‘জাতির মেরুদণ্ড’ এবং হীনম্মন্যতার রাজনীতি

মোস্তফা কামাল পাশা | শুক্রবার , ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ

‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’! শিশু শ্রেণির পরে আমাদের প্রথম পাঠ। আবার ‘লেখা-পড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে’! তাও একই সময়ের পাঠ। ব্রেনের মেমোরি সেলে শিশুবেলায় পড়া এরকম আরো বহু নীতিকথা জমে আছে। যাঁরা এসব লিখেছেন, তারা বাণীগুলো বিশ্বাস করতেন বা গাড়ি-ঘোড়ার মালিক ছিলেন কিনা, জটিল গবেষণার বিষয়। অত কষ্ট এ‘যুগে প্রচুর মালকড়ি বরাদ্দ না থাকলে কেউ করবেন না, এটা শতভাগ ফুলপ্রুুফ সত্য। টাকা কুড়াও, নাম ছড়াও আর বিখ্যাত হও, এই হাওয়া দিনে দিনে জোরদার হচ্ছে। এটা প্রচার, প্রসারের যুগ। যত প্রচার ততবেশি প্রসার। লেখাপড়া করে জ্ঞান সাধনায় ডুব সাঁতারে থাকলে আপনি শেষ। ঘরে, বাইরে সবখানে ঝাঁটাপেটা ঔষধি হবে যোগ্য পদক, পুরস্কার! গাড়ি ঘোড়া চড়বেন ঠিকই, কিন্তু বাস কন্ডাক্টর বা লঞ্চ, স্টিমার সহকারীর ঘাঁড় ধাক্কার আপ্যায়ন সহযোগে। এক ধাক্কায় যানের পেটে ঢুকাবে। ওখানে আপনি যাত্রী ভিড়ের আঁখ চাপাই কলে যত পিষ্ট হবেন কন্ডাক্টর, সহকারী, সারেং ড্রাইভার তত খুশি। কারণ আপনার দুর্বল চিঁ চিঁ ডাক জানান দেবে, যানটির পেট প্রথম বর্ষার উজানের ডিমভর্তি পুঁটির মত একদম ঠাঁসা!
তাই, ওসব নীতিকথা যত দ্রুত জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলে পাড়ার উঠতি নেতা কাম পাতি মাস্তানকে গুরু মেনে পদসেবা দিন; নিশ্চিত থাকুন, সুখপাখি আপনার ঘাঁটে নোঙর ফেলবেই। গাড়ি, বাড়ি সব হবে একে একে। আর ঘোড়াতো মধ্যযুগের মডেল। ওই মডেলের জীবন্ত যান ‘ভিন্টেজ আইটেম’। সম্মান আছে, সম্মানী নাই! তাই মুছে ফেলুন। জ্ঞান বা লেখাপড়া চর্চা হচ্ছে, গাড়ি, বাড়ির ঘোরতর শত্রু। তাই ওপথে ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ হাঁটেই না। পাঠ্য বইয়ে বচনগুলো যদি এখনো থাকে, দ্রুত মুছে ফেলাই উত্তম। এখনকার পাঠ হবে, ‘মাস্তানি রাজনীতি করে যে, গাড়ি বাড়ি বানায় সে’! ‘শিক্ষা নয়, বিদ্যার ঝকঝকে স্টিকারই জাতির মেরুদণ্ড’। দূর অতীত বা পত্রিকার বাসি খবর বিচরানোর দরকার নেই, শাহজালাল ভার্সিটির ভি সি’সহ আরো বিখ্যাত কিছু বড় মাপের শিক্ষক মহোদয়ের উপর চোখ রাখলে বিষয়টা ছানিপড়া চোখেও পরিষ্কার দেখা যাবে। শাহজালালের ভি সি মহোদয়তো এখন মিডিয়ার অতীব গুরুত্বপূর্ণ আইটেম। যখন লেখাটা পড়ছেন, ততক্ষণ পদে থাকলে নিশ্চিত বুঝে নিতে হবে, তিনি এই গ্রহের অন্যতম ভাগ্যবান প্রজাতির একজন। তাই পাঠ্য বইয়ের পুরানো প্রবচনগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ, এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চর্চিত বিষয়, আমাদের চৌকস ও অভিজাত বাহিনী জঅই ও এর ক’জন সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ পদাধিকারীর উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। মার্কিনী স্যাংশন নিয়ে বড়ই খুশি সরকার বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও কিছু সুশীল। এটা আসলে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের মতই। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাষ্ট্রের সম্পদ, কোনো দল, ব্যাক্তি বা সরকারের নয়। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশনে কোনো ক্ষতি হলে তাও রাষ্ট্রের ক্ষতি। তা’ছাড়া কোন আত্মমর্যাদা সচেতন দেশপ্রেমিক নেতা বা দল রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি চাইতে পারে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশকে শান্তিরক্ষি মিশনে না নিতে জাতিসংঘের কাছে দরবার করার প্রশ্ন চিন্তা করাই যায় না। এটা সরাসরি দেশের ক্ষতিকে উৎসাহিত করার মত গর্হিত কাজ। কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক বা দল নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে এমন দুষ্কর্ম করতেই পারে না। অপ্রিয় সত্য, এমনটাই ঘটাচ্ছে বিএনপিসহ আরো কিছু দল ও এনজিওপুষ্ট সুশীল। লবিস্ট ফার্মের সাথে চুক্তি করে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ঢালছে তারা। একটি বড় দলের মহাসচিব সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে সব সুবিধা বাতিল করে দিতে জাতিসংঘ, মার্কিন সিনেট ও কংগ্রেস সদস্যদের কাছে পৃথক পৃথক চিঠিও পাঠাচ্ছেন ক’বছর ধরে। এটা দেশবিরোধী অন্তর্ঘাত এমনকি নিজেদের নাক কেটে যাত্রাপথ রক্তাক্ত করার মতই আত্মঘাতি। পৃথিবীর সব সভ্য দেশ রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে সবচে’ বেশি গুরুত্ব দেয়। জাতীয় মর্যাদায় ক্ষতিকর কোনো খবর পর্যন্ত প্রকাশ করেনা, মিডিয়াগুলো। যতই সিরিয়াস হোক, এমন খবর নিজেরাই ব্ল্যাকআউট করে ফেলে। রাষ্ট্র বা সরকারি নিষেধাজ্ঞায় নয়-দেশপ্রেমের টানেই। উল্টো আমরা দেশের জন্য ক্ষতিকর এমন খবরকে আরও রং চড়িয়ে ভেজে মুচমুচে করে পরিবেশন করি। কিছু দল ও সুশীল এগুলোর কাটিং ফাইল করে নালিশ করে বিদেশি শক্তির কাছে। অভিযোগ দাখিল হয়, প্রধানত জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে। প্রমাণ এখন হাতেনাতে।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন পার্লামেন্টের সদস্য জঅই এর বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়ায় খুশি হয়ে জাতিসংঘে চিঠি দিয়েছেন। বিদেশে পলাতক একটি চক্রসহ দেশ বিরোধী প্রোপাগাণ্ডা মেসিনারী এটা লুফে নিয়ে অবিশ্বাস্য ও আজগুবি ভিডিও ক্লিপ ছাড়ছে। যা দেখে ‘নতুন কাস্টমারের’ হাড়ে কাঁপুনি ধরবে। কিন্তু বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকারী ই ইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি ২৭ জানুয়ারি ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, এই চিঠি সংশ্লিষ্ট এমপির ব্যক্তিগত বিষয়, এতে ই ইউ’র কোনো যোগ নেই। তিনি বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রশংসা করে রাজনীতির গতি প্রকৃতির উপর ইইউ নজর রাখছে বলেও জানান। এতে কী বোঝা গেল? ই ইউ বা যুক্তরাষ্ট্রে কেউ কেউ বিরোধী মতের লবিস্টের টোপ গিললেও এসব গুণতিতে নেয়া অপ্রয়োজনীয়। বরং সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে দেশবিরোধী অপপ্রচার থামাতে উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
দেশকে ভালোবাসলে কেউ দেশের স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদেশে নালিশ জানাতে পারেইনা। জঅই জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, সন্ত্রাসসহ অস্ত্র ও মাদক পাচার থামাতে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছে। যা দেশে-বিদেশে বহুল প্রশংসিত। এরাতো আপনার আমারই ভাই বেরাদার। জীবন বাজি রেখে দেশকে বিপজ্জনক সেবা দিতে গেলে ভুলতো কিছু হবেই। তাহলে কেন এমন দেশবিরোধী হীনম্মন্যতা? এ নিয়ে খুশির হল্লা-চিল্লাই বা কোন ফর্মেটের রাজনীতি এবং দেশপ্রেম!

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধমাইক্রোবাস-অটোরিকশা সংঘর্ষ, নিহত ৪