২২শে এপ্রিল ১৯৩০। জালালাবাদ যুদ্ধ। মাস্টারদা পুরো দলবলসহ এসে পৌঁছলেন জালালাবাদ পাহাড়ের নিচে। সিদ্ধান্ত হল পাহাড়ে চড়ার। ওইদিন সবাই যখন ভোরবেলা মাস্টারদার নেতৃত্বে পাহাড়ে চড়েছেন সেইদিন বিকেল চারটের সময় চট্টগ্রাম নাজিরহাট শাখা রেল লাইনের ‘ঝরঝরিয়া বটতলা’ মসজিদের পাশে এসে থামল একটি ট্রেন। রেলগাড়ি থেকে নেমে এল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস ও সুর্মা ভ্যালি লাইট ইনফ্যান্ট্রির সশস্ত্র সেনাবাহিনীর দল। তারা রওনা হল জালালাবাদ পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের দুদিকে অন্য দুটো উঁচু পাহাড়ের মাথায় বসানো হল মেশিনগান। ইতিমধ্যে বিপ্লবী লোকনাথ বলের নির্দেশে আটভাগে বিপ্লবীদের বাহিনীকে পাহাড়ের চারপাশে সাজানো হল। এইদিকে পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে ব্রিটিশ সেনার দল। নিঃশ্বাস চেপে তরুণ বিপ্লবী দল অপেক্ষা করছে নেতৃত্বের নির্দেশের। ওপর থেকে গাছের আড়ালে থেকে লড়াইয়ের যে সুবিধা আছে তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করল ‘অনুশীলন এবং যুগান্তরের’ সমন্বয়ে গঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মি’র তরুণ যোদ্ধারা। পাহাড়ের কোলে একে একে লুটিয়ে পড়ল ব্রিটিশ সেনা। নিজেদের প্রাণরক্ষার তাগিদে গুলি চালাতে লাগল। প্রথমেই সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারালেন লোকনাথ বলের অনুজ হরিগোপাল বল ওরফে টেগরা। দুদিকের পাহাড় থেকে বৃষ্টিধারার মতো মেশিনগানের গুলি ছুটে আসছে। একে একে মৃত্যুবরণ করলেন ১২ জন বিপ্লবী। তারা হলেন ১.হরিগোপাল বল অন্যনাম টেগরা (ধোরলা, বোয়ালখালী–চট্টগ্রাম), ২.প্রভাস বল ৩. নরেশ রায় ৪.ত্রিপুরা সেন( কুমিল্লা) ৫.বিটু ভট্টাচার্য ৬. মতি কানুনগো ৭.অশোক দত্ত ৮.নির্মল লালা (পোপাদিয়া, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম)। ৯. জিতেন দাশগুপ্ত ১০. মধুসূদন দত্ত( বিদগ্রাম, বোয়ালখালী,চট্টগ্রাম) ১১.পুলিন চন্দ্র ঘোষ (গোসাইলডাঙা, চট্টগ্রাম) ও ১২.অর্ধেন্দু দস্তিদার। একটা একটা করে দেহ আসে আর মাস্টারদা বুকের ওপর কান রেখে বসে থাকেন কিছুক্ষণ, যদি হৃদপিণ্ডের স্পন্দন শোনা যায়! যদি প্রাণ থাকে, যদি বাঁচানো যায়। নির্মল লালার মুখে যেন তখনও হাসি লেগে আছে। ওর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকেন সর্বকনিষ্ঠ এই শহিদের মুখের দিকে। তারপর নির্মলের মাথাটা অতি যত্নে মাটিতে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পরম প্রিয় সন্তানতুল্য সাথীদের দেহগুলোর দিকে আরেকবার তাকিয়ে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানালেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, চলো এবার সবাই। আর পেছনে ফিরে তাকালেন না মাস্টারদা।