চারদিকে প্রতারণার ফাঁদ

মানুষ হারাচ্ছে তিলে তিলে গড়া সঞ্চয়

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ২৫ মে, ২০২৪ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

প্রতারণার ফাঁদ পাতা ভূবনে, কে কোথায় বাধা পড়ে কে জানে। পদে পদে প্রতারিত হয়ে সহজ সরল মানুষ খোয়াচ্ছে তিলে তিলে গড়া সঞ্চয়টুকু। জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রেই প্রতারণার অক্টোপাসে বন্দি হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে প্রতারণার শেকড় ব্যক্তিপরিবার থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে এমন কিছু প্রতারক। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের প্রতারণার কাহিনী শুনে চমকে উঠেছেন কর্তাব্যক্তিরা। তাদের মতে অভিযানের পাশাপাশি একমাত্র সচেতনতাই পারে প্রতারণার এমন অভিনবত্বের লাগাম টেনে ধরতে।

চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা : নিজেকে পরিচয় দিতেন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে। সেখানে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। তাঁর কথার ফাঁদে পড়ে চাকরি প্রত্যাশীরাও দিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। তবে বছরের পর বছর কেটে গেলেও মিলতো না চাকরি। দীর্ঘদিন ধরে এমন প্রতারণা চক্র পরিচালনা করে আসছিলেন সীতাকুণ্ড উপজেলার মমতাজ বেগম। গত ২২ মে বুধবার অভিযান চালিয়ে সীতাকুণ্ডের প্রেমতলা কলেজ রোড এলাকার বাসা থেকে তাঁকে স্বামী মো. মুজিবুর রহমানসহ (৪৬) গ্রেপ্তার করে র‌্যাব৭। র‌্যাবএর সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) শরীফউলআলম জানান, মমতাজ ও তার স্বামী ২০২১ সালে মঞ্জুর আলম নামে এক চাকরি প্রত্যাশীর কাছ থেকে এনএসআইতে চাকরির কথা বলে ৩৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। আড়াই বছরেও চাকরি কিংবা টাকা না পেয়ে ভুক্তভোগী র‌্যাবের কাছের লিখিত অভিযোগ জানালে তাঁদের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বামীস্ত্রী মিলে এই প্রতারণা চক্র গড়ে তুলেছিলেন।

ফেসবুকে প্রতারণার ফাঁদ : ফেসবুকে নিজের জন্য ‘পাত্রী চাই’ স্ট্যাটাস দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন শিবলী নামে এক ব্যক্তি। ওই ফাঁদে পা দিয়ে এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। পতেঙ্গা থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) আশীষ কুমার দে জানান, আসামি শিবলী ‘আসলাম চৌধুরী’ নামে ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতেন। কয়েক দিন আগে তিনি ফেসবুকে ‘পাত্রী চাই’ লিখে কয়েকবার স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি নিজেকে পল্লী বিদ্যুতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং চট্টগ্রাম শহরে তাঁর নিজস্ব বাড়ি ও গাড়ি আছে বলে উল্লেখ করেন। ফেসবুকে পাত্রী চাই স্ট্যাটাস দেখে এক তরুণী শিবলীর সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন। তাঁকে বিয়ে করার কথা বলে গত ১৩ মে পতেঙ্গার চরপাড়ায় একটি হোটেলে আটকে রেখে কয়েকবার ধর্ষণ করেন। পরদিন সকালে তাঁকে মোটরসাইকেলে ফৌজদারহাটে আউটার রিং রোডের মুখে নিয়ে তাঁর কাছ থেকে দুটি মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে মোটরসাইকেলে নিয়ে শিবলী পালিয়ে যায়।

সৌদি রিয়ালের লোভ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ : রাউজানে ওমর ফারুক নামে মাদরাসার এক শিক্ষকের সাথে পরিচয় হয় প্রতারক চক্রের এক সদস্যের। প্রতারক ওই শিক্ষককে একটি ৫০ টাকা মূল্যমানের রিয়াল দেখিয়ে টাকা বিনিময় করেন। ১৯ মে ওই প্রতারক শিক্ষককে ফোন করে জানায়, তার কাছে আরো কিছু সৌদি রিয়াল আছে। আগের দরে ওসব রিয়াল চাইলে কিনতে পারবেন। শিক্ষক রাউজান ফকিরহাটের এক দোকানে স্ত্রীর স্বর্ণ বন্ধক রেখে এক লাখ ২০ হাজার টাকা নেন। প্রতারকরা শিক্ষকের কাছ থেকে এক লাখ বিশ হাজার টাকা গুণে নিয়ে তাদের হাতে থাকা কাপড়ের পুটলি শিক্ষকের হাতে দিয়ে দ্রুত চলে যেতে বলে। পরে একটু দূরে এসে শিক্ষক পুটলি খুলে দেখেন, সেখানে কাগজ ছাড়া কিছুই নেই।

ঋণ দেওয়ার নামে প্রতারণা : ঋণ দেওয়ার নামে প্রতারণার অভিযোগে আস্থা মাল্টিপারপাস লিমিটেড নামে বেসরকারি একটি সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে ভুক্তভোগীরা। পুলিশ জানিয়েছে, কথিত এ ঋণদান সংস্থা শতাধিক নিম্ন আয়ের মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে প্রায় ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শনিবার (১৮ মে) বিকেলে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার অঙিজেনকুয়াইশ সড়কে সংস্থার কার্যালয় থেকে দুজনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বায়েজিদ বোস্তামি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা আজাদীকে জানান, শনিবার রাতে সংস্থার কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ১২৭টি সঞ্চয় ও ঋণ পাসবই এবং ৫৭৬টি সদস্য আবেদন ফরম উদ্ধার করা হয়।

কমার্সের চাহিদাকে পুঁজি করে প্রতারণা : কমার্সের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা বা চাহিদাকে পুঁজি করে ব্যবসার নামে প্রতারণার জাল বুনেছে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী অসাধু চক্র। ‘ইলিশে বাড়ি চাঁদপুর’ নামে একটি ফেসবুক পেইজে মাছের ছবি ভিডিও দেখে ইলিশ মাছ কেনার অর্ডার করেন চট্টগ্রামের মিথিলা আফরিন (ছদ্মনাম) নামে এক গৃহবধূ। বলা হয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্ডার ডেলিভারি দেয়া হবে। মূল্য পড়বে সাড়ে চার হাজার টাকা। মিথিলা আজাদীকে জানান, তাদের কাছে আমি অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঁচশ টাকা অগ্রিম পাঠাই। পরদিন একটি নম্বর থেকে বলা হয়, কুরিয়ারে আমার মাছ এসেছে। চার হাজার টাকা পাঠালে ডেলিভারি দেয়া হবে। তিনি বলেন, আমি মাছ দেখলাম না, কেন টাকা পাঠাবো। তারা বললেন, এটাই সিস্টেম। নিরুপায় হয়ে চার হাজার টাকা সাথে খরচ হিসেবে অতিরিক্ত আশি টাকা পাঠালাম। কিন্তু মাছ আসে না। যোগাযোগ করলে তারা বলে, আশি টাকা বেশি পাঠিয়েছি, এটা নিয়ম নয়। করণীয় কী জানতে চাইলে বলে এখন কিছু করার নেই, নতুন করে চার হাজার টাকা পাঠালে ডেলিভারি দেবে। আমি টাকা ফেরত পাঠাতে বললে তারা আমার নম্বরটাই ব্লক করে দেয়।

ইমোতে পরিচয়, পরে প্রতারণা : চট্টগ্রামের এক কলেজ ছাত্রের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইমোতে পরিচয় হয় আসিফ নামে এক যুবকের সঙ্গে। পরিচয়ের সূত্র ধরে ওই কলেজ ছাত্র আসিফের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে পড়েন সংঘবদ্ধ প্রচারক চক্রের খপ্পরে। এরপর কলেজ ছাত্রকে বেধড়ক মারধরের পর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। এ সংক্রান্ত অভিযোগ পেয়ে ২৬ এপ্রিল রাতে আসিফ ও দুই নারীসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বায়েজিদ বোস্তামি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা জানান, পুলিশ আদনান ভিলার ওই বাসায় অভিযান চালায়। অভিযান চালাতে গিয়ে দেখি, সেখানে হাতপা বাঁধা অবস্থায় আরও এক যুবক। তাকেও আমরা উদ্ধার করি।

ক্লিক করলেই টাকা, পরে সর্বহারা : ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ক্লিক করলেই মিলবে টাকা’ এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহককে আকৃষ্ট করা হয়। এরপর ওয়েবসাইটগুলোতে ক্লিক করলে কয়েক দফায় দেওয়া হয় টাকা। বিশ্বাস অর্জন করার পর প্রতারণার ফাঁদে ফেলে মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গ্রাহক থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় বিপুল অঙ্কের টাকা। এভাবেই বিভিন্ন ব্যাংকের একাধিক অ্যাকাউন্টসহ ১২৫টি বিকাশ এবং নগদ নম্বর ব্যবহার করে এক নারীর কাছ থেকে প্রায় ২৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দেশি এবং বিদেশি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র। অবশেষে ভুক্তভোগী ওই নারী প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে নিয়েছেন আইনের আশ্রয়। ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসেন জুনায়েদের আদালতে মামলার আবেদন করেন ওই নারী। আদালত তা গ্রহণ করে সিআইডিকে তদন্তের আদেশ দিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ।

স্বামীর প্রতারণার ফাঁদে নারী, সহযোগিতায় স্ত্রী : প্রতারণার মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ এবং অর্থ আদায়ই তার লক্ষ্য। আর এ কাজে তাকে সহযোগিতা করে তার স্ত্রী। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। পিবিআইয়ের জালে দীর্ঘদিন পর আটকে গেল প্রতারক শহিদুল। ২৪ এপ্রিল মানিকছড়ি থানার তিন টহরী গোদারপাড় এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক আবু জাফর মো. ওমর ফারুক আজাদীকে বলেন, ধর্ষণের শিকার ভিকটিম গৃহবধূকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আসামি শহিদুল ধর্ষণ করে। সেই ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করে ওই গৃহবধূর পরিবারকে দেখাবে বলে হুমকি দিয়ে পুনরায় ধর্ষণ করে শহিদুল। কিন্তু এরপরও ভিডিও ডিলিট না করে শহিদুল এবং দ্বিতীয় আসামি সুমন ভিকটিমের কাছে টাকা দাবি করে। তিন কিস্তিতে ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করলেও ব্ল্যাকমেইল করে। উপায়ন্তর না পেয়ে ওই গৃহবধূর স্বামী বিষয়টি শহিদুলের স্ত্রীকে জানান। কিন্তু উল্টো শহীদুলের স্ত্রীও ১ লাখ টাকা দাবি করেন। না হয় ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর হুমকি দেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএনএসআই কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণা, দম্পতি আটক
পরবর্তী নিবন্ধগ্রেপ্তার তিনজন ৮ দিনের রিমান্ডে