চাপ বাড়ছেই আইসিইউতে

১৫ দিনে ৩ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হাসপাতালে

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৪ জুন, ২০২১ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দিন দিন করোনা সংক্রমণ বাড়ছে চট্টগ্রামে। তবে আগে মহানগর এলাকায় সংক্রমণ বেশি দেখা গেলেও এই সময়ে এসে গ্রামাঞ্চলেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। পাল্লা দিয়ে রোগীর চাপও বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। বিশেষ করে গত ১০/১৫ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শেষ ১৫ দিনে ৩ হাজারেরও বেশি করোনা রোগী চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২ সপ্তাহ আগেও করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত কেবিন/ শয্যা বেশির ভাগই খালি ছিল। কিন্তু গত ১০/১৫ দিনে এ চিত্র পাল্টে গেছে। এই সময়ে রোগীর চাপ তীব্র হয়েছে হাসপাতালগুলোতে। তবে আইসিইউতে চাপ তুলনামূলক বেশি বলে চিকিৎসক ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালোগুলোর আইসিইউতে ঠাঁই নেই অবস্থা।
করোনার ভারতীয় ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) বিস্তার ঘটে যাওয়ায় সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। তিনি বলেন, ভাইরাসের ভারতীয় এ ধরন অন্যান্য ধরনের তুলনায় তিনগুণ বেশি সংক্রামক ও ভয়ানক বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ধরন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মূলত ভারতীয় এ ধরনের সামাজিক সংক্রমণের কারণেই করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। সংক্রমণ থামানো না গেলে প্রথম ঢেউয়ের মতো কিংবা এর চেয়েও বেশি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নেমে আসতে পারে বলে তাঁর আশঙ্কা। সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় রোগীর চাপ বাড়ছে বলে স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলছেন, ঈদের সময় মানুষ অনেকটা বেপরোয়াভাবে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছেন। অনেকে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শপিং করেছেন। এমন পরিস্থিতি দেখে ঈদ পরবর্তী সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করেছিলাম আমরা। এখন সেটাই দৃশ্যমান। তাছাড়া জনসমাগম না করার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছেনা। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক সভা ও অনুষ্ঠানে জনসমাগম হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধির কোন নির্দেশনাই মানুষ মানতে চান না। ফলে সংক্রমণের হার আবারো আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তবে এবার গ্রামাঞ্চলে আক্রান্তের হার তুলনামূলক বেশি দেখা যাচ্ছে। ঈদ পরবর্তী গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার যে আশঙ্কা আমরা করেছিলাম, সেটাই হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের হার এখন ফের ঊর্ধ্বমুখী। বেশ কয়দিন ধরে চট্টগ্রামে দৈনিক সংক্রমণের হার ১৫ থেকে ২৫ শতাংশে উঠা-নামা করছে। যদিও বিদেশগামীদের পরীক্ষাকৃত নমুনার সংখ্যা বাদ দিয়ে হিসেব করলে দৈনিক সংক্রমণের গড় হার প্রকৃতপক্ষে ৩০ শতাংশ ছুঁয়ে যায়। আর মহানগর বাদ দিয়ে উপজেলা পর্যায়ের নমুনা পরীক্ষার আলাদা হিসেব করলে দেখা যায়, উপজেলা পর্যায়ে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৩৫ শতাংশের কম নয়। কোন কোন দিন এ হার ৫০ শতাংশও অতিক্রম করছে।
গত ২২ জুন মোট ১ হাজার ৭১টি নমুনা পরীক্ষায় ২৩৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। হিসেবে গড় শনাক্তের হার ২২.০৩ শতাংশ। এর মাঝে মহানগরীর ৮৭১টি নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৪৫ জনের। শনাক্তের হার ১৬.৬৪ শতাংশ। বিপরীতে উপজেলা পর্যায়ে শনাক্তের হার ৪৫ শতাংশের বেশি। উপজেলা পর্যায়ের ২০০টি নমুনা পরীক্ষায় ৯১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে এদিন। তবে উপজেলা পর্যায়ে হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, মীরসরাই, রাউজান, সীতাকুণ্ডে সংক্রমণের হার তুলনামূলক বেশি। বিশেষ করে ঈদের কয়েক সপ্তাহ পর থেকে এসব এলাকায় সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী বলে জানান সিভিল সার্জন। এর মধ্যে অতি সংক্রমণশীল এলাকা হিসেবে ফটিকছড়ি উপজেলায় গত ২৩ জুন সকাল থেকে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এ লকডাউন বলবৎ থাকবে। মহানগরেও বেশ কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। রাত ৮টার পর ওষুধের দোকান ছাড়া সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রতিদিন করোনায় শনাক্ত ও হাসপাতালে (নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক) ভর্তিকৃত রোগীর তথ্য সংক্রান্ত আপডেট দেয়া হয়ে থাকে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ মে চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৩৫৯ জন করোনা রোগী ভর্তি ছিল। ১০ জুন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দেখানো হয় ৪১৪ জন। ১৭ জুন এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮৬ জনে। আর সর্বশেষ গতকালের হিসেবে হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯৮ জনে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায়, এ পর্যন্ত মোট ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৮৫টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মাঝে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৫৬ হাজার ৩৯৭ জনের। শনাক্তের গড় হার ১২ শতাংশ। কিন্তু শেষ ১৫ দিনে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশে। শেষ ১৫ দিনে মোট ১৩ হাজার ১৫৩টি নমুনা পরীক্ষায় ২ হাজার ১৭৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। করোনা
আক্রান্তদের মাঝে এ পর্যন্ত ৬৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। শেষ ১৫ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা ৩১ জন। আর শেষ ১৫ দিনে হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ১২১ জন। অর্থাৎ ৩ হাজারের বেশি করোনা রোগী শেষ ১৫ দিনে চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কোন হাসপাতালে কত রোগী :
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গতকাল ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৮২ জন। এর মধ্যে করোনা আইসিইউতে ৫ জন এবং এইচডিওতে আরো ৫ জন রোগী চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর। ১৫ দিন আগেও রোগীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক ছিল জানিয়ে হাসপাতাল পরিচালক বলেন, এই অল্প সময়ের মধ্যে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। রোগীর বৃদ্ধির এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
আইসিইউতে ১৬ জনসহ সবমিলিয়ে ৭৫ জনের বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। এ তথ্য নিশ্চিত করে হাসপাতালটির করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. আব্দুর রব মাসুম বলেন, সাধারণ শয্যায় ভর্তি থাকা রোগীদের মাঝেও অন্তত ১৫ জন রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের ১৬টি আইসিইউ চালু আছে। এর সবকয়টি গত দু সপ্তাহ ধরে পরিপূর্ণ। একদিনের জন্য একটি আইসিইউও খালি থাকছেনা। তাই আইসিইউ সাপোর্ট জরুরি হলেও সব রোগীকে আমরা আইসিইউ সেবা দিতে পারছিনা।
ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে সামপ্রতিক সময়ের মধ্যে গতকাল ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ বলে জানান হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. মামুনুর রশীদ। ৩২টি শয্যার মধ্যে ২৯ জন রোগী চিকিৎসাধীন বলে জানান তিনি।
বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতালে ৭২ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। এর মাঝে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ১৬ জন। এর বাইরে সিএমপি বিদ্যানন্দ ফিল্ড হাসপাতালে ৪৯ জন এবং আল মানাহিল নার্চার জেনারেল হাসপাতালে ১৪ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য, ভর্তি হওয়াদের মাঝে খারাপ রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানান চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. আব্দুর রব মাসুম।
সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি রোগী বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও।
বিশেষ করে গত ১০/১৫ দিন ধরে রোগীর চাপ তীব্র হয়েছে বলে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বর্তমানে করোনা রোগীদের জন্য ২০টি কেবিন বরাদ্দ রাখা হয়েছে বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালে। এর মধ্যে গতকাল বুধবার ২০ জন রোগী ভর্তি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মো. আমজাদ হোসেন। আর নির্ধারিত ৮টি আইসিইউর ৩টিতে রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহ আগে দৈনিক ৩/৪ জন করে রোগী ভর্তি হতো। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ৮/৯ জন করে রোগী ভর্তি হচ্ছে। এর মাঝে খারাপ রোগী বেশি আসছে।
নির্ধারিত ২৬টি কেবিনের ২৬টিতে রোগী ভর্তি পার্কভিউ হাসপাতালে। আর দশটি আইসিইউর একটিও খালি নেই বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির জিএম জিয়াউর রহমান। খারাপ রোগী বেশি আসছে জানিয়ে পার্কভিউ হাসপাতালের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ডা. রেজাউল করিম আজাদ বলেন, আমাদের দশটি আইসিইউ করোনা রোগীদের জন্য বরাদ্দ। গত দুই সপ্তাহ ধরে একটি আইসিইউ খালি থাকছেনা।
মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নির্ধারিত ১৮টি কেবিনে ১৭ জন রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানান হাসপাতালের জিএম মোহাম্মদ সেলিম। এছাড়া আইসিইউ ও এইচডিওতে আরো ৮ জন রোগী চিকিৎসাধীন বলে জানান তিনি।
রোগীরা বাসায় থেকে শেষ মুহুর্তে এসে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন জানিয়ে মোহাম্মদ সেলিম বলেন, যার কারণে অনেক রোগীকে আমরা বাঁচাতে পারছিনা।
বেসরকারি ম্যাঙ হাসপাতালের কেবিনে ২৭ জন ও আইসিইউতে আরো ৭ জন করোনা রোগী চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির জিএম রঞ্জন প্রসাদ দাশ। সিএসসিআর হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত ৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির আরএমও ডা. এমজাদ হোসেন। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আক্রান্তদের অনেকেই বাসায় বসে চিকিৎসা নেন। প্রথম দিকে হাসপাতালে আসছেন না। অনেকেই একদম অন্তিম মুহুর্তে হাসপাতালে আসছেন। ততক্ষণে কিন্তু ওই রোগীর ফুসফুস অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত। বাসায় থেকে ফুসফুস বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর যারা হাসপাতালে আসছেন, বিশেষ করে তাদের রিকভার করার চান্স কম। এ ধরনের রোগীদের বাঁচানোটা খুবই কঠিন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিস্থিতি নাজুক হলে সারাদেশেই কঠোর লকডাউন
পরবর্তী নিবন্ধনির্দেশনা মানার বালাই নেই