চিরকুটের সংখ্যাগুলো

শৈবাল বড়ুয়া | শুক্রবার , ২ অক্টোবর, ২০২০ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

করোনা ভাইরাসের জন্য সবাই আতঙ্কে। তাই সবার মতো সৈকতও মুখে মাস্ক পড়ে নেয়।

সৈকত বাসা থেকে যখন বের হয় তখন সূর্য মধ্য গগনে। বাড়ির সামনের গলিতে নেমেই মনে হয় পার্সটা বাড়িতে ফেলে এসেছে ও। প্যান্টের পকেটে হাত গলিয়ে সৈকত ঠিকই বুঝতে পারে, পার্সএর হদিস নেই। কিন্তু দু’আঙ্গুলের ফাঁকে একটা ছোট্ট পুরোনো কাগজের চিরকুট বেরিয়ে এলো। এটি কোথা থেকে এলো। এ মুহূর্তে সৈকতের কিছুই মনে পড়ছে না।

চিরকুটে লেখা সংখ্যাগুলো দেখে ধারণা হলো এটি সেল্‌ ফোন নম্বর। নামধামকিছুই নেই। নম্বরটা কার! সৈকত মনে করতে পারে না। এই চিরকুটটা ওর কাছে কিভাবে এলো ! এও কেমন রহস্যজনক ঠেকে। বাঁ হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইলটা একবার চোখের সামনে ধরে ও। ডিসপ্লে বাটন চেপে নম্বরটার হাদিস পায় কিনা, এই প্রচেষ্টা চালায়। নাহ্‌, নম্বরটা অচেনা।

সৈকত আনমনে বিড়বিড় করতে করতে ঘুরে দাঁড়ায়। আবার উল্টোপথে ঘরে ফিরতে হবে। পার্সটা নিতে হবে। ওটা বোধ হয় বেড সাইড টেবিলের ওপরেই আছে। সৈকত দ্রুত পা চালায়। বাড়িতে ঢুকেই সোজা নিজের রুমে।

কিন্তু বেড সাইড টেবিলের ওপর পার্সটা নেই। এই মুহূর্তে সৈকতের কাছে এসবই রহস্য মনে হয়। পকেটে পার্স খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেলো একটা চিরকুট। তাতে অচেনা নম্বর। আর পার্সটাও যথাস্থানে নেই। এসব যেন ভুতুড়ে ব্যাপার। সৈকত অবাকই হয়। এতে চমকও কম নয়। ও নিজেই নিজের স্মৃতিটাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করে। সৈকতের চোখে চশমার লেন্সটা পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে গেছে। একবার মনে হলো, ও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। পার্সটা কোথায় গায়েব হয়ে গেলো। আর এই চিরকুটটাই বা কে কখন, তাকে দিলো। এসব ভেবেই মাথাটা কেমন ঝিম্‌ঝিম্‌ করে ওঠে।

:বৃষ্টি! বৃষ্টি !! কলেজ পড়ুয়া ছোট বোনটিকে চিল্লিয়ে ডাকে সৈকত।

: কী হলো ভাইয়া ! কলেজ পড়ুয়া সৈকতের হাঁক শুনে বৃষ্টি ছুটে আসে।

: বেড সাইট টেবিলের ওপর আমার পার্সটা ছিলো। কোথাও খুঁজে পাচ্ছি নারে।

: তোমার প্যান্টের ব্যাক পকেটে ঢুকিয়েছ নিশ্চয়ই।

: নারে, কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। পকেট হাতড়ে পেলাম এই চিরকুটটা। তাতে একটা সেল ফোন নম্বর। দেখতো, নম্বরটা কার চিনতে পারিস কি না?- চিরকুটটা বৃষ্টির হাতে ধরিয়ে দেয়। বৃষ্টি প্রথমেই ভাইয়াকে সাবধান করে করোনা আতঙ্ক নিয়ে ঘরের বের না হতে। তারপর ভুরু কুঁচকে নাম্বারটা বার কয়েক আওড়ালো বৃষ্টি। নাহ্‌, নম্বরটা বৃষ্টির অপরিচিত। হা হয়ে সৈকতের দিকে তাকায় বৃষ্টি।সৈকতের চোখ বলে দেয়, বোনের কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চায় সৈকত।

: চিরকুটটা তোমার পকেটে রাখো। আপতত পার্সটা খুঁজে দেখা যাক্‌।বৃষ্টি ভরসা দেয় ভাইয়াকে।

বিছানা, চাদর, বালিশ, তোষক সবই তুলে ঝেড়ে দেখে বৃষ্টি। খাটের তলায় হাত্‌ড়েও কোথাও হদিস নেই, পার্সটার। দুজনেই হতাশ হয়ে পড়ে। ভাইবোন কেউ কোনো যুক্তি খাড়া করতে পারে না। পার্স গায়েব হওয়ার বিষয়ে কাকেই বা খামোখা দোষ দেবে? তারা দু’জনই সন্দেহ করে বাইরের কেউ হয়তো পার্সটা সরিয়েছে। কিন্তু সেকে? এসব আদ্যোপান্ত নানা ভাবনার মাঝে ওরা দুজনই বাবার গভীর হাঁক শুনতে পায় হঠাৎ।

: সৈ, তোর মানিব্যাগটা টয়লেটে আয়নার সামনে ট্রেতে ফেলে এসেছিস্‌ কেন? এতো ভুলো মন তোর! পড়ালেখা করিস এ ধরনের অমনোযোগ নিয়ে? সত্যিই চিন্তার ব্যাপার। বাবাও সৈকতকে ধমকায়, করোনায় ঘর বার না করার জন্য। কিন্তু সৈকতকে আজ লাইব্রেরি যেতে হবে। বাবার মুখে এতো কথা শুনে কাঁচুমাচু হয়ে পড়ে সৈকত। বেকুব বনে যায় ও। ঘুম থেকে জেগে পার্স হাতে নিয়ে ও কেন টয়লেটে ঢুকেছিলো তারও কোনো হিল্লে করতে পারলো না।তবু যাহোক পার্সটাতো পাওয়া গেলো। কিছুটা শান্ত হয় ও।

বৃষ্টি কিন্তু হেসে কুটিকুটি। সকাল সকাল টয়লেটে টাকা পয়সার কী এমন দরকার ছিলো ভাইয়ার। আর ধরা খেলো মোক্ষম বাবার হাতে, বৃষ্টির হাসি থামতেই চায় না।

বৃষ্টির বাঁধ ভাঙ্গা হাসি সৈকতকে বিদ্ধ করে। পার্স হারানোর ঘটনার জন্য সে হাসির পাত্র হলো। নিজের উপর নিজেরই কেমন যেন বিরক্তি জন্মে। রাগে গজর গজর করতে করতে ও আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। চিপাগলির পথ ধরে মেইন রোডের দিকে পা চালায় ও। মনটাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। মানিব্যাগটাতো অন্তত পাওয়া গেলো। কিন্তু পকেটের এই কাগজে ছোট্ট টুকরোটা! এই নম্বরের মানুষটাই বা কে!-সৈকতকে আবার ভাবিয়ে তোলে এসব। কিছুতেই মনে পড়ছে না। আবার নিজেই ভাবে, সকালে ঘুম থেকে জেগেই টাকাপয়সার ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে যেমনটি টয়লেটে ঢুকে পড়েছিলো ঠিক তেমনিই চিরকুটটাও মনের ভুলে সৈকতের হাতে এসে পড়েছে। আনমনে কাগজের টুকরোটা হয়তো বা ওই ঢুকিয়েছে প্যান্টের পকেটে।

ধুত্তোর, বাইরে যাওয়ার মুখেই বাধা পড়লো। সৈকত বিরক্তি নিয়ে পা বাড়ায়। আজ সে ভার্সিটিতে যায় নি। পাবলিক লাইব্রেরিতে ফেরদৌসশামীমরা আসবে টিউটোরিয়্যালের নোট তৈরি করতে। ওদের সাথে স্টাডিতে বসবে সৈকতও । খুঁতখুঁতে মনটা বার বার খোঁচা দেয় সৈকতকে।

পকেট থেকে সেল ফোনটা বার করে সেভ লিস্টটা আবার চেক করে সে। নাহ্‌ এতে নম্বরটার কোন হদিস নেই। একবার ভাবলো কাগজের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলবে ডাস্টবিনে। কিন্তু আবার মনে হলো, এটি হাতছাড়া করলেতো কোনো রহস্যেরই কূলকিনারা হবে না।

গলির মুখে মেইন রোডে এসে দাঁড়ায় ও। একটু সুস্থির হবার চেষ্টা করে। আশে পাশে রাস্তায় লোকজন কম কিছু লোক দিনের ব্যস্ততায় আছেন। কেউ ফিরেও তাকায়না সৈকতের দিকে। চারপাশের মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে সৈকত। সবার চোখেমুখে অস্থিরতার চিহ্ন করোনা আতঙ্কে। কিন্তু সৈকতে অস্থিরতা অন্যরকম। একদিকে করোনা আর অন্যদিকে স্টাডি।

চিরকুটের সংখ্যাগুলো সেলফোনে টিপেই দেখা যাক না কেন। আবার ভাবলো, অপ্রয়োজনে কাউকে বিরক্ত করা ঠিক না। অচেনা মানুষের মিস্‌ কল হলে কিছু আগড়মবাগড়ম বলা যায়। কিন্তু অচেনা নম্বরে রিং করে প্রথমে পরিচয়, এরপর ভূমিকা, বাগবিতন্ডা এবং সবশেষে বিরক্তিকর গালিগালাজ ইত্যাদি সেলফোনে শুনতে নারাজ সৈকত।

কিন্তু চিরকুটটার একটা হিল্লে হওয়া প্রয়োজন। কব্জির ঘড়িতে দুপুর দেড়টা বাজে। আলগোছে সময়টা দেখে নেয়। ফেরদৌসরা এতক্ষণ লাইব্রেরির টেবিলে স্টাডিতে বসে গেছে। সৈকতের চঞ্চলতা এখনো কাটেনি। গন্তব্যে যাওয়ার জন্যে রিক্সা নেবে, নাকি হেঁটেই রওয়ানা হবে? দ্বিধায় পড়ে সৈকত। এই মুহূর্তে কাঁধে ঝোলানো বইখাতার ব্যাগটা বেশ ভারী মনে হয় ওর। বাড়ি থেকে বেরোনোর ক্ষণ থেকেই নানা বিড়ম্বনায় আক্রান্ত হচ্ছে সৈকত। এর কোন কার্যকরণ খুঁজে পায় না ও। উদভ্রান্তের মতো একটা রিক্সায় উঠে বসে। রিক্সা চলতে শুরু করেছে।

রোদটা তেতে উঠেছে। রাস্তার ধারে গ্লাসে পাকা বেলের শরবত বানিয়ে খদ্দেরের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে শরবতওয়ালা। আর একটু এগিয়ে সৈকতের চোখে পড়লো তরমুজের ফালি, লাল টক্‌টকে। কয়েকজন ঘিরে রয়েছে তরমুজওয়ালাকে। আইঢাই গরমে ঠান্ডা হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। চালক রিক্সাওয়ালা ঘেমে নেয়ে উঠেছে।

রিক্সা পাবলিক লাইব্রেরির গেইটের সামনে এসে দাঁড়ায়। সৈকত ভাড়া মিটিয়ে তড়িঘড়ি করে প্রধান ফটক গলিয়ে লাইব্রেরি ভবনে ঢুকে পড়ে। ভবনের তিন তলায় শামীম, ফেরদৌস আর রেজাউল এতক্ষণ ওর মুন্ডু ফাটাচ্ছে। ওরাও সবাই করোনা ভীতিতে আছে। সবাই মাস্ক পরেছে। সৈকত করিডোরের ঢাল বেয়ে দৌড়ে উঠতে থাকে। করিডোরের ওমাথায় দুজন তরুণী। ওরা ত্রস্ত পায়ে নেমে আসছে। সৈকত দেয়ালের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওদের নামার রাস্তা করে দেয়। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের একজন হোঁচটের তাল সামলাতে না পেরে পাক খেয়ে পড়ে গেল। মেয়েটির কাঁধে ঝোলানো বইখাতার ব্যাগটা ছিটকে এসে পড়লো সৈকতের বাঁ পায়ের ওপর। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে চোট পেয়ে প্রাণ যায় অবস্থা, ও বসে পড়ে। কিন্তু বেশিক্ষণ ওভাবে থাকতে পারলো না। সৈকত দেখলো আঘাত পেয়ে মেয়েটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সঙ্গের মেয়েটি বান্ধবীকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। বান্ধবীর হাতে ভর করে মেয়েটি অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। সৈকত দেখলো, মেয়েটির পায়ের চামড়া অনেকটা ছড়ে গেছে। রক্ত ঝরছে। ওদের মুখের মাস্কও ছিটকে দূরে পড়েছে। পায়ের উপর আছড়ে পড়া ব্যাগটা তুলে নিয়ে সৈকত অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটার ওপর চাপ পড়ছে। তবুও ওদের সাহায্যে এগিয়ে গেলো সৈকত।

মেয়েটি খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সৈকতও তাই। পাবলিক লাইব্রেরির উল্টো দিকে কোনমতে ওরা এগিয়ে যায়। ওখানটায় ছোট একটা ফার্মেসি। ভেতরে ঢুকেই আহত মেয়েটিকে সরু বেঞ্চিটার ওপর শুইয়ে দেয়া হয়। কম্পাউন্ডার মেয়েটির পায়ের ছিড়ে যাওয়া অংশে ড্রেসিং করে। রক্ত ঝরা বন্ধ হয়েছে। যাহোক প্রাথমিক চিকিৎসা অন্তত পাওয়া গেলো।

সৈকত একটু সুস্থির হয়। আহত মেয়েটির বইখাতার ব্যাগ এখনো সৈকতের হাতে। ব্যাগটির গায়ে একটা নেইম কার্ড সাঁটা। সৈকত চকিতে দেখতে পায় নামটি। উপমা নাসরীন। এরই নিচে লেখা মোবাইল নম্বরটা। কয়েকবার বিড় বিড় করে আওড়ায় সংখ্যাগুলো।আরে এযে চিরকুটের সেই সেল ফোনের নম্বর।

সৈকত অবাক হয়ে ভাবতে থাকে। পেছনের ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করে। হপ্তা দুই আগে আরো একদিন লাইব্রেরিতে এসেছিলো সৈকতরা। সেদিন স্টাডি টেবিলে কাগজের টুকরোটা পড়ে থাকতে দেখে ফেরদৌস ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলো। তা দেখে শামীম হাহা করে ওঠে। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা ঠিক নয়। আপ্তবাক্যটা মনে করিয়ে দেয় সবাইকে। পরে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলবে এ ছুতোয় ফেরদৌসের হাত থেকে ওটা ছিনিয়ে নেয় শামীম।

বিষয়টা এরপর বেমালুম ভুলে গেছে সৈকত। কিন্তু এ মুহূর্তে ও পরিষ্কার বুঝতে পারে শামীম একটা খচ্চর। ওই ঘটিয়েছে এসব। চিরকুটটা কখন সেঁধিয়ে দিয়েছে ওর জিন্সের পকেটে সৈকত সেটা টেরই পায়নি। আর ওতে যে একটা মুঠো ফোনের নম্বর ছিলো তাও তার অজানা।

উপমার গল্পটা সৈকত জানে না। তবুও ধারণা করে, ছোট্ট কাগজে সেল ফোন নম্বর লিখে হয়তো কোনো বান্ধবীকে দিয়েছিলো উপমা। বান্ধবী মনের ভুলে ওটা লাইব্রেরির টেবিলে ফেলে গেছে।

এতসব ভাবনার চক্করে সৈকত খেই হারিয়ে ফেলে। ও দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। একবার দৃষ্টি ফেরায় উপমার দিকে। উপমার চোখে মুখে যন্ত্রণা। কিন্তু উপমা তাকিয়ে আছে সৈকতকে।

পায়ের আঙ্গুলটা ব্যথায় টন্‌টন্‌ করছে সৈকতের। উপমার বান্ধবী সৈকতকে একটা সিএনজি ডেকে দিতে বলে। এ মুহূর্তে সৈকত যেন ওদের অভিভাবক।

মোড়ের স্ট্যান্ড থেকে একটা সিএনজি নিয়ে আসে। উপমার ভারী ব্যাগটা বান্ধবীর হাতে তুলে দিয়ে সৈকত অনেকটা হাল্কা হয়।

উপমার ঠোঁটে আলতো হাসির রেখা। এ যেন কৃতজ্ঞতার ভাষা। সিএনজি চলতে শুরু করে। মোড় ঘুরতেই ওরা চোখের আড়াল হয়ে যায়।

সৈকত ফার্মেসির সামনে রাস্তায় দাঁড়ায়। চশমার লেন্সটা মুছে নেয়। সৈকতের চোখের সামনে এ মুহূর্তে চিরকুটের সংখ্যাগুলো ছবি হয়ে যায়। ক্যানভাসে একটি প্রতিকৃতি। সেই প্রতিকৃতি উপমার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅন্ধকালের প্রার্থনা
পরবর্তী নিবন্ধকীর্তিমান আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ