আব্দুল্লাহ্-আল-হারুন আদর্শনিষ্ঠ, আপসহীন ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিকের উজ্জ্বল উদাহরণ। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম এবং ভাষা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রসৈনিক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। শুদ্ধতম রাজনৈতিকের উজ্জ্বল প্রতিভু আব্দুল্লাহ্-আল-হারুন চৌধুরী।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রাউজানের গহিরা গ্রামের এক প্রাচীন অভিজাত কাজী পরিবারে আব্দুল্লাহ্-আল-হারুন চৌধুরীর জন্ম। তাঁর পিতার নাম আহমদ কবির চৌধুরী। গহিরার আহমদ কবির চৌধুরীর আধুনিক পরিবারটি ছিলো জ্ঞানচর্চা ও মননশীলতার জন্য উন্মুক্ত। তিনি সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম.এ আজিজের সাথে প্রথম পরিচয়। সে পরিচয়ের সূত্র ধরেই এম.এ আজিজের হাত ধরেই রাজনীতিতে উত্থান।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে গহিরা হাই স্কুল হতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হন তিনি। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ৫২ ভাষা আন্দোলন পরবর্তীতে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। সে সময়ে চট্টগ্রাম কলেজে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ছাত্রদের আব্দুল্লাহ্-আল-হারুন চৌধুরী সংগঠিত করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন আত্মপ্রকাশ করলে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হন।
১৯৫২ এর একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় গুলি চালানো হলে চট্টগ্রাম আন্দোলনে, সংগ্রামে গর্জে উঠে। প্রতিবাদ সভা ও মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠে চট্টগ্রাম ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে সর্বদলীয় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সময়কালে চট্টগ্রামের প্রথম শ্রেণির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আব্দুল্লাহ আল হারুনের সক্রিয় অংশ গ্রহণ ও সরব উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি লিখেছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী এবং মাহবুব উল আলম ছিলেন আব্দুল আল হারুনের মামাতু ভাই।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি.এ পাস করে তিনি ‘ল’তে ভর্তি হন। কিন্তু সার্বক্ষণিক রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ার কারণে ‘ল’ কোর্স শেষ করা সম্ভব হয়নি।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সাথে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে দেখা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম, এ আজিজ তাঁকে সাথে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপের ফলশ্রুতিতে সকলের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল্লাহ্-আল-হারুন বিডি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। বিডি সদস্য হিসেবে তাঁর পদমর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে তিনি আইয়ু বিরোধী ভূমিকা পালন করেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করে তোলেন।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হলে অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাংগঠনিকভাবে দক্ষ আব্দুল্লাহ্-আল-হারুন এম. এ আজিজের যোগ্য কর্মী হিসেবে মেধার স্বাক্ষর রেখে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দান হতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির ম্যাগনাকাটা ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন। সে সময়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতা এম এ আজিকের নেতৃত্বে আব্দুল্লাহ্ আল হারুন চৌধুরী সাংগাঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ দায়িত্বে থাকার সুবাদে তিনি বাঙালির ম্যাগনাকাটা হিসেবে পরিচিতি ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-র গণ-আন্দোলনে আব্দুল্লাহ্ আল হারুন চট্টগ্রামের সকল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হতে মুক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেয়ার আয়োজনে মরহুম এম এ আজিজের সাথে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন আব্দুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী। সে সময় বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার সফরে গেলে আতাউর রহমান খান কায়সার, মোশারফ হোসেন, মোস্তাক আহমদ চৌধুরী প্রমুখ আওয়ামী লীগে যোগদানের বিষয়ে আব্দুল্লাহ আল হারুন চৌধুরীর মুখ্য ভূমিকা ছিল। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পুনরায় সামরিক শাসন জারি করে প্রধান সামরিক কর্মকর্তা ইয়াহিয়া খানের হাতে ২৩ মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খান শাসনভার নিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন ঘোষণা করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়। হাটহাজারী ও রাউজান এলাকা থেকে মুসলিম লীগ প্রার্থী ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় অনেক নেতাই ফজলুল কাদেরকে পরাজিত করা সম্ভব নয় বলে মনে করতেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ আল হারুনের বুদ্ধি, সাহস এবং সাংগঠনিক তৎপরতার কারণে ফজলুল কাদের চৌধুরী পরাজিত হতে বাধ্য হন। সেই নির্বাচনে আব্দুল্লাহ্-আল-হারুন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে তিনি ভারতে চলে যান এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসাবে ৯ মাস নিরলসভাবে কাজ চালিয়ে যান। চট্টগ্রামের নরশার্দুল মরহুম এম এ আজিজ মৃত্যুবরণ করলে আব্দুল্লাহ আল হারুনের উপর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দায়িত্ব পড়ে। তাঁরই নেতৃত্বে জনাব এম এ হান্নানকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ৭১-র অসহযোগ আন্দোলনে আব্দুল্লাহ আল হারুন চট্টগ্রামে বলিষ্ট নেতৃত্ব দেন।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশে আব্দুল্লাহ্-আল-হারুন গণপরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে অংশ নেন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনে তিনি সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেন। সে সময় তাঁকে চট্টগ্রাম পরিত্যাক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। আব্দুল্লাহ্ আল হারুন চৌধুরীর মত দক্ষ একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যে কোনো সময়ে যদি নীতি পরিবর্তন করতেন তাহলে যে কোনো সরকারের মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতার বিষয়ে সম্পুর্ণ নির্লোভ ছিলেন। আমৃত্য তিনি বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে আওয়ামী রাজনীতির বাইরে পা রাখেন নি। তাঁর কর্মী প্রিয়তা, সংগঠন প্রিয়তা, আসমপ্রদায়িকতা সর্বপোরী বঙ্গবন্ধুর অতি প্রিয়ভাজন হওয়ার কারণে প্রায়শ ঈষাপরায়নতার শিকার হতেন। বঙ্গবন্ধু আব্দুল্লাহ্ আল হারুন চৌধুরীর প্রতি অসম্ভব আস্থাশীল ছিলেন। সে সময়ে বঙ্গবন্ধু তাঁকে অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক, বাকশালের জেলা সেক্রেটারী পদে নিয়োগ দিয়ে গুরুত্বপুর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা প্রাপ্তির কিছুদিন পর চট্টগ্রাম হতে দৈনিক স্বাধীনতা নাম দিয়ে তিনি জামাল খাঁন রোডে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বাকশাল গঠনের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কালো রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার পরিজন সহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর চরম নির্যাতন নিপীড়ন নেমে আসে। পৈশাচিক শাসনের মধ্যে এক বিভীষিকাময় দুঃসময় অতিক্রম করে। এ সময় আব্দুল্লাহ্-আল-হারুনকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে মুক্তি পেলেও চট্টগ্রাম ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক স্বাধীনতা পুনরায় প্রকাশ করা হয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সম্পাদনায় এবং এম আর আকতার মুকুলের পরিচালনায় এবং আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। শেষ পর্যন্ত পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ আল হারুন চৌধুরীর বড় ভাই এবং তার অতি প্রিয় মানুষ আব্দুল্লাহ আল মামুনের মৃত্যু ও গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর আহত হওয়ায় তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয় এবং এরপর হতে তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পরেন। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময়ে তাঁকে ইউএসটিসির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর করা হয়। এ মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ভাষা সৈনিক ও সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রামবাসী একজন চট্টল দরদী মানুষকে হারিয়েছে। চট্টগ্রামের ইতিহাসে তিনি ভাস্বর হয়ে থাকবেন একথা নির্ধিধায় বলা যায়।
তাঁর সাথে সম্পৃক্ততার কারণে তাঁকে দেখেছি মানবিকতা, প্রগতিশীলতা, অসামপ্রদায়িকতা সর্বোপরি মানুষের প্রতি ভালোবাসার বাস্তবরূপ। হিপোক্রেসির লেশমাত্র তাঁর চরিত্রে ছিল না। উদার, নির্লোভ ও অতি সহনশীল ছিলেন তিনি। অনেকে দেখেছি, সুদিনে স্বার্থহাসিলে সামনে প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তারপর স্বার্থ হাসিল করে কেটে পড়েছেন, বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, দুর্নাম রটিয়েছেন, আঘাত দিয়েছেন কিন্তু তিনি ছিলেন নির্বিকার। সুদিনে সুযোগ শিকারীরা আবার ভিড়তেন তাঁর কাছে। তিনিও সাদরে সব ভুলে যেতেন। এসব বিষয়ে তাঁকে বলা হলে তিনি হাসিমুখে বলতেন, ‘ভিক্ষুকরা যেখানে ভিক্ষা একটু বেশি পায় সেখানেই যায় এটাই তাদের নীতি’। অত্যন্ত দক্ষ সংগঠক এবং উদারহস্ত ছিলেন তিনি। পরিবারকে বঞ্চিত করে সংগঠনের জন্য ব্যয় করতেন। কর্মীদের জন্য তাঁর দ্বার অবারিত ছিল। ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগ, স্কুল, কলেজ, সামাজিক সংগঠন, বইমেলা, একুশ মেলা, স্বাধীনতা মেলা, খেলাঘর এরূপ অনেক সংগঠন তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়া। দলীয় কর্মকাণ্ডে মিটিং-মিছিল, নির্বাচন প্রভৃতির জন্য বঙ্গবন্ধু, আজিজ মিয়া, এম এ হান্নান প্রমুখ তাঁর উপরই দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত থাকতেন ‘হারুন আছে, হয়ে যাবে এই ভেবে’। ঐতিহাসিক ৬ দফা চট্টগ্রাম থেকে ঘোষণার তিনি ছিলেন অন্যতম মূল উদ্যোক্তা। যে ৬ দফা আন্দোলন পরবর্তীতে এক দফায় পরিণত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি। উদারহস্তে যারা দান করেন তারা কখনও কিছু পাওয়ার আশা করেন না বা পানওনা। আব্দুল্লাহ্ আল হারুন চৌধুরী ছিলেন এদলেরই মানুষ। চট্টগ্রামবাসী আব্দুল্লাহ আল হারুনের অবদানকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী