জীবন বাঁচাতে মাদক সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানুন

আজ মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস

অতনুু বড়ুয়া অন্তু | শনিবার , ২৬ জুন, ২০২১ at ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ

সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে প্রাকৃতিকভাবে মাদকের অস্তিত্ব থাকলেও জ্ঞান ও বিজ্ঞানের উন্নতির হাত ধরে মাদকও উন্নত ও শক্তিশালী হতে শুরু করে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মানুষ যখন থেকে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করলো, তখন থেকে প্রকৃতিজাত বিভিন্ন উপাদানও পরীক্ষা নিরীক্ষার অন্তর্গত হয়ে পড়লো। আর এভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে মানুষের জন্য অনেক উপকারী বস্তু যেমন আমরা পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি মাদকের মত অস্তিত্ব বিনাশী বস্তুও।
মানব দেহে মাদকের অত্যাশ্চর্য প্রভাবের কারণে এক শ্রেণির মানুষের কাছে মাদক হয়ে ওঠে পরম আরাধ্য ধন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক শাস্ত্র অনুযায়ী মাদক যখন একটি পণ্যে রূপান্তরিত হলো তখন সর্বনাশের শুধু ষোলকলাই পূর্ণ হলো না, সকল কলাই পূর্ণ হলো। কেননা মাদক মানুষের হুঁশ কেড়ে নিয়ে ঘরে, বাইরে, সমাজে, রাষ্ট্রে, সর্বোপরি সমগ্র বিশ্বের অগ্রগতির প্রধান ও অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাদকের দানবীয় থাবায় মানব জাতির উন্মাতাল হওয়ার আশংকা দেখা দিলে, এর ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা চিন্তা করে সমাজের বিবেকবান মানুষ শিহরিত হলো, কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করলো। প্রথমাবস্থায় আইন, নিয়ম কানুন, মাদক উৎপাদন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি পদক্ষেপগুলো যখন প্রত্যাশিত ফল প্রসব করছিল না, তখন কেউ কেউ বলেছিলেন মাদকাসক্তদের সবাইকে একটা ষ্টেডিয়ামে একত্র করে গুলি করে মেরে ফেলা উচিৎ। আবার কোন কোন বিজ্ঞানী মাদক মুক্তির ঔষধ আবিষ্কার করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আরো শক্তিশালী ভিন্নধর্মী নতুন মাদক আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
মাদক নির্মূলের সংগ্রামের ব্যর্থতা সকলকে হতাশায় ফেলে দিলে এক শ্রেণির মানুষ ভিন্ন উপায় চিন্তা করলেন। তারা ভাবলেন মাদক নির্মূলের তুলনায় মাদক নিয়ন্ত্রণ আরো ফলপ্রসূ হতে পারে এবং নিয়ন্ত্রণের এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ নির্মূল না হলেও নির্মূলের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। তারা আরো উপলব্ধি করলেন যে, কোন একক ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীর শক্তি দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, এজন্যে প্রয়োজন বিশ্বের সকল দেশের সম্মিলিত উদ্যোগ, অর্থাৎ মিলিত শক্তি। আর এই বিষয়টিই প্রমাণ করে দেয় যে, মাদক নির্মূল করাটা সাধারণ কোন শক্তির কাজ নয়, প্রয়োজন বিশেষ শক্তির। এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় মাদকের অপব্যবহার মুক্ত একটি আন্তর্জাতিক সমাজের লক্ষ্য অর্জনে পদক্ষেপ ও সহযোগীতা জোরদার করার দৃঢ় সংকল্পের প্রকাশ হিসাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর রেজ্যুলেশান নাম্বার ৪২/১১২-এর মাধ্যমে প্রতি বছর ২৬ জুনকে ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরবর্তীতে জাতিসংঘের এই উদ্যোগকে সহায়তার জন্য ১৯৯৭ সনে ইউএনওডিসি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউএনওডিসি মাদকের অবৈধ পাচার ও অপব্যবহারের পাশাপাশি অপরাধ প্রতিরোধ ও ফৌজদারি বিচার এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির বিষয়ে জাতিসংঘকে সহায়তা করে। সমাজে অবৈধ মাদক অপব্যবহারের ক্ষতিকর যে প্রভাব পড়ছে সে সম্পর্কে সকলকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে ব্যক্তি, সম্প্রদায় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমর্থন ও অংশগ্রহণে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবসটি পালন করা হয়। গবেষণালব্ধ ও প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক তথ্যেরভিত্তিতে মাদকের বিরুদ্ধে বিশ্বের জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে সংস্থার নীতি নির্ধারকবৃন্দ দিবসটি পালন উপলক্ষে প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেন। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘জীবন বাঁচাতে মাদক সম্পর্কে প্রকৃত ও স্বীকৃত তথ্য সহভাগিতা করুন’। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক দিবসের মূল প্রতিপাদ্যটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং মাদক সম্পর্কিত প্রকৃত ও সত্য তথ্য প্রচার করা; এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও বৈশ্বিক মাদক সমস্যা মোকাবেলার সমাধান এবং প্রমাণভিত্তিক প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও যত্ন। বিশ্ব মাদক বিরোধী দিবস হচ্ছে এমন একটি দিন যে দিনটিতে গবেষণার ফলাফল, প্রমাণভিত্তিক তথ্য ও উপাত্ত এবং জীবন রক্ষামূলক তথ্য সহভাগিতার মাধ্যমে সংহতির চেতনাকে আলতোভাবে নাড়া দিয়ে যায়। এই প্রচারাভিযান ভুল তথ্য ও অনির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎসগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে সকলকে তাদের অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়।
নিচে মাদক ও মাদক নির্ভরশীলতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে
কতিপয় সত্য তথ্য প্রদান করা হলো

১. মাদক নির্ভরশীলতা কোন রোগ নয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে মাদক নির্ভরশীলতা একটি রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাদকাসক্তির সংজ্ঞায় বলেছে, ‘মাদকাসক্তি হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদী এবং বারবার হতে পারে এমন একটি মস্তিষ্কের রোগ। সুতরাং একজন মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তি ‘পাগল নয়, খারাপও নয়, কিন্তু অসুস্থ’।
২. যারা মন্দ ও দুর্বল চরিত্রের অধিকারী তারা মাদক নেয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে মাদক গ্রহণের সাথে মন্দ ও দুর্বল চরিত্রের অধিকারী হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। একজন ব্যক্তি বিভিন্ন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কারণে মাদক গ্রহণ করে। নাটক-সিনেমা বা গল্প-উপন্যাসে মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তা সামগ্রিক বিষয়ের খণ্ডিত অংশমাত্র এবং এই খন্ডাংশ দিয়ে তাদেরকে এইরকম মনে হওয়াই সকলের জন্য স্বাভাবিক। মূলত যারা মাদক গ্রহণ করে তারা অন্য আর দশজন মানুষের মতোই স্বাভাবিক মানুষ, যারা মাদকের ক্রীতদাসে পরিণত হয় এবং এই আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করে। এদের কেউ কেউ সফল হয়, আবার কেউ হয় ব্যর্থ। মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তির জীবন দুঃখ ও যাতনার যোগফল মাত্র।
৩. একজন মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই মাদক বন্ধ করে দিতে পারে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, একজন মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই মাদক বন্ধ করে দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু ছেড়ে দিতে পারে না। মাদক বন্ধ করা আর ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একজন মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তি তার নেশাকালীন জীবনে অজস্রবার মাদক বন্ধ করে দেয় এবং কয়েক দিন পর পুনরায় মাদক গ্রহণ শুরু করে দেয়। মূলত ইচ্ছা শক্তি মাদক ত্যাগের প্রারম্ভিক অবস্থা মাত্র। সম্পূর্ণভাবে মাদক ত্যাগের জন্য ইচ্ছা শক্তির পাশাপাশি আরো অনেক বিষয় মেনে চলতে হয়।
৪. মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তিরা সুস্থ হয় না। প্রকৃত সত্য হচ্ছে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তিরা তাদের সুস্থতা অব্যাহতভাবে টিকিয়ে রাখতে পারে। যদিও মাদক নির্ভরশীলতায় পুনরায় মাদক ব্যবহার করা বা পুনরায় আসক্ত হওয়া এই রোগেরই একটি অংশ, কিন্তু আত্মউন্নয়ন ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তিরা মাদকমুক্ত, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।
৫. চিকিৎসা শেষে চিকিৎসা কেন্দ্রের সাথে আর যোগাযোগের প্রয়োজন নেই। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, চিকিৎসার মেয়াদ সম্পন্ন করার পরও চিকিৎসা কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা প্রয়োজন। কেননা মাদকমুক্ত সুস্থ জীবনের পথে অনেক অনাকাঙ্খিত ও অপ্রত্যাশীত সমস্যার উদ্ভব হয়, যা কখনো কখনো একক শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না। এ সময় চিকিৎসা কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ ও কাউন্সেলিং করা তাকে সমস্যা সমাধানে বিকল্প পথের সন্ধান পেতে সহায়তা করে এবং মাদক ছাড়া সমস্যা সমাধানে প্রেরণা যোগায়।
মাদক নির্ভরশীলতা সম্পর্কে উপরোক্ত প্রকৃত সত্যগুলোর বাইরেও আরো অনেক প্রকৃত সত্য তথ্য রয়েছে যা সংক্ষিপ্ত জায়গার কারণে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না। যদি ভুক্তভোগী কোন মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তি বা তাদের পরিবার বা আগ্রহী পাঠক এ সম্পর্কে প্রকৃত সত্য জানতে আগ্রহী হন তাহলে বারাকা (বাংলাদেশ মাদকাসক্ত চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র), গ্রাম : কমলাপুর, ইউনিয়ন : বিরুলিয়, সাভার, ঢাকা। ইমেইল: রহভড়@নধৎধপধনফ.ড়ৎম এই ঠিকানায় যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো। পরিশেষে বলতে চাই মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে সঠিক তথ্য জানার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : এডুকেটর, বারাকা

পূর্ববর্তী নিবন্ধআয়বর্ধক প্রকল্প বনাম নগরীর নান্দনিক সৌন্দর্য : সিটি মেয়রকে খোলা চিঠি
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে