে দ্রুত ধ্বংশ করে দাও। (শায়খ আল্লামা আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী, ‘যযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব, পৃ:৩১)
ইয়ায়িদের শাষনামলে সংগঠিত মদীনা পাকে রক্তপাত নৈরাজ্য ও তান্ডবলীলার ফলশ্রুতিতে ইয়াযিদ বাহিনীর কি করুন পরিণতি দুনিয়াবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাস তার উজ্জ্বল স্বাক্ষ্য বহন করে আছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা বাসীদের মর্যাদা সুরক্ষা ও তাঁদের যথার্থ সম্মানের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন, পক্ষান্তরে ব্যবহারে আচরনে চলনে বলনে যারা তাদের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করবে তাদের অনিবার্য র্ধ্বশের সতর্কতাও প্রিয় হাবীবের বানীতে এভাবে এসেছে, এরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি মদীনা বাসীদের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা চালাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে জাহান্নামের আগুনে এমন ভাবে বিগলিত করবেন, যে ভাবে সীসা আগুনে এবং লবণ পানিতে বিগলিত হয়। (বোখারী শরীফ, খন্ড:১ম, পৃ: ২৫৩, আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী, যযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব, পৃ: ৩১)। হে আল্লাহ! মদীনা মুনাওয়ারা প্রতি আমাদের অন্তরে ভালোবাসা দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।