চারিদিকে প্লাস্টিক আর প্লাস্টিক

আলেক্স আলীম | বুধবার , ২১ জুন, ২০২৩ at ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

বিকেলবেলায় ঢাকার উত্তরায় হাঁটছিলাম স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য। হঠাৎ দেখি একটি মোটরসাইকেল রাস্তার মাঝখানে থামলো। পিছনে বসা সুদর্শনা একটি কোকের বোতল রাস্তার মাঝখানে ফেললেন। এরপর মোটরসাইকেল দমকা হাওয়ার বেগে চলে গেলো। এই বোতল যদি নালায় গিয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে আর ডেঙ্গু মশার জন্ম দেয় তাহলে হয়তো ঐ মহিলাই সরকার সিটি কর্পোরেশনের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিবেন।

দাঁড়িয়ে ভাবনায় হারিয়ে গেলাম। ঐ মহিলা তার পোশাকে তো একটি দাগও লাগতে দিবেন না। কারণ তিনি জানেন শাড়িটি অনেক দাম দিয়ে কেনা। আর দাগ পড়লে উনার রূপ ব্যাহত হবে।

কিন্তু তিনি কেন জানেন না দেশটাতো তারই অংশ। দেশের অস্তিত্ব আছে বলেই তিনি রূপচর্চা করতে পারেন। তার পোষাকের চেয়ে দেশটি অনেক বেশি দামে কেনা। তার ফেলে দেয়া বোতলের কারণে জন্মা নেয়া ডেঙ্গু মশা তাকে ডেঙ্গু আক্রান্ত করলে ঠিকই তো হাসপাতালে গিয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হবে। খরচ করলেই যে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে এমন গ্যারান্টি নেই। জীবনও বিপন্ন হতে পারে!

এভাবেই দেশের বেশির ভাগ মানুষ কি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছে না?

আমরা রূপচর্চা করে নিজেকে সুন্দর রাখছি। ঘরের ভিতরটা স্বর্গীয় করে তুলছি আর ঘরের বাহিরটাকে নরক বানাচ্ছি।

যাই হোক প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে শুরু করেছিলাম প্লাস্টিকেই সীমাবদ্ধ থাকি।

প্লাস্টিকের পরিসংখ্যান মারাত্মক ভয়াবহ। শুধু সচেতন হলেই হবে বলে মনে হয় না। ব্যবসা বাণিজ্যের এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের পরিবর্তনও জরুরি। এবার একটু পরিসংখ্যানে যাই। ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন প্লাস্টিকের বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৫ লাখ টনের বেশি। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের বাজার প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার। প্রায় ৫ হাজার ৩০টি ফ্যাক্টরিতে ১৫ লাখ মানুষ প্লাস্টিক উৎপাদনে কাজ করে। প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে ওয়ানটাইম প্লাস্টিক পণ্য। ৯৬ শতাংশ ওয়ান টাইম প্লাস্টিক আসছে খাবারের জন্য ব্যবহৃত পণ্য এবং প্যাকেট থেকে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন প্লাস্টিকের তেমন কিছু ছিলো না বললেই চলে। কিছু শিক্ষা উপকরণ ছাড়া (সার্পনার, ফাউন্টেন পেন, জ্যামিতিবক্সের জিনিস পত্র ইত্যাদি)। যে কয়েকটি প্লাস্টিকের উপকরণ ছিলো যেগুলো পুনঃপুনঃ ব্যবহৃত হতো। ফেলে দেয়ার কোনো কালচার ছিলো না। সফট ড্রিংকস বিক্রি হতো বোতলে। খাওয়ার পর সেই বোতল আবার দোকানে ফেরত দিতে হতো।

সময়ের ব্যবধানে জীবনকে সহজ করতে আমরা অতিমাত্রায় প্লাস্টিকের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। তাও আবার ওয়ানটাইম কালচার নিয়ে! আমরা যেখানে একটি দুইটি ফাউন্টেন পেন নিয়ে পুরো স্কুল জীবন চালিয়ে দিয়েছি সেখানে বর্তমানে একজন ছাত্রের প্রতি তিনচার দিনে একটি বল পেন লাগে। এবং একটি শেষ হলে সেটা আবর্জনা হিসাবে স্পেস দখল করে প্রকৃতিতে। জীবনকে সহজ করতে ওয়ান্টাইম কালচার শুরু করাটাই হচ্ছে সর্বনাশের মূল। যদি এমন ব্যবস্থা চালু করা যায় একটি পরিবারে দুইটি বাজার করার থলে থাকবে। প্রতিবার বাজার করার সময় এদুটো থলে ঘুরে ফিরে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু আমরা কী করি বাজার করে আনি সাত আটটা পলিথিন দিয়ে। কোনোটাতে কাঁচা মরিচ, কোনোটাতে তরকারী, কোনোটাতে মাছ ইত্যাদি। জিনিস বের করে তারপর কী করি সেটা সবাই জানে।

ফাউন্টেনপেন স্কুল কলেজে চালু করলে অসুবিধা কী? আমার জানা মতে সেন্ট প্ল্যাসিডস স্কুলে এখনো ফাউন্টেন পেন ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়। বল পেন একদম তুলে নেয়ার দরকার নেই। কোম্পানি পারে না ব্যবহৃত বল পেনগুলো টাকা দিয়ে সংগ্রহ করে নিতে? ওগুলো রিসাইকল করে আবার বল পেন বানাবে। এটি সব ধরনের জিনিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। যে কোম্পানি যত বেশি রিসাইকল করবে সেই কোম্পানি কে সরকার প্রণোদনা দিবে।

জীবনকে সহজ করতে গিয়ে নিজেরা যে প্লাস্টিক হয়ে যাচ্ছি সেটি একবার ভাবুন প্লিজ। না হলে কর্ণফুলী আর বঙ্গোপসাগরে প্লাস্টিক ছাড়া কিছুই থাকবেন না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেবক আসে যায়; কাটে না আমাদের দুর্দশা
পরবর্তী নিবন্ধকাছের মানুষদের উপর বেশিই প্রত্যাশা