পর্ব–১
ভোরের মৃদু আলোয় ফিশিং বোটের গাত্রের কালো আলকাতরা ছাপিয়ে রূপালি ঝিলিকের দৃষ্টিসুখ। জলের উপরে তোলার ক্ষণিক পরেই জীবনের সাথে লেনদেন চুকানো ইলিশ মাছের ফাঁকে ফাঁকে দেদারসে ঢালা হচ্ছে বরফ। কথায় বলে, ‘ইলিশ মরে আড়াই লাফে।’ আয়ু ফুরোবার আগে আড়াইখানা লাফ দেওয়ার সুযোগ ঘটেছিল কি না কে তার খবর রাখে! আপামর লোকজন যে এই জলচরকে পাতে তুলে রসনাবিলাসেই বিশেষ আগ্রহী। অবশ্য জাতীয় মাছ নিয়ে এই উচ্ছ্বাস শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে তেলেঙ্গানা অবধি ছড়ানো লোকের নোলা! ধার করে ঘি খেতে উদ্বুদ্ধ করার প্রবাদ আছে তেলেগু ভাষাতেও! ওই অঞ্চলের লোকেরা বলে, ‘ইলিশ খাওয়ার জন্য যে–কোন কিছুই বন্ধক রাখা যায়; প্রয়োজনে নিজের বিয়ে বন্ধক রেখেও ইলিশ খাওয়া উচিত!’ বরফের মাঝ থেকে মীনকুলের রাজা বলে ঘোষিত এই প্রজাতির ঘোলা চোখের শেষ দৃষ্টি আর ধীবরদের উপর থেকে চোখ নামাই জলে।
মহেশখালী জেটিঘাটের পানি এমনিতে খুব একটা নোংরা নয়। কিন্তু আজ এখানের সবুজাভ জল রূপ নিয়েছে কালো আবিল জলে। ঘাটের আশেপাশে পোড়া মবিল ছড়িয়েছে কোনো এক মর্কট! তেলে–জলে মিশ না খাওয়ার চিরন্তন সূত্র মেনে জলের উপরিকাঠামোর দখল নিয়েছে কালচে রং। জলের এই অংশটুকুতে জলজ নানান প্রাণীর শ্বাস নেওয়ার লড়াই প্রাণান্তকর হওয়াই স্বাভাবিক। নৌযানের পুরো শরীরে মৃদু দুলুনি দিয়ে ইঞ্জিন চালু করে দিল হান্নান ভাই। তিনিই আমাদের এই রথের সারথি। অবশ্য দিকনির্দেশনার ভার পুরোটুকু মুজিব ভাইয়ের চওড়া কাঁধে। বাকি দুই নৌযাত্রীদের মাঝে আমার আর আরিফ ভাইয়ের উপর ভার জলখাবার আর জলযান থেকে জলনিকাশের ব্যাপারটা দেখা। প্যারাবনের সবুজের মাঝে মাঝে সাদা রঙের বক। দূর থেকে দেখে গাছে ফোটা বৃহদাকৃতি শুভ্র ফুল বলে ভ্রম হয়; যেন থোক থোক ঝুলে আছে। কিছুদূর এগোতেই মহেশখালী দ্বীপের সবুজাভ রেখা ক্ষীয়মাণ হতে লাগল। রাতের আবাস খোন্দকার পাড়ার সমান্তরালে চলে এলাম খানিক পরেই। এবার মহেশখালী–কক্সবাজার চ্যানেল ছাড়িয়ে এগোচ্ছি সোনাদিয়ার দিকে। সেই সুপ্রাচীন কালে কক্সবাজারের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত থাকা মহেশখালী উপজেলার বয়সকে তুলনার নিক্তিতে তুললে সোনাদিয়াকে সদ্যোত্থিত বলে ফেলাই যায়।
জলের উপর প্রপেলারের প্রতি আঘাত এগিয়ে দিচ্ছে সামনে। পথের দৈর্ঘ্যে কমছে আর গন্তব্যের সাথে হ্রাস পাচ্ছে দূরত্ব। আমাদের বোটের পোশাকি নাম এনক্লোজড লাইফবোট অ্যান্ড রেসকিউ বোট। অবশ্য সাধারণ্যে প্রচলিত নাম গামবোট। বড়ো বড়ো জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়লে লোকজন উদ্ধার করে তটরেখায় নিয়ে যেতে ব্যবহৃত হয় এই বোট। ৫৬ জন মানবসন্তানকে তীরে রেখে আসতে পারে এই জলযান। তবে দোপেয়েদেরকে দেহ সংকোচন করিয়ে তাদের প্রিয় মাছ ইলিশের অনুকরণে ইলিশ ফাইল করে সাজালে সংখ্যাটা ঠেকতে পারে ৭৩ জনে গিয়ে। এই নৌযান দৈর্ঘ্যে ৮.৫০ মিটার আর প্রস্থে প্রায় ২.৯০ মিটার। জার্মানির বার্ণে তৈরি এই বোটে বার্ন তথা আগুন লাগলে কী করতে হবে সে সম্পর্কে নানান বিতং করে লেখা নানান জায়গায়। ফাসমের নামক কোম্পানির তৈরি এই বোটের মূল উপাদান কার্বন ফাইবার। এই নৌযাত্রায় বেরোনোর বছরখানেক আগে বোটটা অচল অবস্থায় পড়ে ছিল মহেশখালীর বরুণা ঘাটে। জলযানটির সবখানে এখন নোনা পানির ছাপ। লোনা জল যে বেশিরভাগ জিনিসের জন্য মারণাস্ত্র স্বরূপ, সেটা ফের চাক্ষুষ করলাম। নোনা পানিতে থাকতে থাকতেই যেন বুড়িয়ে গেছে বোটটি। সেন্ট মাটিন্স অবধি যাত্রাপথের জন্য আমাদের মজুতে তেল আছে সাকুল্যে ৮০ লিটার আর পানি মেরেকেটে ১৫ লিটার। এ যাত্রায় জলকষ্টে ভুগতে হলেও তেলকষ্টে ভুগতে হবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত! তেলের প্রাচুর্যতার জন্যই নিজেদেরকে আরব শেখ ভাবার যথেষ্ট কারণ উপস্থিত!
বালুকাবেলায় মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিটকট চেয়ার। এর ঠিক পশ্চাতে কক্সবাজারের হোটেল–মোটেল জোনের সুউচ্চ দালানের সারি। এর পেছনে মাথা তুলেছে বাতিঘর। সমুদ্রে নামলেই বাতিঘরের আসল কার্যকারিতা বোঝা যায়। হোটেল–মোটেলের অট্টালিকা ছাড়িয়েও মাথা তুলেছে টিলার উপর অবস্থিত কক্সবাজারের এই বাতিঘর। অবশ্য বাতিঘর শুনলে সবার আগে সুসজ্জিত বইয়ের দোকানের কথাই মাথায় কেন জানি আসে! বিপণন বিদ্যার তেলেসমাতি! এদিকে পানি সবুজাভ নীল। পানিতে সাদা ফেনা তুলে এগোচ্ছে আমাদের নৌকা।
সামনের পানিতে রোদ পড়ায় দেখাচ্ছে গলানো রূপার মতো। আর ডানে তাকালে আকাশ কোনটা আর সমুদ্র কোনটা ঠাহর করা মুশকিল। একটা অভেদ্য পর্দার মতো দূরের দৃশ্যটুকু। ওই পর্দাই যেন দুনিয়ার শেষ। দৃষ্টিসীমার বাইরের অংশটুকুতেও কি নোনাজল আর আকাশের সমান রাজত্ব? ওই পর্দার পেছনেও যে পদতলে মাটি থাকবে–এটা কল্পনা করতেই কষ্ট হয়। এরপরে কী আছে প্রশ্নটা মনে এলেই সেই জিজ্ঞাসাটা মাথায় আসে, ‘উত্তর মেরুর উত্তরে কী আছে?’ অবশ্য এখানে সঠিক দিশায় চললে এরপরে কী আছে সেটাও জানা সম্ভব। মানুষের নিকট অজানা ব্যাপার–স্যাপার আশংকাজনক হারে কমছে। কার্যকারণ আর যুক্তির ছাঁচে ফেলে দিয়ে মানুষের জ্ঞানের পরিধির বাইরে থাকছে না কিছুই। অলৌকিকতার বিস্তৃত ধুম্রজাল পেরিয়ে দুর্বোধ্য ব্যাপার–স্যাপারের লৌকিক ব্যাখ্যা মিলছে। রহস্যময়তার অবসান ঘটছে, কেরামতি কমছে পির–ফকিরেরও। অবশ্য পির তো কখনো উড়ে না, ভক্তরাই ওড়ায়। ‘যা কিছু বিরাট তাই নমস্য’ ধারণা থেকেও বেরিয়ে আসছে লোকে। অনুসন্ধিৎসু মনের অনুবীক্ষণে ফেলা হচ্ছে যে– কোন ছোটো–বড়ো জিজ্ঞাসাকেই।
হোটেল জোন পেরোতেই তীরে অনেকটুকু প্রকৃতি, মনুষ্য নির্মিত দালানকোঠা অতীব কম। বোটজুড়ে মৃদু কিন্তু আরামদায়ক দুলুনি। দূরের অনতিউচ্চ গিরিমালাগুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। ইনানীর কাছ থেকে বাড়ল দুলুনি। ঢেউগুলো ফুলে ক্ষণে পর্বত চূড়ার আকৃতি নেয়, পরমুহূর্তেই বিলীন হয়ে যায় মালভূমিতে। ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিনিধিত্বই করছে ফুলে উঠা ঢেউগুলো। মুহূর্তের একটা বুদবুদ কিংবা স্ফুলিঙ্গ; এর ক্ষণেক পূর্ব কিংবা উত্তরকালে এর কোন অস্তিত্বই নেই। ফুলে উঠা সেই পর্বতচূড়াকে নিয়ে সলিলেই তার সমাপ্তি। দুলুনিতে খানিক বিরক্ত হয়েই আমরা বোটের ছাদে অবস্থান নিয়েছি। পাটুয়ারটেক থেকে দূর দিগন্তে একটা–দুটো বিন্দুর মতো নৌকার দেখা। বাঁকানো ঈদের চাঁদের মতো চোখা প্রান্তবিশিষ্ট সাম্পানগুলোর দেহে ছন্দময় দুলুনি। তটরেখার দিকে দৃষ্টি ফেরালে সবুজ পাহাড়ের পাদদেশের সোনালি বালুকাবেলা নজর কাড়ে। ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’ কি এর পেছনেই কোথাও লুকানো? নেলী খালার জলপাই–সবুজ চিঠি হাতে নিয়ে আবির আর বাবু কি ফের নতুন কোন অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখছে?