Lord, I`m one, Lord, I`m two,
Lord, I`m three, Lord, I`m four,
Lord, I`m five hundred miles away from home
Away from home, away from home,
Away from home, away from home,
Lord, I`m five hundred miles away from home
ইদানীং এই গানটি প্রায়ই শুনতে ইচ্ছে করে। লিরিক্স শুনলেই বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে- আমার হাহাকার সুর হয়ে বাতাসে প্রতিধ্বনি তোলে। মহামারির এই দিনগুলোতে মাঝে মাঝে ঢাকা হতে চট্টগ্রামের দূরত্বও যেন বাড়তে বাড়তে লক্ষকোটি মাইল হয়ে যায়।
প্রিয় রেজা নিবাস! প্রিয় চট্টগ্রাম!
কী অনতিক্রম্য এই দূরত্ব!
‘ও চাঁদ, চোখের জলের লাগলো জোয়ার দুখের পারাবারে…।’
আমার যাপিত জীবনকে আলোকময় উজ্জ্বলতার চেয়ে বিষাদের ধূসর মেঘই বেশি ঘিরে রেখেছে। ত্রিশ বছর আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় আমার ভাইয়ের জীবনের গল্প থেমে যায়। মাত্র চার বছরের বড়ো ভাই। সাইফুদ্দিন আহমেদ রেজা আমার ছোট্ট ভাইয়া! বলা যায়, সেই প্রথম আমার এবং আমাদের পরিবারের সদস্যদের জীবিত থেকেও মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করা। একটি মৃত্যুতে একটি পরিবারের গতিময়তা নিশ্চল স্থবিরতায় রূপ নেয়। ডানা মেলা স্বপ্নগুলো বেদনাদায়কভাবে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
সময়ের আবর্তনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শোক সন্তপ্ত সব ব্যক্তিকেই শোক বইবার ধৈর্য দেন। আমরাও ছোট্টভাইয়াকে ভুলে থাকার জন্য পুরনো অনেক অভ্যাস কিংবা সম্পূর্ণ জীবনাচরণকেই বদলে ফেলি। বদলে যায় জীবনবোধ- আশাআকাঙ্ক্ষা-দৃষ্টিভঙ্গি। বাঁচতে হবে বলেই বেঁচে থাকা! বেঁচে থাকার জন্য শোকাহত মানুষ কতোভাবেই যে অবলম্বন খুঁজে নেয়! তবুও হঠাৎ হঠাৎ বুকে চেপে থাকা পাথরটা গলা পর্যন্ত উঠে আসে- কণ্ঠ রোধ করে দেয়। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ভাইয়ের সাথে কাটানো দিনগুলো যে বড়ো বেশি জীবন্ত হয়ে যায়! কিছুতেই পিছু ছাড়ে না!
হারানো স্বজনদের তালিকা ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে। অকালে চলে যাওয়া ভাগনি শর্মীর ‘ছোট্ট খালামণি’ সম্বোধন এখনও কানের পর্দায় ভেসে আসে! আমার বাবা! বাবার সারামুখ ছড়ানো মিষ্টি হাসিটি আবারো দেখার জন্য বুকের ভেতর যে কী হাহাকার !
‘আমি একা বসি সন্ধ্যা হলে, আপনি ভাসি নয়নজলে, কারণ কেহ শুধাইলে নীরব হয়ে রই …!’ আমার সাদা কাফনে জড়ানো প্রিয়মুখের মিছিল এতো দূরপ্রসারিত, জানি না আকাশের ঠিক কোথায় চোখ রাখলে আমি তাদের মুখ আবার দেখতে পাবো!
ঘোর অমানিশার প্রলম্বিত কৃষ্ণপক্ষ আমাদের অগ্র পশ্চাৎ আচ্ছাদিত করে রাখে। আমরা পথ হাতড়ে বেড়াই। গন্তব্য খুঁজে পাই না।
আমার বাড়ি ‘রেজা নিবাস’ কেবলই দূর হতে দূরে সরে যায় …!
সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রতিদিন করোনা আপডেট প্রচারিত হয়। মৃত্যু সংখ্যা ২৪০, ২২৫, ২২৮…. । সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যানিক তথ্য প্রকাশ করে না, বিশাল এক শূন্যতার প্রতীক হয়ে ওঠে। যে হারায় যাদের হারায় তারা জানেন মৃত্যু নামের এই চিরস্থায়ী প্রস্থানের সাথে কতো আপনজনের চোখের জল কী গভীর বেদনা নিয়ে জড়িয়ে আছে।
প্রতিটি প্রাণীর জন্য মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু আত্মীয় পরিজনহীন অসহায় অবস্থার এই মৃত্যু কেউ চায় না। সারি-সারি লাশের মিছিল দেখতে-দেখতে ক্লান্ত সবাই। করোনা লক্ষন নিয়ে মৃত্যু, অঙিজেনের অভাবে মৃত্যু, লাইফ সাপোর্টে রাখা অবস্থায় মৃত্যু, ভেন্টিলেশনে মৃত্যু.. .! মৃত্যুর কতো ধরণ! পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে অনুভূতিহীন হয়ে যাই!
সংক্রমণের হার নিরন্তর গতি পাল্টায়। উর্ধ্বগতি-নিম্নগতি। নিম্নগতি আশার সঞ্চার করে। সংক্রমণে ঢাকার পরে চট্টগ্রামের উচ্চ হার। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. শিরীন আখতার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মৃত্যুবরণ করেছেন। পড়তে পড়তে স্মৃতিকাতর হয়ে যাই। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর বিশাল ক্যাম্পাসের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পিপীলিকার মতো দলবদ্ধ ছাত্রদের মিছিল দেখে রক্তে জেগে ওঠা দ্রোহ। সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ৩২২নং কক্ষ, জারুলতলা, কাটা পাহাড়ের পথ, চাকসু ভবন, ভিসির বাংলো, ক্যাফেটেরিয়া, স্টেশন চত্বর থেকে ফ্যাকাল্টিতে নিয়ে যাওয়া স্টুডেন্ট বাস – স্মৃতির জানালা আমাকে নিমিষে ক্যাম্পাসের আকাঁবাঁকা পথ ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে আসে। আমি পুরনো পথ ধরে হাঁটতে থাকি। হাঁটতেই থাকি … !
লোকপ্রশাসন বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ ও সহপাঠী বন্ধুদের প্রিয়মুখগুলো আমার দৃষ্টি ঝাপসা করে দেয়! আমার চোখ ভিজিয়ে দেয়!
অনেক স্মৃতিবিজড়িত পুরাতন শামসুন্নাহার হলের ছয় নম্বর কক্ষ। মনে পড়ে, মাঝরাতে টিনের চালে বৃষ্টি পড়লে মায়ের জন্য মন কেমন করা শূন্যতা ! অল্প কিছুদিনেই বোনের মতো মায়াবী আদরমাখা রুমমেট সিনিয়র আপা ও অন্য বিভাগে অধ্যয়নরত ব্যাচমেট বান্ধবীরা পরিবারের নতুন সদস্যের মতো আপন করে নেয়। গৃহকাতর এই আমিও সময়ের সাথে সাথে পরবাসী জীবনে অভ্যস্থ হয়ে গেলাম। ভালোবাসলাম চলমান পারসেন্টেজ শীট, শ্রেণিকক্ষের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখা সাদা কাশবনে মনে মনে ঘুরে বেড়ানো আর গ্রন্থগারের লাল ইটের সিঁড়িতে বসে জনারণ্যে একা হয়ে যাওয়া …!
বরাবরই শামুকের খোলস আমার । তাই বন্ধুদের কোরাসগানে গলা মেলাতে না পারলেও বুকের ভেতর তার আবেশ ছড়িয়ে যেতো। শাটলট্রেনের একটি ঘটনা এখনো মনকে প্লাবিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হতে দুপুর একটা বিশের শাটল ট্রেনে চট্টগ্রাম শহরে ফিরে যাচ্ছি। অধিকাংশ বিভাগের ক্লাস একটার মধ্যে শেষ হয়ে যেতো বলে এই সময়ের ট্রেনটাতে তুলনামূলকভাবে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি ভিড় হতো। যাত্রী আধিক্যের জন্যই হয়তো বা ট্রেনের গতিও অনেক কম থাকতো।
গ্রীস্মের দুপুরে প্রচণ্ড গরমে নাভিশ্বাস অবস্থা। বরাবরের মতোই ভিড়। নিষ্পাপ ঘনিষ্ঠতায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকে ছাত্রছাত্রীরা। প্রায় সবাই দরদর করে ঘামছে। রেললাইনের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ট্রেনটি কচ্ছপগতিতে হেলেদুলে চলছে। এ পথ যেন কখনো শেষ হবে না … ! এ সময়ে হঠাৎ গানের সুর ভেসে আসে। ট্রেনে উঠার পাদানিতে বসে থাকা একদল তরুণ কোরাস ধরেছে,‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে, অঝোরে ঝরবে …. !’ কী প্রচণ্ড গগনবিদারী ধ্বনি! যেন এই তরুণদল আকাশে মেঘ জড়ো করবেই..!
হেসে উঠলো অনেকেই। কী আশ্চর্য ! মনে হলো গানের সুরে সুর মিলিয়ে বগিজুড়ে হিমেল হাওয়া বয়ে এলো!
তারুণ্যের সেই উচ্ছ্বাস এখনো মনে পড়ে!
সময়। সময় মানুষকে এক করে। সামষ্টিক করে। আবার এই সময়ই ভালোবাসার মানুষগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার দিন এখন। আলিঙ্গন নিষিদ্ধ। নিজের এবং পরিবারের সুরক্ষায় নিজেকে গৃহে অন্তরীণ করে রাখতে হয়। করোনার সাথে যুদ্ধ করে মরতে মরতে জীবনের কাছে ফিরে আসে যে স্বজন তাকেও আমরা বুকে জড়াতে গিয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ি। দিন যায়। বছরও যায়।
এখন আশায় আশায় দিনযাপন – এই পৃথিবীতে একদিন করোনাকাল ইতিহাস হবে। আলোকিত এক সকালে ‘কোভিড আপডেট’ নিউজ বন্ধের ঘোষণা দেয়া হবে। আমি আবারো ফেলা আসা চেনা পথের পথিক হয়ে নির্বিঘ্নে হেঁটে যাবো … !
কবে ? আমরা কেউই এর উত্তর জানি না !