আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে, ইতিহাসের এক ব্রাহ্ম মুহূর্তে সত্যজিৎ ও ঋত্বিকের সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের ধনুক ধরেছিলেন মৃণাল সেন। আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে তিনি দু’হাতে সব ধরনের রিয়েলিজমের পর্দা ছিঁড়ে ফেলেছেন বারবার। তাই হয়তো অশ্রুপাত ছিল তাঁর প্রবলভাবে অপছন্দের বিষয়। ১০১ তম জন্মতিথি উপলক্ষে তাঁরই শ্রদ্ধার্ঘ্যে ওটিটি প্ল্যাটফরম হৈচৈ–য়ে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত অঞ্জন দত্তের ‘চালচিত্র এখন’ যেন সময়কে অতিক্রম করা এক জাদু। স্বাভাবিকতাবাদী চলচ্চিত্র ধারার নির্মাতা মৃণাল সেনের মতো ‘নাম’–এর চরিত্রায়ণ! তাঁর ছবি ‘চালচিত্র’ এবং সেই ছবির মূল কুশীলব ও বর্তমান ছবির পরিচালক অঞ্জন দত্তর নস্টালজিয়া– সবটা নিয়ে হাইপ তৈরির যথেষ্ট উপকরণ মজুত আছে “চালচিত্র এখন” চলচ্চিত্রে। ছবিতে আমাদের মতো ফেসবুকি দুনিয়ায় মেরুবিভাজিত সাধারণ মানুষ দেখতে পেল, চরিত্র থেকে সিনেমার ফরম্যাটে কতকটা একই রকম, মানে অগোছালো– ইরেস্পন্সিবল– ছকভাঙা– ডোন্ট কেয়ার মৃণাল সেনকে এবং অঞ্জনকেও। এছাড়াও ভীষণরকম আলাদা (সমষ্টি বনাম ব্যক্তি) দু’টি বিপরীত সত্তার সুন্দর ও সৎ সহাবস্থানকে। ছবির প্রথম দিকে মৃণাল সেনের সংলাপ, “আই হেইট ক্যালকাটা, আই লাভ ক্যালকাটা/ আই অ্যাম এক্সসাইটেড অ্যাবাউট ক্যালকাটা/ আই অ্যাম ডিজঅ্যাপয়েন্টেড অ্যাবাউট ক্যালকাটা/ ক্যালকাটা ইজ মাই এল ডোরাডো”–এ বা অঞ্জন দত্তের গান ‘এ পোড়া শহরে’, এমনকি শেষ দৃশ্যে, “কেমন লাগছে শহরটা?” প্রশ্নের উত্তরে সিনেমার রঞ্জনের (শাওন চক্রবর্তী) “দারুণ”টুকুর প্যাশনেট এক্সপ্রেশনে মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। সাদা পাজামা–পাঞ্জাবি, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা আর সিগারেটের জ্বলন্ত ধোঁয়ায় মোড়া আদ্যোপান্ত জঙ্গম বাঙালি ‘মৃণাল সেন’কে ইন্টেলেকচুয়াল অহং বিবর্জিত সহজ অথচ প্রত্যয়ী করে অবিকল মৃণাল সেন হয়ে উঠেছেন অঞ্জন দত্ত। শুটিংয়ের ফাঁকে এক জায়গায় রঞ্জনকে (‘চালচিত্র’–এর দীপু) জীবনের গল্প বলছেন কুণাল সেন! “সাইকেল করে যাচ্ছি যাচ্ছি, রোদ্দুরের মধ্যে যাচ্ছি যাচ্ছি যাচ্ছি। যাচ্ছি আর ফিরে আসছি! তারপর একদিন আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে কমপ্লিট উলঙ্গ দেখে মনে হল, সিনেমা বানাবে তুমি! তুমি!” স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণার সুর গলায় এনে মুহূর্তেই নেতিবাচক আত্ম সমালোচনায় ভেংচি কেটে “ঘণ্টা বানাবে তুমি”–র অভিব্যক্তি স্তম্ভিত করে দেয় দর্শককে। ঘোর কাটতে না কাটতে যন্ত্রণার অনুষঙ্গে মিলিয়ে দেন রঞ্জনের আত্মদর্শনের থিয়েট্রিক্যাল ভাষাকে! এটাই তো নিজেকে নিজের চুল ধরে হেঁচড়ে টেনে দাঁড় করানো, নিজেকে ওলটপালট করে ঝাঁকানো, তারপর গোটা পৃথিবীটাকে তরতাজা দৃষ্টিতে দেখার ‘বাস্তব নির্মাণ’! শেষ দিককার একটা সিনে কুণাল বোঝাচ্ছেন, যে শটে ক্যামেরার কন্ট্রিবিউশন ৫০ শতাংশ, এডিটিং দেয় ৩০ আর মিউজিক ২০, সেখানে অভিনেতার কিছু না করাটাই শটটাকে বাঁচিয়ে দেয়। আর ক্যামেরা তখন আস্তে আস্তে বড় ফ্রেমে ধরছে দু’জনকে! ঠিক এইখানেই পরিচালক অঞ্জন দত্তের পার্সপেক্টিভ মারাত্মক। কমিউনিস্ট– হিপোক্রেট সব কাটাছেঁড়ার ঊর্ধ্বে উঠে শিল্পী মৃণাল সেন আসলে শিল্প ও সৃষ্টির সারকথা ‘হয়ে ওঠা’র দর্শনের প্রতিবিম্ব। শিল্প ও সমাজের প্রতি এই কমিটমেন্ট অতুলনীয়। সময়কে ব্যাকড্রপে রেখে সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্রষ্টার আত্মসমালোচনা সব সময় আধুনিক পদক্ষেপ। নিজেকে পশ্চাৎপক্ক বলাটা অবশ্য এ ছবির অঞ্জন দত্তের ক্ষেত্রে জাস্টিফায়েড নয়। কাম্যু বা সাত্র্র্ না–পড়া সাধারণ জীবনকে যখন বুঝতে শিখছে রঞ্জন, তখন তার কঠিন ব্যক্তিত্বে একটা মোলায়েম পরত পড়েছে । জীবনকে ‘দেখা’র বদল এক ধরনের আশাবাদকে প্রশ্রয় দেয়। ব্লকবাস্টার যুগের হিজিবিজি কন্টেন্টের মধ্যে এই প্রাপ্তি মন্দ নয়।