স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক নীতি নির্ধারণী আলোচনা সভায় বলা হয়েছে, দেশের ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের ৩৫ শতাংশ তামাক ব্যবহার করেন। তাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ পুরুষ ও ২৫ শতাংশ নারী। অথচ দেশে মোট মৃত্যুর ১৯ শতাংশই তামাক ব্যবহারজনিত কারণে। বিশেষ করে করোনায় অধূমপায়ীদের থেকে ধূমপায়ীদের মৃত্যু ছিল তিনগুণ বেশি। গত মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত সভায় মূল প্রবন্ধে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়ার জন্য ৬টি প্রস্তাব তুলে ধরেন। সেগুলো হলো– পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত করা, বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, ই–সিগারেট বা ইমার্জিং হিটেড টোব্যাকো প্রডাক্ট উৎপাদন, ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা, তামাকপণ্যের খুচরা ও খোলা বিক্রয় বন্ধ করা ও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করা। সভার প্রধান অতিথি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য অনুবিভাগ) এ. টি. এম. সাইফুল ইসলাম বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশের অনেক তামাক কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে। অথচ ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন ও ২০১৩ সালে সংশোধনের পর গত ১৮ বছরে সরকারের রাজস্ব আয় বেড়েছে সাড়ে ১২ গুণ। প্রজনন ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের (বিইউএইচএস) অধ্যাপক ডা. হালিদা হানুম আক্তার বলেন, ২০১৭–১৮ অর্থ–বছরে সরকার তামাক থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব পেয়েছিল তার চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি টাকা খরচ হয়েছিল তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এখনই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে শক্তিশালী করার মুখ্য সময়। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব (পিএইচ উইং) ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী বলেন, ঢাকার মিরপুর ও সাভারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীদের লালা পরীক্ষা করে ৯৫ শতাংশের লালায় নিকোটিন পাওয়া গেছে। এরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি দেশে কভিড–১৯ এ অধূমপায়ীদের থেকে ধূমপায়ীদের মৃত্যু তিনগুণ বেশি ছিল। বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত। ৬১ হাজারেরও বেশি শিশু (১৫ বছরের নিচে) পরোক্ষ ধূমপানজনিত রোগে ভুগছে।
এর আগে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণ ও তামাকপণ্যের কর বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েছেন। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণে তামাকপণ্যের ওপর শক্তিশালী আইন ও কর বৃদ্ধি সম্পর্কে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী এবং তামাকপণ্যের ওপর কর বৃদ্ধির প্রক্রিয়া জোরদার করার জন্য মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আইন শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সোচ্চারভাবে ভূমিকা নিতে হবে। কারণ তাদের অবদানেই বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে এবং তাদের সহযোগিতার মাধ্যমেই দ্রুত সময়ের মধ্যে এই আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ডা. মোঃ সায়েদুর রহমান জানিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সচিবালয়ে ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পূয়র–ডর্প–এর তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের একটি প্রতিনিধি দল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই বিশেষ সহকারীর সাথে আলোচনা সভা করে। উক্ত সভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।
ডা. মোঃ সায়েদুর রহমান বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী রয়েছে, কারণ তামাক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর ২৪ থেকে ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ট্যাক্স দেয় এবং তারা তাদের মুনাফা রক্ষা করতে চাইবে। তবে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নতুন ধূমপায়ী তৈরি না হওয়া। এজন্য আমরা দেশী ও বিদেশী গবেষণার ভিত্তিতে পাবলিক প্লেসে তামাক নিষিদ্ধ করার গুরুত্ব প্রচার করছি, যদিও সরাসরি তামাক নিষিদ্ধ করা এই দেশে বাস্তবসম্মত নয়।
তিনি জানান যে সিগারেটের প্যাকেটে ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ সতর্কতামূলক ছবি এবং বড় আকারে বার্তা ছাপানো একমাত্র সমাধান হতে পারে না, কারণ দেশে সাধারণত মানুষ সতর্কতামূলক লেখা পড়লেও সচেতনতা অবলম্বন করে না। তাই এসব সতর্কীকরণকে সহায়ক উপায় হিসেবে ব্যবহার করে আরও উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কোনো পাঠ নেই, ফলে অনেক শিশু ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানে না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আমাদের ধূমপানের অপকারিতাগুলোকে সাধারণ জ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে শিশুরা এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।