চিরসবুজ বনে সুদর্শন বাঁশ ঘুঘু

সমির মল্লিক, খাগড়াছড়ি | মঙ্গলবার , ১১ মার্চ, ২০২৫ at ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

বসন্তের বিকেলে হু হু বাতাস বইছে পাহাড়ের চূড়ায়। চূড়া থেকে যতদূর চোখে দেখা যায় ততদূর চিরসবুজ গভীর বন। বনের নিচে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ঝিরি। চারপাশে ভাদি, মেহগনি, বন শিমুল, অশ্বথ, ফুলশুমারীসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ। ভাদি গাছের নিচে লাল রঙের এক বুনো ফলের শাখা। পাখির কাছে খুব প্রিয় এ ফল। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ফলটি খেতে আসে কয়েক প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে রয়েছে জলপাই বুলবুল, শ্বেতাক্ষী, কালো মাথা বুলবুল।

বিকেলে হলুদ আলোয় ঝোঁপ থেকে হঠাৎ উড়ে আসল সবুজ ঘুঘু। গাছের মগডালে বসে একের পরে এক ফল খাচ্ছে সে। ঝটপট ছবি তোলা শুরু করলাম। রোদের আলোয় পাখিটি আরো অপরূপ হয়ে উঠেছে। প্রায় পাঁচ মিনিটে বেশ কয়েকটা ফল খেয়ে আবারো উড়াল দিল ঘুঘু। তারা মূলত পাতাঝরা, চিরসবুজ, বাঁশবনের বাসিন্দা। খুব সকালে ও বেলা শেষের দিকে খাবার খুঁজে বেড়ায়। কোনো রকম শব্দ পেলেই দ্রুতবেগে উড়ে যায়। বনের ভেতরে খুব কম উচ্চতায়ও বেশ দ্রুতগতিতে উড়তে পারে। এর মধ্যে বেশকিছু ছবি আর ভিডিও করে নিলাম। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের পাহাড়ি চিরসবুজ বনে সবুজ বা বাঁশ ঘুঘুর দর্শন এটাই প্রথম। এই বনে গত ৪ বছর ধরে পাখির ছবি তুললেও এর আগে বাঁশ ঘুঘুর দেখা মেলেনি। সবুজ ঘুঘুর আরেক নাম বাঁশ ঘুঘু। অনেক অঞ্চলে রাজ ঘুঘুও বলে। ঘুঘু প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন বাঁশ ঘুঘু। তার শরীরজুড়ে সবুজ রঙের ছটা।

রাজ ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু বা বাঁশ ঘুঘু (ইংরেজি নাম : Common Emerald Dove, Green Dove, Green-winged pigeon; বৈজ্ঞানিক নাম : Chalcophaps indica। কলাম্বিডি গোত্রের অন্তর্গত অত্যন্ত সুন্দর ঘুঘু।

স্থানীয় বাসিন্দা রবি চাকমা বলেন, পাহাড়ি ঝিরিতে ঘুঘুর বাসা আছে। এটি বিহার এলাকায় হওয়ায় এখানে শিকার নিষিদ্ধ। এ কারণে পাখিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। আশপাশের কেউ এখানে এসে শিকার করতে পারে না।

বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশন সোসাইটি অব সিএইচটির সংগঠক সাথোয়াই মারমা বলেন, পুরুষ ঘুঘুর পিঠের দিক এবং ডানা ধাতব সবুজ বা পান্না রঙের; পেটের দিক গোলাপী ধূসর বা উজ্জ্বল গোলাপী। মাথা এবং ঘাড় ধূসরাভ। কপাল ভ্রু এবং কাঁধ সাদা। ঠোঁট লাল এবং পা ও পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী ঘুঘুর রঙ প্রায় পুরুষের মত, তবে কপাল ও ভ্রু ধূসর, মাথা এবং ঘাড় বাদামী, কাঁধে সাদা পট্টি নেই বা অস্পষ্ট। পিঠের উপর সাদা ও কালো মোটা পট্টি। লেজ ও ডানার ডগা কালো। বাচ্চা দেখতে অনেকটা মায়ের মতো হলেও এদের ঠোঁট বাদামিধূসর, কপালে দুটো ধূসর দাগ, লেজের দিকটা লালচেবাদামি, গলা ও দেহের নিচের অংশের পালকের প্রান্ত হলদে।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ি বনে, বিশেষত চিরসবুজ বনে সবুজ ঘুঘু দেখা যায়। এছাড়া যেসব এলাকায় বাঁশ বা ঘন ঝোপ জঙ্গল রয়েছে সেখানেও এদের দেখা যায়। তবে শঙ্কার বিষয় হলো শিকারীদের উপদ্রবের কারণে বাঁশ ঘুঘু হারিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে শিকারের প্রবণতা বেশি যেখানে বাঁশ ঘুঘুসহ অনেক প্রাণীই হারিয়ে যাচ্ছে। শিকার বন্ধে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আমরা কাজ করছি। বনবিভাগেরও আরো তৎপর হওয়া উচিত।

বাঁশ ঘুঘু দৈর্ঘ্যে কমবেশি ২৫ সেন্টিমিটার। এদের ওজন হয় সর্বোচ্চ ১৩৫ গ্রাম। ঘুঘু বাঁচে ছয় থেকে সাত বছর।

খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বলেন, বাঁশ ঘুঘু আমাদের একটি আবাসিক পাখি। পাহাড়ি বনে এদের দেখা যায়। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনানুসারে এ প্রজাতি সংরক্ষিত। পাখি শিকারে শাস্তির বিধান রয়েছে। আইন অনুযায়ী পাখি শিকার করলে সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। গত বছর একাধিক অভিযানে পাহাড়ি ময়নাসহ একাধিক বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে বনে অবমুক্ত করেছি। পাশি শিকার বা পাচারের তথ্য আসলে আমরা অভিযান চালাই।

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, ফিলিপাইন, জাপান, পাপুয়া নিউগিনি, চীনের দক্ষিণাংশে সবুজ ঘুঘুর প্রধান আবাস। এরা সাধারণত বর্ষার আগে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ডিম দেয় বেশি। ছোট গাছ, বাঁশঝাড় বা ঝোঁপঝাড়ে কয়েকটি কাঠিকুটি জড়ো করে ছোট্ট ও অগোছালো বাসা বানায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলামের পদত্যাগ
পরবর্তী নিবন্ধশিশুদের কেনাকাটায় ব্যস্ত অভিভাবকরা