ছোট্ট সোনা রাসেল

রেজাউল করিম | বুধবার , ১২ অক্টোবর, ২০২২ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

শেখ রাসেল -একজন শিশুর নাম শুধু নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। শিশুদের প্রতীক রাসেল। বঙ্গবন্ধু গিয়েছেন বিদেশের রাজসভায়, সঙ্গে রাসেল। এটিই প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে শিশুর জন্য কী মায়াময় জায়গা ছড়িয়ে আছে। নিজের কনিষ্ঠ পুত্র বলে নয়, রাসেলকে সঙ্গী করে বঙ্গবন্ধু কার্যত শিশুর জগৎ তৈরি করে দেওয়ার বাসনা পোষণ করেছেন। জনতার কোলাহলের মাঝে বেড়ে ওঠার শক্তি জোগাতে চেয়েছেন। রাসেলের মধ্য দিয়ে এ দেশের শিশুদের সঙ্গে ভালোর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানান অনুষঙ্গ শেখ রাসেলের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তুলত।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই কালরাতে ঘাতকরা বুলেটের আঘাতে ইতিহাসের মহানায়কের বক্ষ শুধু বিদীর্ণ করেনি, যে শিশুটি বলেছিল ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি হাসু আপার কাছে যাব-’ শিশু রাসেলের ভালবাসার এই আর্তিকেও সেদিন স্তব্ধ করে দিয়েছিল নিষ্ঠুর জল্লাদরা। তারা সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।
১৯৬৬ সাল। বঙ্গবন্ধু তখন ছয় দফা আন্দোলনে রাজবন্দী হিসেবে জেলে। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ছোট ছেলেকে কাছে না পাওয়ার তীব্র বেদনা বঙ্গবন্ধু ফুটিয়ে তুলেছিলেন লেখনির ভেতর দিয়ে। রাসেলকে কতটা আদর করতেন তিনি, সেটা লেখার সেই অংশ পড়লেই অনুভব করা যায়। ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, “আব্বা বাড়ি চলো”। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো”। ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’
বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ (২০১৯) গ্রন্থে তাঁর বড় বোন শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) লেখেন, ‘আব্বা যখন ৬-দফা দিলেন তারপরই তিনি গ্রেফতার হয়ে গেলেন। রাসেলের মুখে হাসিও মুছে গেল। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে রাসেল আব্বাকে খুঁজত। রাসেল যখন কেবল হাঁটতে শিখেছে, আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, আব্বা তখনই বন্দি হয়ে গেলেন। মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আব্বার মামলা-মোকদ্দমা সামলাতে, পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। সংগঠনকে সক্রিয় রেখে আন্দোলন-সংগ্রাম চালাতেও সময় দিতে হতো।’১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের নিচতলায় পৃথিবীর সব আলোকে ম্লান করে শিশু রাসেল ধরাধামে নেমে এলো। বঙ্গবন্ধু সেদিন নির্বাচনী জনসভা করতে চট্টগ্রামে ছিলেন। ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে একটা মোর্চা করে নির্বাচনে নেমেছে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে একাট্টা সব রাজনৈতিক দল। তখনকার দিনে মুঠোফোন ছিল না। ল্যান্ডফোনই ভরসা। রাতেই যাতে বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর যায় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাসেল যেন স্বর্গ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ প্রসারিত হয়ে নেমে এলো বঙ্গবন্ধুর সংসারে।
বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়তে হলে শিশুদেরও গড়তে হবে। তাদের ভেতরে জাগাতে হবে দেশপ্রেম। শিশুরা গড়ে উঠুক কল্যাণকামী ও সৌন্দর্যমূলক জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে। শৈশব থেকে যদি দেশপ্রেম ও সঠিক ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যায়, বাংলাদেশ কখনও পথ হারাবে না। সব শিশুর মাঝে কমবেশি প্রতিভা আছে, শুধু প্রয়োজন সঠিক পরিচর্যা। বঙ্গবন্ধু রাসেলের মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন আগামীর নেতৃত্ব। অর্থাৎ শিশুরাই দেশগড়ার কারিগর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তার জয় বাংলা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রিমিয়ার ভার্সিটি উপাচার্যের সাথে পিইউডিএসের সৌজন্য সাক্ষাৎ