দেশে জন্মনিবন্ধন সনদ আবশ্যক করা হয়েছে সকল ক্ষেত্রে। কিন্তু জন্মসনদ করতে গেলেই পদে পদে বিপত্তিতে পড়তে হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। ডিজিটাল প্রশাসনে সব আবেদন অনলাইনে করতে হয়। কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত বছর পহেলা জানুয়ারি থেকে স্কুলে ভর্তি, এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন, নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদনসহ আরো কিছু ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল; কিন্তু সাধারণ নাগরিকরা বলছিলেন, অনলাইনে আবেদন করবার প্রক্রিয়ায় সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের ব্যাপক মাত্রায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বলা যায়, অনলাইনে আবেদন থেকে শুরু করে সনদ পাওয়া পর্যন্ত নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে প্রায় সবাইকে। ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়েই একটি জন্মসনদ পেতে লেগে গেছে ৩ মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত। অভিযোগে প্রকাশ, নতুন এ সেক্টরে দালালরা সিন্ডিকেট করেছে। ফলে অতি আবশ্যকীয় ‘জন্মসনদ’ এর জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে মানুষকে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত একই চিত্র। নিয়ম অনুযায়ী-২০০১ সালের পর যাদের জন্ম, তাদের জন্মনিবন্ধন সনদ করতে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন নম্বর প্রয়োজন হচ্ছিল। কাজেই সন্তানদের জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করতে গিয়ে বাবা-মাকেও নতুন করে জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরির প্রয়োজন পড়ছিল; কিন্তু যার বাবা নাই, কিংবা বাবা-মায়ের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে, উভয়ের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ নেই এবং যারা পথশিশু-তারা কী করে জন্মসনদ পাবেন? রাষ্ট্র তো কোনো শিশুর বাবা-মায়ের সমস্যার কারণে শিশুটির রাষ্ট্রীয় অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে না।
এ অবস্থায় একটি সুখকর সংবাদ হচ্ছে, জন্মনিবন্ধন করতে মা-বাবার জন্মসনদ আর লাগবে না। গত ১৬ আগস্ট দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, নানা ভোগান্তির পর স্বস্তি! জন্মনিবন্ধন করতে এখন থেকে আর মা-বাবার জন্মসনদ লাগবে না। গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে মা-বাবার জন্মসনদ বাধ্যতামূলক ছিল। এই নিয়মে শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে শুরুতে মা বাবার জন্মনিবন্ধন করতে হতো। শিশুর নিবন্ধনের জন্য মা-বাবারসহ মোট তিনটি নিবন্ধন করতে গিয়ে সার্ভারে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টির ফলে প্রয়োজন হতো বেশি সময়ের। এতে কাউন্সিলর এবং ইউপি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে লেগে থাকত মানুষের দীর্ঘ লাইন। এখন থেকে আগের নিয়ম বাদ দিয়ে শুধুমাত্র হাসপাতালের বার্থ সার্টিফিকেট কিংবা টিকা সনদ দেখালেই শিশুদের জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন হবে। নতুন এই নিয়মের ফলে পথ শিশুসহ বহু শিশুর জন্মনিবন্ধনে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা একটি সংকটের সুরাহা হলো বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।
সংবাদে আরো বলা হয়েছে, জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হওয়া বহু মানুষের কাছ থেকে বাড়তি টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন ঝুলে ছিল। যাদের মা বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে কিংবা বাবা মায়ের একজনের সাথে অপরের যোগাযোগ নেই এই ধরনের শিশুদের পাশাপাশি পথশিশুদের জন্মনিবন্ধন পুরোপুরি ঝুলে গিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও নানাভাবে অভিযোগ পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। অবশেষে গত ২৭ জুলাই থেকে ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’ আবেদন করতে সফটওয়্যারে মা-বাবার জন্মসনদ চাওয়া হচ্ছে না। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, এখন থেকে হাসপাতালে জন্ম নেওয়ার পর দেওয়া ছাড়পত্র বা টিকার কাগজ যেকোনো একটি প্রমাণ দেখিয়ে শিশুর জন্মনিবন্ধন করা যাবে। এর ফলে পথশিশুসহ অনেক শিশুদের জন্মনিবন্ধন করার ক্ষেত্রে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল তা কেটে যাবে বলেও সূত্র জানিয়েছে। চট্টগ্রামের একাধিক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নতুনভাবে জন্মনিবন্ধন করা সম্ভব হচ্ছে বলে উল্লেখ করে জানান, এখন বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে গেছে। এতে মানুষের ভোগান্তি কমে যাবে বলেও তারা মন্তব্য করেন।
আসলে গত দেড় বছরে শিশুদের জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করতে অভিভাবকেরা নানানভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ইতোপূর্বে আমরা এই বিষয়ে অনেক লেখালেখি করেছি; কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরির ভোগান্তি দূর করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলাম। আমরা দেখিয়াছি, স্কুলে ভর্তি ইচ্ছুক প্রতিটি শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের জন্য এই সমস্যা গলার কাঁটার মতো বিঁধেছিল।
এ কথা বলা বাহুল্য যে, দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, ত্রুটিপূর্ণ প্রযুক্তির ব্যবহার, ইন্টারনেটের ধীরগতি, জনবল সঙ্কট, অদক্ষ জনবল, কেন্দ্রীয় সার্ভারে ত্রুটি, সেবাদানকারীর দুর্ব্যবহার, তথ্য প্রদানে অনীহা এবং নাগরিকদের সচেতনতার অভাবে সারাদেশের জন্মনিবন্ধন সনদ কার্যক্রম দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। দুর্ভোগ লাগবে সরকারের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় নি। আজ এতোদিন পর সিদ্ধান্ত হলো, জন্মনিবন্ধন করতে মা-বাবার জন্মসনদ আর লাগবে না। এ সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষকে ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেবে।