জননেতা শামসুল হক স্মরণে স্মৃতি চির ভাস্বর

দীপংকর চৌধুরী কাজল | সোমবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

শামসুল হক সাহেবের সাথে আমার পরিচয়ের সূত্র হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১৮ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত স্বাধীনতা সংগ্রামী মানিক চৌধুরী আমার বাবার মাধ্যমে। আমার বাবা ছিলেন অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। শামসুল হক সাহেব ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি ’৫২ ভাষা আন্দোলনের সৈনিক। বঙ্গবন্ধুর সাথে বাবার গভীর সম্পর্কের সুবাদে এই পরিবারের সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করার কিছু দিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। তার প্রতিবাদে ৬ দফাকে বেগবান করার লক্ষ্যে চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দানে এক জনসভা হয়। ঢাকা থেকে সামশুল হক সাহেব, বাহাউদ্দিন চৌধুরী সাহেবরা এসে বক্তৃতা করেন। জনসভা শেষে আমাদের বাসায় তাঁরা আসেন। ছোট বেলার স্মৃতি একটু একটু মনে পড়ে। শামসুল হক কাকার সাথে দেখা হয় বাবা আগরতলা মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর আমাদের ঢাকার টিকাটুলির অভয়দাস লেইনের ফাতেমাবাগ বিল্ডিংয়ে। তিনি এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেত্রী আমেনা বেগমসহ মা’র সাথে দেখা করতে আসেন। বাবা কিন্তু গ্রেফতার হন চট্টগ্রাম থেকে। ঢাকার অভয়দাস লেইনের বাসা থেকে গ্রেফতার হন বিধান কৃষ্ণ সেন। বিধান কাকু ঐ বাসায় ছিলেন। পাকিস্তান সেনা বাহিনী, নৌ-বাহিনী ও বিমান বাহিনীর লোক যৌথভাবে ঐ বাসা তল্লাশি করে। বাবা তখন চট্টগ্রামে সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজ পত্রিকার বিজ্ঞাপন যোগার করা, ব্যবসার কাজে ও দলের কাজে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসেন। বাবা গ্রেফতারের খবর আমরা যখন জানতে পারি। তখন ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসার সিদ্ধান্ত হয়। তখন শামসুল হক সাহেব আমাদেরকে পিআইএ ফ্লাইটে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পিআইএ তে তাঁর ভাইরা ভাই চাকরি করতেন। তাঁকে বলে মা’র টিকেটে মুসলিম মহিলা নাম দিয়ে আমাদেরকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পাঠান।
তাঁর নিজের মুখে একদিন আমাকে বললেন, বাবা আগরতলা মামলা থেকে বের হওয়ার পর, বাবা ও শামসুল হক কাকু দুজনে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ গেলেন। ওখানে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্ট্যাল এ ছিলেন। বাবার পান খাওয়ার খুব অভ্যাস ছিল। বাবা পান খাওয়ার জন্য যেখানে গাড়ি থেকে নামছে ঠিক তার পেছনে এমআই লেখা পাকিস্তানের ইন্টিলিজেন্সের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শামসুল হক কাকু যখন হোটেলে ঢুকলেন, এক বাঙালি গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাঁকে বললেন, আপনি কার সাথে এসেছেন? এখন পশ্চিম পাকিস্তান ত্যাগ করেন! আপনাদের পেছনে গোয়েন্দারা ভীষণভাবে নজরদারি করছে। তাড়াতাড়ি হোটেল ছেড়ে দেন। শামসুল হক কাকু বাবাকে ঘটনা বললেন, তাঁরা পিআইএ টিকেট করে ঢাকায় চলে আসলেন। তখন বাবা শামসুল হক কাকুদের উপর গোয়েন্দারা কড়া নজর রাখতো। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শামসুল হক কাকু আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা মার্কায় বিপুল ভোটে এমএনএ নির্বাচিত হলেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনেও তিনি নৌকা মার্কায় বিজয়ী হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ’৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে, ৭০ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে, ৭১ মুক্তিযুদ্ধে দাদার (মানিক চৌধুরী) কি রকম ভূমিকা ছিল বলে শেষ করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৮নং থিয়েটার রোডে (সেক্সপিয়ার স্মরণী) প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন সাহেবের রুমে কোনো কোনো বৈঠকে দাদা থাকতেন। দিল্লীতে শামসুল হক কাকাদের গভীর রাতে কালো গ্লাস দেওয়া গাড়িতে করে বিভিন্ন গেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে যেসব নীতি নির্ধারণী বৈঠক হতো সেখানে দাদা ও থাকতেন।
দিল্লীতে বাবার এক বন্ধু আমাকে বলেছেন, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন কাকা সারারাত ধরে কাজ করেছেন। প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মজলুম জননেতা মৌলানা ভাসানী সাহেব এইমেসে থাকতেন। তাঁর মাগুর মাছ ও কই মাছ খুব পছন্দ। উনাকে তাই এনে খাওয়াতেন। শামসুল হক সাহেব ও ময়েজউদ্দিন সাহেব কোলকাতায় পাম এভিনিউতে থাকতেন। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে। নিরঞ্জন বোস নামে একজন রাজনীতিবিদ যিনি নেতাজী সুভাষ বোসের ভক্ত। তিনি বাসা ঠিক করে দেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন। মুক্তিযুদ্ধের শামসুল হক কাকা ও ময়েজউদ্দিন কাকাকে কোলকাতায় বেহালায় আমরা যেখানে থাকতাম সেই বাসায় দেখি। তারপর দেশ স্বাধীন হলো। সবাই ফিরে এলো। শামসুল হক সাহেব বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রি সভার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ৩০শে মার্চ জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়নের সভায় লালদীঘিতে বাবা বক্তৃতা করেন। ১লা এপ্রিল ১৯৭৪ সালে ঢাকা থেকে গ্রেফতার হন। বাবাকে গ্রেফতারের পর ঢাকা জেলা জজ শান্তি রঞ্জন কর্মকার বাবাকে জামিনে মুক্তি দেয়। কিন্তু বাবাকে জেল গেইটে আবারো বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করা হয়। আমরা এর বিরুদ্ধে রীট পিটিশন করি। বাবাকে যে মামলায় আটক করা হয় সেটিতে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয় খন্দকার মুশতাক আহমদ। তখন খন্দকার মুশতাক বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী। যাহা কেইস ডাইরীতে পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন খন্দকার মুশতাকের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বাবা সব জানতেন। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন বাবার আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করে। বাবা জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁকে আটক করে রাখায় আমি ও আমার বাবার খুড়তোতো ভাই আমার কাকা অমর চৌধুরী সহ দুজনে ঢাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগের দুর্দিনে লড়াকু কর্মী আলী হোসেন কাকা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি কে নিয়ে ১১ মিন্টু রোডে শামসুল হক সাহেবের বাসায় দেখা করি। তখন শামসুল হক সাহেব মিন্টু রোডে থাকতেন। বাবা যখন গ্রেফতার হন, তখন বঙ্গবন্ধু মস্কো ছিলেন। স্বাধীনতার পর শামশুল হক সাহেবের সাথে প্রথম দেখা। তিনি আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে স্নেহ করলেন। নিজ হাতে মিষ্টিমুখ করালেন। সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আওয়ামী লীগের দুর্দিনে ও মুক্তিযুদ্ধে বাবার অবদানের কথা বর্ণনা করতে লাগলেন। আরো বললেন, বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় মানিক দা জেলে! এটা আমাদের জন্য বিব্রতকর। শামসুল হক কাকু তার পরদিন দুপুরে ভাতের নিমন্ত্রণ করলেন। আমরা গেলাম নিমন্ত্রণ খেতে। তাঁর একটি গুণাবলী আমি স্বচক্ষে দেখেছি। খাওয়ার সময় ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে খেতে বসেছেন। ড্রাইভারকে নিজ হাতে খাবার তুলে দিয়ে তারপর নিজে খেয়েছেন। মিন্টু রোডে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা সাড়ে ৪ টার দিকে শামসুল হক কাকু সহ শেরে বাংলা নগর গণভবনের দিকে রওনা হলাম। তার আগে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফরাস উদ্দিন সাহেবকে ফোন করে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলেন। গণভবনে ঢুকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি আব্দুর রহিম সাহেবের রুমে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ফরাস উদ্দিন সাহেব এসে আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুর রুমে নিয়ে গেলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথম সাক্ষাত হয়। বঙ্গবন্ধুকে দেখে সাথে সাথে পায়ে ধরে প্রণাম করলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে বললেন। তখন তাঁর রুমে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী কামরুজ্জামান, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী আর শামসুল হক কাকা। বঙ্গবন্ধু আবেগের সঙ্গে বাবার সম্পর্কে বলতে লাগলেন, এমন একদিন ছিল আমি খেলে সে খেয়েছে, আমি না খেলে সে খাই নাই। আমার ঠাকুর মা (দাদীর) প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন। এরপর আরো কয়েকবার গণভবনে গেছি। ১৯৭৫ সালে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শামসুল হক কাকু আমাকে, হুমায়ুন ভাই ও ডাঃ আহমদ আলী (মুজিব নগর সরকারের উপসচিব) কে নিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ৩২ নং ধানমন্ডিতে গিয়েছিলেন। ৩২ নং বঙ্গবন্ধু ভবনে আমরা গেলাম। গেইটে কামাল ভাইকে (শেখ কামাল) দেখলাম, শিশু-কিশোরদের সামলাচ্ছেন। খেলা ঘরের শিশু-কিশোররা বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের পুষ্পমাল্য দিতে এসেছেন।
বঙ্গবন্ধু শামসুল হক কাকুকে রাশিয়ার মস্কোতে রাষ্ট্র দূত নিয়োগ করলেন। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিলেন চট্টগ্রামের এম আর সিদ্দিকী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটানো হলো বিশ্বে যিনি বাঙালিকে নিজস্ব আভাসভূমি ও পতাকা দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাঙালিকে পরিচয় করিয়েছেন। তিনি আমাদের বাঙালি জাতির পিতা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কিছু বিশৃংঙ্খল সেনা বাহিনীর সদস্য দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। তাই শামসুল হক সাহেবের সেবার মস্কোতে যাওয়া হলো না। খুনি মুশতাক রাষ্ট্রপতি হলেন। তিনি এসে বরিশাল ন্যাপের পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মহিউদ্দিন আহমেদকে তাঁর পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য মস্কো পাঠালেন। কিন্তু মহিউদ্দিন সাহেব কয়েকদিন ছিলেন। মস্কোর সমর্থন আদায় করতে পারলেন না। বঙ্গবন্ধু নিয়োগ দেওয়া শামসুল হক সাহেবকে মস্কো পছন্দ করলো। খন্দকার মুশতাক সাহেব রাষ্ট্রপতি হয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ আগস্ট জাতীয় ৪ নেতা, আমার বাবা মানিক চৌধুরী, গাজী গোলাম মোস্তাফা, আবদুস সামাদ আজাদ, জনাব তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাকসহ ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। খন্দকার মুশতাক রাষ্ট্রপতি হয়ে বঙ্গভবনে সকল সংসদ সদস্যদের তার পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য ডাকলেন। কিন্তু অনেকে ভয়ে বঙ্গভবনে যাননি। বেশির ভাগ সংসদ সদস্য গেলেন। কিন্তু শামসুল হক সাহেব, শহীদ ময়েজ উদ্দিন সাহেব, এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক মুশতাকের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করলেন এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করলেন এবং ঐ বৈঠককে বে-আইনি বললেন।
শামসুল হক সাহেব তখন থাকতেন মগবাজার কাজী অফিসের কাছের গলিতে। বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে ঐ বাসা থেকে বিয়ে হয় তাঁর মেয়ে নার্গিসের সাথে ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন (বীর উত্তম)। ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাজউদ্দিন কাকা, আমার বাবা (মানিক চৌধুরী) গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কারাগারে। জেলখানা থেকে শামসুল হক কাকুকে তাজউদ্দিন কাকা ও বাবা দুটি চিঠি লিখলেন। তা আমার হাত দিয়ে দেওয়া। সেখানে উল্লেখ ছিলো শামসুল হক কাকা মস্কোতে যাবেন। ওখানে তৎকালীন ভারতের হাইকমিশনার পরবর্তীতে ভারতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দর কুমার গুজরালের সাথে দেখা করবেন এবং বাংলাদেশ পক্ষ ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানাবেন। যেভাবে প্রখ্যাত সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী কে জি মুস্তফা সাহেব ইরাকে বাংলাদেশ পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে। কিন্তু এর মধ্যে ৩রা নভেম্বর জেল হত্যা হলো। যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। জেলখানা হলো নিরাপত্তার জায়গা। সেখানে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটলো। শামসুল হক সাহেবের সেবার রাষ্ট্র দূত হয়ে মস্কো যাওয়া হলো না। দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলো। প্রধান বিচারপতি সায়েম সাহেব ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। এই পরিবর্তনে যিনি কলকাঠি নেড়েছে সেই জিয়াউর রহমান শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। পরবর্তীতে শামসুল হক সাহেব রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত হলেন। ’৭৯ সালের শেষের দিকে দেশে ফিরে এলেন। তখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ব্যাপক। নেতাদের কেউ কোরবান আলী সাহেবের রেনকিং স্ট্রীটের বাসায় বৈঠক করছেন। আবার কেউ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী সাহেবের বাসায় বৈঠক করছেন। এগুলোর পেছনে জিয়াউর রহমান সাহেবের গোয়েন্দা সংস্থার লোক দিয়ে দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগকে ভাঙার চেষ্টা করেছেন। এ সময় দেশে ফিরে শামসুল হক সাহেব বাবার সাথে জেলখানায় দেখা করলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী, জননেতা আব্দুর রাজ্জাক চট্টগ্রাম জেলে বাবার সাথে দেখা করলেন। বাবা কোনো অবস্থাতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেনে নিতে পারেনি। যেভাবে হোক আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে। বাবা ১৯৮০ সালে ১৮ই মার্চ জেল থেকে বের হলেন। কিছুদিন ঢাকা পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওখানে দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাবার সাথে দেখা করতে যেতেন। ১৯৮০ সালে ২৮শে জুন বাবা ও শামসুল হক কাকা কোলকাতায় গেলেন। ১৯৮০ সালের ৩০শে জুন তাঁরা দিল্লী যাবেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সাথে দেখা করবেন এবং আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে দিল্লীর প্যান্ডেরা রোডে ফ্ল্যাটে দেখা করবেন। কিন্তু বিধির বিধান ১৯৮০ সালের ৩০শে জুন বাবা ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করলেন। বাবাকে কোলকাতায় কেওড়াতলা শ্মশানে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করা হয়। শামসুল হক কাকা বাবাকে শেষ বিদায় দেন। তাদের আর দিল্লী যাওয়া হলো না। শামসুল হক কাকা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন আমাদের পরিবারের খবর নিতেন। উনি ছিলেন আমাদের পরিবারের অভিভাবক। আমি উনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। পরিশেষে কবিগুরুর ভাষায় বলি-নয়ন সম্মুখে তুমি নাই/ নয়নেরও মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই।
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবন সুন্দর, নিজেকে জানতে হবে আর ভালোবাসতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধরজনীকান্ত সেন: প্রবাদপ্রতিম কবি ও গীতিকার