জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৫ মার্চ, ২০২৪ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

রমজানুল মুবারকের ফযীলত ও বরকত

পবিত্র কুরআনের আলোকে সিয়ামের বিধান:

মানব জাতির শান্তি মুক্তি কল্যাণ মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে উপস্থিত হয়েছে নুযুলে কুরআনের মাস রমজানুল মুবারক। গোটা বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে রমজানুল মুবারক। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর এক মাস সিয়াম সাধনা ফরজ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে। যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা, বাকারা, ১৮৩)

সিয়াম শব্দের অর্থ:

সিয়াম শব্দটি বাহু বচন, সওমুন এক বচন, এর অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা, বিরত রাখা, সিয়ামের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে সুবাহ সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার কামাচার ও আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীত সকল প্রকার কথা ও কাজ থেকে নিজকে সংযত ও বিরত রাখা।

রোযা প্রাচীন ইবাদত:

তাফসীর শাস্ত্র ও হাদীস শরীফ পর্যালোচনায় জানা যায়, রোযা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ইবাদত। হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক সম্মানিত নবী রাসূলগণের উম্মতের উপর রোযা ফরজ ছিল। (নুযহাতুল মাজালিস, খন্ড: , পৃ: ১৮৮)

হযরত আদম (.) প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখে রোযা পালন করতেন। হযরত নূহ (.) ইয়াউমুল ফিতর, ইয়াউমুল আযহা ছাড়া প্রায় সারা বছর রোযা পালন করতেন। (সূনান ইবন মাযাহ, হাদীস: ১৭১৪)

হযরত মুসা (.) চল্লিশ দিন সওম পালন করে তুর পাহাড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে লাভ করেন এ ছাড়াও তিনি আশুরার দিবসে সওম পালন করতেন। হযরত দাউদ (.) একদিন পর একদিন সওম পালন করতেন। হযরত ঈসা (.) একদিন রোযা রাখতেন দুই দিন বিরত থাকতেন। (তাফসীরে আযিযী, খন্ড: , পৃ: ৬৩৯)

হাদীস শরীফের আলোকে রমজানের ফযীলত:

রোযা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য একটি বড় নিয়ামত। রোযার মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি, প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ও ইবাদতের প্রতি অধিক আগ্রহ ও মনোনিবেশ করার শক্তি অর্জিত হয়। মূলত রমজান হলো বান্দা নিজকে নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে মুক্ত রাখার কাম ক্রোধ, লোভলালসা, হিংসা মোহ পাপাচার, কামাচার মিথ্যাচার, শটতা কপটতা, ঝগড়া বিবাদ সংঘাতসহ তাকওয়া বিরোধী সকল প্রকার অপকর্ম থেকে নিজকে বিরত রেখে তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনের প্রত্যয়ে এক মাসের একটি প্রশিক্ষণ কোর্স। মহাগ্রন্থ আল কুরআন হলো এই কোর্সের পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস। জীবন চলার পথে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনের লক্ষ্যে এ সিলেবাস অনুসরণ করলে আল্লাহর রেজামন্দি অর্জন ও চুড়ান্ত সফলতা লাভের পথ সুগম হয়। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে বান্দার গুনাহ সমূহ মার্জনা করা হয়। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিাল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে আল্লাহ তা’আলা তাঁর পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৯০১, মুসলিম: ১৮১৭)

রমজানে আসমানের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়:

বরকতময় মাস রমজান হলো দুআ কবুলের মাস। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহের বারিধারায় সততই স্নিগ্ধ। এ মাসে মু’মিন বান্দাদের ইবাদত বন্দেগীর মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। নেক আমলের প্রতি উৎসাহ উদ্দীপনার আগ্রহ বেড়ে যায়, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের নিকট রমজান মাস উপস্থিত। এটি এক বরকতময় মাস। আল্লাহ তা’আলা এ মাসে তোমাদের উপর রোযা ফরজ করেছেন, এ মাসে আসমানের দরজা সমূহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে বড় বড় শয়তান গুলোকে আটক করে রাখা হয়। বান্দার জন্য এ মাসে একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে ব্যক্তি এ রজনীর কল্যাণ হতে বঞ্চিত হলো সে সত্যিই বঞ্চিত হলো। (নাসায়ী শরীফ, হাদীস: ২১০৬)

রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদত:

পবিত্র রমজান এমন এক বরকতময় মাস। যে মাসের দিনে রাতে সকাল সন্ধ্যা সার্বক্ষনিক ইবাদত হয়ে থাকে। রোযা রাখা ইবাদত, ইফতার ইবাদত, পাঞ্জেগানা নামায ইবাদত, তারাবীহ ইবাদত, তারাবীহ আদায়ের পর শয়ন করাও ইবাদত, সেহরীর অপেক্ষায় রাত শয়ন করা, সেহরী ভক্ষণ করা ইবাদত। মূলত: রমজানের দিন হোক রাত হোক প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদতই ইবাদত। (তাফসীরে নাঈমী)

রমজানে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির কবরে প্রশ্নোত্তর হবেনা, রমজানে একটি নফলের সওয়াব ফরজের সমতুল্য। একটি ফরজের সওয়াব অন্যসময়ের সওরটি ফরজের সমতুল্য যে ব্যক্তি রমজান শরীফে মৃত্যুবরণ করবে তার ব্যাপারে সওয়াল জাওয়াব হবেনা। (তাফসীরে নাঈমী)

রোযা ও কুরআন সুপারিশ করবে:

সিয়াম সাধনার মাস রমজান হলো কুরআন নাযিলের মাস। এ মাসে দীর্ঘ একমাস সিয়াম পালন করা, অধিক পরিমাণ কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা, নামাযের ভেতরে বাইরে দিনে রাতে সকাল সন্ধ্যা, অধিক পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াতে রয়েছে অপরিসীম সওয়াব।

রোযা ও কুরআন দুটিই রোযাদারের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রোযা ও কুরআন রোযাদার বান্দার জন্য শাফায়াত করবে। রোযা বলবে, হে আল্লাহ! আমি এ ব্যক্তিকে দিনে খাবার ও অন্যান্য কামনা বাসনা থেকে বিরত রেখেছি আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, হে আল্লাহ! আমি এ ব্যক্তিকে নিদ্রাথেকে বিরত রেখেছি আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। আল্লাহ তা’আলার উভয়ের সুপারিশ কবুল করবেন। (হাকিম২০৩৬, আহমদ৬৬২৬)

প্রত্যেক নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাতশগুণ, রোযা ব্যতিক্রম:

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বণির্ত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশগুণ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা বলেন রোযা এর ব্যাতীক্রম, কেননা রোযা একমাত্র আমারই জন্য, অতএব আমিই এর প্রতিদান দিব। রোযা পালনে আমার বান্দা আমারই সন্তুষ্টি বিধানে স্বীয় ইচ্ছা বাসনা ও নিজের পানাহার পরিত্যাগ করে থাকে। রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দ। একটি ইফতারের সময়, অন্যটি তার প্রভূ আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভের সময়। নিশ্চয়ই জেনে রোখা! রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট সুগন্ধি হতেও অনেক উত্তম। (বুখারী, খন্ড:, সওম অধ্যায়, পৃ: ২৩৮)

রোযা ঢাল স্বরূপ:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রোযা ঢাল স্বরূপ। ঢাল যেভাবে প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে রোযাও রোযাদারকে তেমনিভাবে অনর্থক কথাবার্তা পরনিন্দা, গীবত, চোগলখুরী, অশ্লীলতা, অসদাচরণ থেকে রক্ষা করবে। রোযাদার কটুবাক্য ব্যবহার, গর্হিত কাজ থেকে জিহ্বাকে সংযত করবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, তোমাদের কেউ যখন রোযা রাখে তখন যেন মুখ দিয়ে অশ্লীল ও খারাপ কথা না বলে। কেউ তার সাথে ঝগড়া করলে অথবা গালমন্দ করলে সে যেন বলে আমি রোযাদার। (সহীহ বুখারী শরীফ)

অন্যায়, অসুন্দর ও মন্দ কাজ থেকে আত্নরক্ষার জন্য জাহান্নামের শাস্তি থেকে পরিত্রাণের জন্য রোযা ঢাল স্বরূপ। “রোযা আমারই জন্য, আমিই এর প্রতিদান” এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জানা যায় যে, রোযাকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করার কারণ হল, অন্যান্য ইবাদতে লোক দেখানোর সম্ভাবনা থাকে রোযার ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা নেই। রোযা শুধু আল্লাহ তা’আলার জন্যই হয়। এ হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আরো বলা যায় যে, অন্যান্য ইবাদতের সওয়াব নির্ধারিত রয়েছে, রোযার ফযীলত সীমাহীন অনির্ধারিত। আল্লাহ তা’আলা এর সীমাহীন সওয়াব দান করবেন।

আল্লাহ তা’আলা রহমত ও মাগফিরাতের মাস রমজানুল মুবারকে আমাদের কে ক্ষমা করুন। সিয়ামের পবিত্রতা বজায় রাখার তাওফিক দান করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসততার জীবন কঠিন কিন্তু সম্মানের
পরবর্তী নিবন্ধদ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ