জাতির জনক বঙ্গবধন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর

৩২ নম্বরের সেই বাড়ি :

জোনাকী দত্ত | রবিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার সময় বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে সপরিবারে সেগুনবাগিচার ১১৫ নম্বর সরকারি বাড়িতে বসবাস করতেন। ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর ওই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলা হয়। পরে বেগম ফজিলাতুন্নেছা সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় মাসিক ২০০ টাকায় বয়েজ স্কুলের মাঠের পাশে পুলিশ কর্মকর্তার মালিকানাধীন বাড়ি ভাড়া নেন। সরকারি এজেন্সির হুমকির মুখে এই বাড়িটিও ছাড়তে হয়। পরে বেগম সুফিয়া কামালের প্রচেষ্টায় সেগুনবাগিচার ৭৬ নম্বর বাড়িতে মাসিক ৩০০ টাকা ভাড়ায় ওঠেন। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর একান্ত সচিব নুরুজ্জামান বেগম মুজিবের অনুরোধে ধানমণ্ডি এলাকার জমির জন্য গণপূর্ত বিভাগে আবেদন পত্র জমা দেন। ১৯৫৭ সালে ৬ হাজার টাকায় ধানমণ্ডিতে এক বিঘা জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে প্রথমে এখানে দুই কক্ষের একতলা বাড়ি ও পরে দোতলা করা হয়।
এই ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু ১৯৬১ সালের পহেলা অক্টোবর থেকে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। এরপর ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর এই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে যে দিক নির্দেশনা দিতেন সেই অনুসারে দেশ পরিচালিত হতো। ২৩ মার্চ এই বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালির উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালানোর খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু এই বাড়ির নিচ তলায় তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার থেকে টেলিফোনে রাত ১২:৩০ মিনিটে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে পাক হানাদারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর ওয়্যারলেস ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। ২৫ মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিট অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাস ও পরে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মিওয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি করে রাখে। অন্যদিকে ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে মুজিব পরিবারকে বন্দি করে রাখা হয়। বাংলাদেশ বিজয় লাভ করার আগ পর্যন্ত ৩২ নম্বর বাড়ি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে থাকে।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকহানাদারের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল এই বাড়ি। বাড়ির মেরামত কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সরকারি বাসায় না উঠে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এই বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে থাকেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারসহ ৩৩ জনকে ঘাতকরা হত্যা করার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত এই বাড়িটি সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেও সেদিন তাঁকে এই বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এর কিছুদিন পর হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের ঋণে নির্মিত ভবনটি নিলামে উঠানো হয়। তৎকালীন প্রায় বারো হাজার টাকার কিস্তি পরিশোধ করে বাড়ি বুঝে পান শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১০ জুন বাড়িটি বুঝে নেওয়ার পর দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘোষণা করেছিলেন ঐতিহাসিক এই বাড়িটি হবে জনগণের। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি যাদুঘর’ হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। এর আগে ৩২ নম্বর বাড়ি ও টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি দেখাশোনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। ট্রাস্টিই বাড়িটাকে যাদুঘর হিসেবে ঘোষণা দেয়। এই বাড়ি যাদুঘরে রূপান্তরিত করার কাজে যারা শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেছিলেন তারা হলেন প্রয়াত কবি সুফিয়া কামাল, সাংবাদিক বেবী মওদুদ, ভাষা সৈনিক গাজীউল হক, ফটো সাংবাদিক পাভেল রহমান প্রমুখ নানা সময়ে যাদুঘর সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত ছিলেন। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট মূল ভবনের উত্তরে এর সম্প্রসারিত ভবন উদ্বোধন করা হয়। এই ষষ্ঠ তলা ভবনে ২৬ টি পর্বে বঙ্গবন্ধুর তথ্য ও সচিত্র ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে।
যাদুঘরের তথ্যসূত্র অনুযায়ী জানা যায় এই বাড়িটিতে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ দর্শনার্থী আসেন। জাতীয় দিবসগুলোয় এ সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। বাড়িটিতে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের ব্যবহারের জিনিস সংরক্ষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর পড়ার ঘর সহ অন্যান্য ঘর ও যথাসম্ভব একই রকম রাখা হয়েছে।
২০১৮ সালের ১০ মার্চ পরিবার নিয়ে এই ৩২ নম্বর বাড়ি দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। ছোট ছেলের গণিত অলিম্পিয়ার্ডের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকায় যাওয়া হয় আমাদের। তখন খুব ইচ্ছে ছিল এই ৩২ নম্বর বাড়ি দেখার এবং সেই ইচ্ছে পূরণ হলো। ৩২ নম্বর বাড়ি যাওয়ার পথটা খুব ছিমছাম। শান্ত লেক। রাস্তার দুপাশে ছাত্রছাত্রীরা নীরবে পড়ছে। সবুজ গাছ গাছালিতে মনোরম পরিবেশে কী সুন্দর বাড়ি! বাড়ির আঙিনায় নানা রকমের ফুল, ফলের গাছ। পায়রার বাসা। সবুজ এক টুকরো ‘লন’। আর বাড়ির ভেতরে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের ব্যবহারের জিনিসপত্র, দেয়ালে ও কাচে রক্ত ও বুলেটের চিহ্ন। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর বুলেট বিদ্ধ ছবি দেখে মনে হলো যেন এখনো তিনি এভাবেই পড়ে আছেন। আসলে এই ৩২ নম্বর বাড়ির বর্ণনা লিখে শেষ করা যাবে না। আমি নিজে ঘুরে এসে এবং বিভিন্ন তথ্য থেকে এই বাড়ি সম্পর্কে যা জানলাম তা এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরলাম। আমাদের আগামী প্রজন্মদের এই বাড়ির সঠিক ইতিহাস জানা দরকার এবং একবার ঘুরে আসলে আমাদের জাতির পিতা এবং মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্যবহুল ঘটনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে পারবে বলে আশা রাখি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধছাদবাগান : তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
পরবর্তী নিবন্ধসর্বকালের বঙ্গবন্ধু :সবার হৃদয়ে গাঁথা