কবি শুক্লা ইফতেখার কবিতায় বলতে চান তাঁর সকল না–বলা কথা, সকল অনুক্ত বেদনা। উপমায় উৎপ্রেক্ষায় বাঙ্ময় করে তুলতে পারঙ্গম তাঁর নিসর্গপ্রীতি তাঁর মানবপ্রেম, ভালোবাসা ও বিরহগাথা। কবির চিন্তা ও কল্পনা কখনো জরা ও জড়তা আক্রান্ত নয়। চিন্তায় কবি জঙ্গম ও চিরনতুন। কবি নতুনদের আবাহন জানান তাঁকেও ডেকে নিতে তাদের যেকোনো বিপদ ও বিপন্নতায়, যেকোনো অমীমাংসায়। নবীন প্রাণের সঙ্গে সংযুক্ততার এ আকাঙ্ক্ষা সহজেই কবি শুক্লা ইফতেখারকে সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম করে দেয়, একান্নবর্তী করে তোলে।
‘সম্পর্কের স্বরলিপি’ কবির প্রথম কাব্য। তারপর কবি আর থেমে থাকেননি। মূলত, কবিতাকে যে কবি সম্পর্কের স্বরলিপি অভিধায় বিধৃত করতে জানেন তিনিই তো কবি। যাপিত জীবনের সামগ্রিক সাম্পর্কিক সূত্রসমূহের স্বরলিপিই তো তাঁর এ–যাবৎ কালের লেখা তাবৎ কবিতা। ২০২৫–এর অমর একুশের বইমেলায় খড়িমাটি প্রকাশ করেছে কবির চতুর্থ কাব্য-‘একান্নবর্তী আকাঙ্ক্ষা’।
অনাদিকাল থেকে আকাঙ্ক্ষার আকাশ অপার, অবারিত এবং যৌথতায় সংযুক্ত ও সমৃদ্ধ কিন্তু কালের কালান্তক আবর্তে সমূহ আকাঙ্ক্ষা আজ ক্রম অপস্রিয়মাণ, ক্রমাগত বিলীয়মান। হড়কে যাচ্ছে সারাক্ষণ অলক্ষ্যে, আলগোছে। সংবেদী কবির কলমে সম্পর্ক যাপনের রহস্যময় বাঁক ও ব্যাকরণ কতোটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে তার উদাহরণ তাঁর ‘অস্পষ্ট’ শিরোনামের কবিতাটি:
‘সে–ঘটনার দীর্ঘদিন পর তোমাকে সেদিন
দূর থেকে দেখলাম।
খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ঝাঁপি খুলে তোমার সাথে গল্প করি–
কাছে গেলাম।
কী বলবো, তা–ও বেশ একটুখানি গুছিয়ে নিলাম।
কিন্তু হঠাৎ এ কী!
অজানা এক অস্পষ্টতায় যে জড়িয়ে যাচ্ছি ক্রমশ।
কথা আর শুরু করতেই পারলাম না।
ফেরিতে উঠতে গিয়ে টুপ করে যেন
নদীতে পড়ে গেলাম।’
কী অনবদ্য!
যে অসামান্য কাব্যকুশলতায় কবি সঙ্গিন একটি পরিস্থিতি ও তার পরিপ্রেক্ষিত এঁকেছেন তাতে কবিকৃতির সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি উপলব্ধি করতে পাঠকের বেগ পেতে হয় না। আশ্রয়–প্রশ্রয়ের ফেরি নয় প্রবহমান জলধারাই যেন কবির উদ্ধার।
সম্পর্কের যেকোনো ধরনের অস্পষ্টতা আমাদের দৃষ্টিগত স্বচ্ছতা নষ্ট করে। কবির উচ্চারণে জিজ্ঞাসা তাই আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে:
‘বলো তো, কুয়াশায় আবৃত থাকলে কি
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়?’
শুক্লা ইফতেখার অল্পকথার কবি। সংক্ষিপ্ত ও মিতায়তন হলেও তাঁর প্রতিটি কবিতাই সারগর্ভ ও পূর্ণায়ত।
অসুস্থ তাড়াহুড়ো আর শতধাবিভক্ত লক্ষ্যে যাপিত এ সময় ব্যাধিগ্রস্ত। আজকের দিনে মানুষের হাতে সময় নেই অকাজের কাজ কবিতা পড়ার। কবি শুক্লা ইফতেখার আজকের ও আগামীর পাঠকের মনস্তত্ত্ব বুঝতে ভুল করেননি। অনুভব ও ভাবনার সার–নির্যাস আকারে উপস্থাপন করেছেন তিনি তাঁর কবিতা। তাঁর কবিতা পাঠমাত্রই মনের মাঝে চিন্তার একটা ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। সক্রিয় হয়ে ওঠে মন ও চিন্তন। সম্পর্ক–সজাগ হয়ে ওঠে চৈতন্য। অকপট ভালোবাসার চৌহদ্দিতে ছলনা অবাঞ্ছিত, অপাঙক্তেয়। কবির তীর্যক উচ্চারণে তা হয়ে ওঠে আরও অধিক সূক্ষ্মও শানিত:
‘জানো না,
ভালোবাসা আর ছলনা এক ঘাটে জল খায় না?’
সাম্পর্কিক নির্ভরতাই যে সম্পর্কের স্বরলিপি রচনা করে, রচনা করে সম্পর্কের লাগসই ‘সাঁকো’ তা আরও সঘন স্বল্পায়তনে মূর্ত হয়ে ওঠে যখন উপমা–উৎপ্রেক্ষায় কবিতায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে–
‘রাতের খোঁপায় ফুল গুঁজে দেয়
দিনের আয়ের স্বচ্ছলতা–
দিনের সকল দুঃখ ঘোচায়
রাতের আদর–নির্ভরতা।
দুইটি দেহের মধ্যিখানে একটি সাঁকো পাতা।’
কবি প্রেমময় প্রতিশ্রুতিভরা পূর্ণিমা–প্রভায় স্বচ্ছন্দ। স্মৃতিকাতর কবির কণ্ঠে তাই হৃদয়মথিত গুঞ্জরণ:
‘আজ আমার সুনসান নিঃসঙ্গতায়
সেই সব স্মৃতিরা জোছনা ছড়ায়।’
স্মৃতির মায়ায় অযত্নের উঠোনকেও যে
নিকোনো দেখায়।’
কবির কাছে নীরবতা হিরণ্ময়। কবি নিশ্চিত জানেন অন্তর্গত অনুভবের আলোয় একদিন উদ্দিষ্ট জনের ভুল ভাঙবে এবং তখন মেয়াদ–উত্তীর্ণ সে–বেলায় প্রত্যাবর্তন শুধুই অসম্ভবের দ্যোতনা জাগাবে। তার বেশি কিছু নয়।
কবির অন্তরঙ্গ উচ্চারণে সে–খেদ মাথা তুলেছে আত্ম–জিজ্ঞাসার কাব্যিক প্রকরণে:
একদিন হয়তো তুমি আসবে ফিরে
অনুতাপের অর্ঘ্য নিয়ে।
সেদিনের সেই আমি ফিরবো কি!
কবি শুক্লা ইফতেখারের কবিতার মানব–মানবীরা সম্পর্কের স্বরলিপি বয়নে প্রেমে–ভালোবাসায় এতটাই সংবেদী যে প্রায়শই একটা উপায়, একটা পথ, একটা অনিবার্য উদ্ভাবনের কথা উঠে আসে। কবির ‘বন্ধন’ কবিতাটি কাব্যকুশলতায় সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে দারুণ এক ঈসপিয় মিথের পুনর্বয়ন–পুননির্মাণ হয়ে ওঠে–
তোমরা পরস্পর পুনঃপুন দেখা করে, কথা বলে,
মান–অভিমান অনুযোগ ভুলে
হৃত বন্ধনটির নাগাল পাও কিনা দ্যাখো–
কাকটা যেমন একটা একটা করে পাথর ফেলে
কলসির পানির উচ্চতা বাড়িয়ে তৃষ্ণা মিটিয়েছিল।
সৃষ্টির মাধুর্যঘন কবির যাপিত জীবন কি দুঃখ–বেদনামুক্ত! এ অনুক্ত জিজ্ঞাসার জবাবে কী হতে পারে কবির বয়ান!
দুঃখদুর্দশা জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ। কবিকে সেসবের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। পালিয়ে বাঁচার পথ রুদ্ধপ্রায়। যাপিত জীবনে বেদনাদীর্ণ মানুষের চারদিকে থাকে বাধা ও প্রতিবন্ধকের প্রাচীর। পালাবার পথ দুর্লক্ষ্য। সামনে পেছনে তাকে ঘিরে থাকে আতঙ্কের কাঁটাতার, সন্দেহের কাঁটাতার, অপ্রকাশিত বেদনার কাঁটাতার, সর্বোপরি অবদমনের কাঁটাতার কিংবা থাকে অকারণ অভিযুক্ততার কাঁটাতার। এ–সব প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে অনতিক্রমণের এক প্রগাঢ় বেদনা। কবি শুক্লা ইফতেখার তাঁর ‘কাঁটাতার’ শীর্ষক কবিতায় সেই রঙহীন ধূসর বেদনার কবি হয়ে উঠেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে কবির তৃতীয় কাব্যের অসামান্য কাব্যিক শিরোনাম ‘যাপন যদিও আপন কাঁটাতারে’। উল্লেখ্য, এ–কাব্যের ‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতাতেও কবি সম্পর্ককেই গুরুত্ব দেন সর্বাধিক এবং নিজের সাম্পর্কিক অবস্থানের কথা বলতে গিয়ে উচ্চারণ করেন:
‘এই তো আমি,
আমি এখানেই আছি দাঁড়িয়ে
নিজেদের বোঝাপড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রান্তরে।’
একবিংশ শতাব্দের কবি শুক্লা ইফতেখার তাঁর ‘সন্তান’ শীর্ষক কবিতায় আজকের পাথর সময়ের নির্মম বাস্তবকে তুলে ধরেন অসামান্য শব্দচ্ছবিতে। কবিতাটিতে মায়ের অপত্য আর্তি এবং সন্তানের নিরাবেগ উচ্চারণ এক ভিন্ন রকম নিষ্করুণ আবহ তৈরি করে।
এবং অনিবার্যভাবেই কবিতাটি পড়া হয়ে যায়:
সুখে–অসুখে মুঠোফোনে খবর রাখে
বড়ো আদরের ছেলেটি তাহার।
দেশেই থাকে, দূরে দূরে পাতে সংসার–
অুন্দ্র প্রহরায় তার বিপুল সম্পদের ভার।
মা বলে,
“যখন জ্বরের শয্যায় থাকি
কিংবা বসি একাকী আপনমনে
আমাদের সেই দক্ষিণের আকাশভরা বারান্দায়,
বাবা রে–
কখনও সখনও হাত দুটি তোমার
আমার হাতে দিয়ো।”
মা, একলা মায়েরা একা কীভাবে থাকে
ভালো করে একটু শিখে নিয়ো।”
অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন একজন সমাজদ্রষ্টা কবি এভাবেই তুলে আনেন সমাজের ভেতর ও বাহির তাঁর একান্ত নিজস্ব মানবিক সক্ষমতায়।
নানারকম সম্পর্ক, হরেকরকম বন্ধুতা ও বিশ্বাসের ছলাকলায় আজ নানাভাবে বিপর্যস্ত। সে–সব বিষয় কবির কবিতায় ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় উন্মোচিত। সম্পর্কের দ্বিমুখী বৈপরীত্য বন্ধুতার কালো–সাদা দুপিঠ নিবিড় কাব্যকুশলতায় ফুটে উঠেছে কবির ‘কে তুমি বন্ধু বলো– ১ ও ২ শিরোনামাধীন দুটো কবিতায়।
প্রথম কবিতায়–
কে তুমি বন্ধু বলো
খরায় ও বৃষ্টিতে তুমিই দরজা খোলো।
কে তুমি বন্ধু বলো
আমার অভ্রান্ত ইচ্ছেগুলো ইঙ্গিতে বোঝো।
গোপনে গীত নৈঃশব্দের যত গান
কান পেতে শোনো।
কে তুমি বন্ধু বলো
বাসনার বাঁকাস্রোতগুলো তুমিই স্পষ্ট চেনো।
তাই আমার অন্তর্লীন আনন্দ ও অশ্রু
তোমার বুকে তুলে রাখো।
আহা, কে তুমি বন্ধু বলো!
দ্বিতীয় কবিতায় উল্টো ছবিটাও নিদারুণ অর্থদ্যোতনায় ব্যঞ্জিত যেখানে অস্বচ্ছ বেড়ার আড়ালে ভূমিদস্যুদের উদগ্রতায় লোপাট হয়ে যায় সম্পর্কের সৌহার্দ্য এবং যৌথ সমপর্ণের অঙ্গীকার। সম্পর্কের সৌন্দর্য, মাহাত্ম্য এবং বাস্তবতা ঠিক সবদিকে ছড়িয়ে পড়া বিস্তৃত রৌদ্রের সত্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে কবি এমনটাই চিত্রিত করেছেন তাঁর উপরিউক্ত কবিতায়।
প্রবচনধর্মী এক পঙ্ক্তির কবিতা লেখায় কবির মুন্সিয়ানা যেকোনো পঙক্তি পড়ামাত্রই উপলব্ধি করা যায়। জীবনাভিজ্ঞতার নির্যাস নির্ভর এ–সব কবিতা হয়ে ওঠেছে প্রজ্ঞা ও আনন্দের এক নিখাদ নির্মাণ–
প্রণয়যাত্রায় তুমি আমার প্রথম যাত্রাবিরতি। (প্রথম প্রেমে)
ঠোকরানো যার স্বভাব, তার কি বস্তুর অভাব? (স্বভাব)
চিত্তে প্রসাদ থাকলে চিলেকোঠাও রাজপ্রাসাদ। (চিলেকোঠা)
অনাদিকাল থেকেই মিথ্যেচর্চা সমূহ সম্পর্কের পায়ে কুড়োল মেরে চলেছে। মিথ্যে আরোপণ বা অন্ধকারের বিস্তরণ সম্পর্কের ভিতে চিড় ধরিয়ে দেয়। কবির ‘অন্ধকার’ শিরোনামের কবিতায় উপর্যুক্ত তথ্যই সত্যের অধিক হয়ে বেজে উঠেছে–
‘দরজাটা খুলবি না, একদম খুলবি না–
কেউ এলে বলবি, বাবা নেই বাসায়।’
পুত্রের করোটিতে পিতা গুঁজে দেন
এক ঘোর অন্ধকার সবার অলক্ষ্যে–
সম্পর্কের শেকড় হতে মাটি সরে যায়
ঠিক সেদিন থেকে।
কবির দ্বিতীয় কাব্য ‘দীর্ঘদিন বৃষ্টিহীন’। এ–কাব্যে ছড়িয়ে আছে দুপঙ্ক্তির অনেক মণিমঞ্জুষা। এ–সব থেকে দু–একটি পাঠ, সন্দেহ নেই, পাঠককে মুগ্ধ করবে, আনন্দ জোগাবে:
বলো, জল থেকে অশ্রু কতোদূর?
দৃশ্যপট বদলে যেতে লাগে যতোদূর।
(অশ্রু)
ভালোবাসা মুক্তির সনদ, মুষ্টিভিক্ষা চেয়ো না–
আমার অমিত্রাক্ষর তুমি অন্ত্যমিলে ছেয়ো না।
(ভালোবাসা)
মৃত্যুর ছলনা কে বোঝে?
জীবন কোলে বসে মুচকি হাসে।
(মৃত্যু)
কাব্যের শেষ কবিতা ‘যদি এমন হয়’।
আত্মজৈবনিক রীতিতে রচিত কবিতাটিতে পরাধীনতার দুঃস্বপ্নের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার স্বপ্নের বিজয়–আখ্যান যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে মুক্তিকামী নির্যাতিত মানুষের রক্তক্ষরণের যে মর্মান্তিক বয়ান তা কবি বিভীষিকাময় স্মৃতির ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে অল্পকথায় উপস্থাপন করেছেন। পাকিস্তানি সেনাদের হতে যুদ্ধকালে আমাদের যুবতী–কিশোরীদের নির্মমভাবে ধর্ষিত ও নির্যাতিত হওয়ার মর্মন্তুদ ইতিহাস বর্ণনা করে লিখেছেন:
‘বাঁচবো যতদিন, বাঁচবো স্মৃতির লাশকাটা ঘরে।’
এই তো কবি শুক্লা ইফতেখার। একান্নবর্তী আকাঙ্ক্ষাসমূহের প্রিয় কবি।
মূলত, একজন সমাজ অনুবর্তী কবির একান্ত আকাঙ্ক্ষাগুলো রাগে–অনুরাগে–সংরাগে–প্রেমে–দ্রোহে অনুভবের উষ্ণতায় চিন্তার নিবিষ্টতায় আপনা থেকেই হয়ে ওঠে একান্নবর্তী, যৌথতায় সমর্পিত। তাঁর এ কাব্যের কবিতাগুলো সকল বিবেচনাতেই পাঠকের সকল বাসনার নামান্তর–একান্নবর্তী আকাঙ্ক্ষা।
পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠুক ‘একান্নবর্তী আকাঙ্ক্ষা’র প্রতিটি কবিতা।