বদিউল আলম চৌধুরী- ভাষা সৈনিক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে চট্টগ্রামের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক আহমেদ মমতাজের ‘তাহারেই মনে পড়ে’ প্রবন্ধ পর্যালোচনায় দেখা যায়, “দূরদর্শী রাজনৈতিক, আজীবন নিষ্ঠাবান সমাজসেবী, প্রগতিশীল চিন্তানায়ক, অক্লান্ত শিক্ষা প্রচারক ও বিজ্ঞানমনস্ক স্বদেশপ্রেমী আলহাজ্ব বদিউল আলম চৌধুরী ছিলেন গত শতাব্দীর চাটগাঁর এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শেষ দশক পর্যন্ত এদেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলীর অনেক ক্ষেত্রে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল” [সূত্রঃ বদিউল আলম চৌধুরী স্মারক সংকলন (ব.আ.চৌ.স্মা.স.), পৃষ্ঠা ২১]। উল্লেখ্য, বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে বদিউল আলম চৌধুরীর অবদান নিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখে দৈনিক আজাদী পত্রিকায় ‘ভাষা আন্দোলনে কাট্টলীর কীর্তিমান পুরুষ বদিউল আলম চৌধুরী’ শিরোনামে এবং বায়ান্ন পরবর্তী আন্দোলন, চুয়ান্ন’র নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুৃত্থান ও একাত্তরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বদিউল আলম চৌধুরীর অবদানের ওপর দুই পর্বে ২৮ ও ২৯ মার্চ, ২০১৯ তারিখে দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজনীতিবিদ বদিউল আলম চৌধুরী’ শিরোনামে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে সমাজ সচেতন ও মানবদরদী ব্যক্তি তথা সমাজসেবক হিসেবে বদিউল আলম চৌধুরীর অবদানের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
বদিউল আলম চৌধুরী এক সমাজ সচেতন ও মানবদরদী ব্যক্তির নাম। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কবি, প্রবন্ধিক ও অনুবাদক চৌধুরী গোলাম রব্বানীর ‘বদিউল আলম চৌধুরীকে যেমন দেখেছি’ প্রবন্ধ পর্যালোচনায় দেখা যায়, “বদিউল আলম চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। সমাজ চিন্তায় উদ্বুদ্ধ এক পুরুষ। নাতিদীর্ঘ জীবনের পুরোটা সময় ধরে মানুষের কল্যাণে ঘনিষ্ঠ থেকেছেন গভীর আন্তরিকতায়। সততই তাঁর স্মৃতি আমার মতো অনেককেই ব্যথাতুর করে” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ১৯-২০)। এ বিষয়ে ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির অঙ্গনে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী’ স্মৃতিকথায় বিশিষ্ট কবি ও অনুবাদক জনাব জহুর-উশ-শহীদ বলেন, “তিনি রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সাথেও গভীরভাবে জড়িত থেকে কাজ করে গেছেন” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ২৭-৩১)। অপরদিকে ভাষা সৈনিক, রাজনীতিবিদ ও সংগঠক জনাব মুহাম্মদ নূরউল্লাহ তাঁর ‘একে একে নিভেছে দেউটি’ প্রবন্ধে বলেন, “যুগে যুগে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কিছু মানবসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। যাদের ত্যাগ, সৃষ্টিশীলতার দানে, কর্মে মানবসমাজ উপকৃত হয়। সেই কীর্তিমানরা স্থান করে নেন ইতিহাসে। দেশবরেণ্য সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী, মানবদরদী ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী। আত্মীয়তার বন্ধনে বা রক্তের সম্পর্কে নয়, তাঁর দরদি কাজেকর্মে তিনি চট্টগ্রামবাসীসহ এদেশের অনেক মানুষেরই ছিলেন আত্মার আত্মীয়। তিনি ছিলেন অনেকেরই একান্ত আপনজন, বিপদের বন্ধু। তাঁর দয়া ও মমতার পরশ ছিল সবার জন্যে” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ৮-৯)।
পাওয়ার আশায় নয়, কোন কিছুর বিনিময়ে নয়, বদিউল আলম চৌধুরী নিঃস্বার্থভাবে অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে গেছেন সমাজের জন্যে। বদিউল আলম চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘আমার দেখা বদিউল আলম চৌধুরী’ স্মৃতিকথায় জনাব মোহাম্মদ ইউসুফ লেখেন, “পৃথিবীতে যারা নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে অপরের উপকার করে স্মরণীয় হয়ে আছেন- বদিউল আলম চৌধুরী তাঁদের একজন” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ৪১-৪২)। উল্লেখ্য, বদিউল আলম চৌধুরী সমাজের মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় নিজের আরাম-আয়েশকে উপেক্ষা করে প্রতিনিয়তঃ ছুটে গিয়েছেন মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গি হতে, মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে। এ প্রসংগে হাটহাজারী কলেজের সহকারী অধ্যাপক জনাব জহুর-উল-আলম তাঁর ‘পরিচিতজনের গন্ডি ছোট হয়ে আসছে’ স্মৃতিকথায় বলেন, “রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে বদিভাইয়ের ভিন্ন আরো পরিচয় রয়েছে। তিনি একজন সফল শিক্ষানুরাগী ও সমাজকর্মী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণি-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে ত্রাণ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলায় চষে বেড়িয়েছেন বদিভাই” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ১৪-১৫)। একই বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান তাঁর ‘বদিউল আলম চৌধুরী- নির্ভীক নেতার প্রতিকৃতি’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় বলেন, “ তিনি সেবাধর্মী কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্যে তিনি দিনের আরাম, রাতের বিশ্রামকে হারাম করে দুর্গত মানুষের পার্শ্বে এসে দাঁড়িয়েছিলেন” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ১০-১১)।
বদিউল আলিম চৌধুরী দিনের অধিকাংশ সময় সমাজের জন্যে ব্যয় করতেন। তাঁর কাছে ছোট-বড় গরীব-ধনী, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান’সহ সকল স্তরের মানুষের অবাধ যাতায়াত ছিল। প্রায় প্রতিদিনই অগণিত লোকজনকে তিনি সময় দিতেন, যাদের মধ্যে কেউ আসতেন সমস্যা সমাধানের আশায়, কেউবা পরামর্শের জন্যে, কেউবা আসতেন তাঁর সাথে কথা বলে একটু মানসিক শান্তি খুঁজে পাওয়ার আশায়। যে কোন বিষয় ধৈর্য ধরে তিনি শুনতেন এবং বোঝার চেষ্টা করতেন। এ প্রসংগে বদিউল আলম চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘আমার দেখা বদিউল আলম চৌধুরী’ স্মৃতিকথায় জনাব মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, “তাঁর বাসায় যারা যেতেন সবাই বুদ্ধি ও পরামর্শের জন্যে যেতেন। তিনি তাদের অভাব অভিযোগের কথা নীরবে শুনতেন এবং প্রতিকারের আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। সব সময় জুলুমদের পাশে দৃঢ় অবস্থান নিতেন। জুলুমকারী সমাজের উচ্চস্তরের হলেও তার প্রতিবাদ করতেন। এইভাবে সমাজের কত মানুষের উপকার করেছেন আল্লাহ্জানেন।…শুধু সমাজের নির্যাতিত মানুষের উপকার করতে পেলে নিজে আনন্দ পেতেন।… পরের উপকারার্থে নিজের মূল্যবান সময়টুকু ব্যয় করেছেন। …তাঁর মৃত্যুর খবর শোনার পর চোখের জল ফেলেছি। …আল্লাহ’র কাছে ফরিয়াদ করেছি- ‘তাঁর মত তাঁর বংশ হতে উত্তরসূরী তৈয়ার করুন, যেন নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াতে সক্ষম হয় এবং সমাজের তথা দেশের-দশের উপকারে জীবন উৎসর্গ করতে সক্ষম হয়’…” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ৪১-৪২)।
বদিউল আলম চৌধুরী সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক লড়াকু সৈনিক ছিলেন। দেখা গেছে সমাজের কোন লোক অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে না, অন্যায়কে মেনে নিচ্ছে, চারদিকে ভয়ভীতি কাজ করছে- এমন পরিস্থিতিতেও বদিউল আলম চৌধুরী একা উদ্যোগ নিয়ে, সাহসের সাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, মানুষের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন, কোন ভয়ভীতির কাছে মাথা নত না করে তিনি মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান তাঁর ‘বদিউল আলম চৌধুরী-নির্ভীক নেতার প্রতিকৃতি’ শীর্ষক স্মৃতিচারণে বলেন, “তিনি মানুষের সার্বিক কল্যাণ, শুভবোধ উন্মেষে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন সর্বপ্রকার জুলুমের বিরুদ্ধে এক লড়াকু সৈনিক” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ১০-১১)। বদিউল আলম চৌধুরী মুখের হাসি এবং ব্যক্তিত্ব দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন। সব মিলিয়ে বদিউল আলম চৌধুরী সকল দল ও মতাদর্শের মানুষের কাছে এক প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। খুবই যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে তিনি সকল দল ও মতের ঊর্ধ্বে থেকে সমাজের সকল স্তরের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার জনাব মুহম্মদ ওহীদুল আলম তাঁর ‘শ্রদ্ধেয় বদিভাইঃ একজন অনুজের দৃষ্টিতে’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় বলেন, “সমাজের গতি ও গন্তব্য সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। তাঁর ইতিহাস সচেতনতা ছিল আমাদের জন্যে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।…..নানা সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তিনি খুব গোছালো ও জোরালো ভাষায় আপন বক্তব্য পেশ করতেন। বক্তব্যের সূচনায় তিনি যেভাবে স্বাচ্ছন্দ থাকতেন, উপসংহারেও থাকতেন তেমনি দৃঢ়। নিজের মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে আমি তাঁকে কখনো নেতিয়ে পড়তে দেখিনি”(সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ১৬-১৮)।
দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসার কারণে বদিউল আলম চৌধুরী বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সাথে সরাসরি জড়িত থেকেছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কবি, প্রবন্ধিক ও অনুবাদক জনাব চৌধুরী গোলাম রব্বানী তাঁর ‘বদিউল আলম চৌধুরীকে যেমন দেখেছি’ শীর্ষক স্মৃতিচারণে বলেন, “দুনিয়ায় সাধারণভাবে মানুষ নিজের ও পরিবারের জন্য জীবন নির্বাহ করে। কিছু মানুষ তাঁরা সংখ্যায় অল্প থাকেন, যাঁরা নিজের নয়, সমাজের সাধারণ দশজনের জন্য জীবনকে ব্যয় করেন। এঁরা না হলে স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল প্রভৃতি হতো কি করে? এসব তো পরিবার ও সংসার জীবনের কর্মীদের দিয়ে হবার নয়। আমি মনে করি, মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী ছিলেন তেমনই এক মানুষ, যাঁদের কল্যাণে পৃথিবী সভ্যতায় উন্নীত হয়েছে। আর এই-ই হচ্ছে তাঁর সামাজিক লভ্য, যা নিয়ে তিনি পরজগতেও সুখী হতে পারবেন” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ১৯-২০)।
চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্যে বদিউল আলম চৌধুরী আজীবন সোচ্চার থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এ প্রসংগে বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক জনাব আহমদ মমতাজ তাঁর ‘তাহারেই পড়ে মনে’ প্রবন্ধে বলেন, “….চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্মকান্ডে তিনি আজীবন সোচ্চার ছিলেন। চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি, চাঁদ দেখা কমিটি, ঈদ জামাত কমিটি, একাধিক সুফি-দরবেশের মাজার পরিচালনা ও মাদ্রাসা-মসজিদ কমিটির সদস্য পদে আজীবন সক্রিয় ছিলেন” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ২১-২৬)। এ বিষয়ে বিশিষ্ট কবি ও অনুবাদক জনাব জহুর-উশ-শহীদ এর ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির অঙ্গনে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী’ প্রবন্ধ পর্যালচনায় দেখা যায়, “…‘স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রতিরোধ কমিটির যুগ্ম সম্পাদক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদের প্রথম সহ সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির যুগ্ম সম্পাদক, আহ্বায়ক এবং চট্টগ্রাম তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি হিসেবেও বদিউল আলম চৌধুরী একাগ্রচিত্তে দায়িত্ব পালন করেন” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ২৭-৩১)। উল্লেখ্য, তমদ্দুন মজলিসের জন্মলগ্ন থেকে আজীবন নিষ্ঠার সাথে জড়িত থাকায় এর একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন বদিউল আলম চৌধুরী। আর এরই ধারাবাহিকতায় বদিউল আলম চৌধুরী তাঁর আরো ৪ (চার) সহকর্মীকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রামে একটি বিশ্বমানের ইসলামী সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার একটা বৃহৎ ও সৃজনশীল গবেষনা সেন্টার, ‘বিশ্ব ইসলামী সেন্টার ও জমিয়তুল ফালাহ’ স্থাপনে সফল হন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক আহমদ মমতাজ এর ‘তাহারেই পড়ে মনে’ প্রবন্ধে পর্যালোচনায় দেখা যায়-“চট্টগ্রামে একটি বিশ্ব মানের ইসলামি সেন্টারের স্বপ্নদ্রষ্টাদের তিনি একজন” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ২১-২৬)। ‘বিশ্ব ইসলামী সেন্টার ও জমিয়তুল ফালাহ’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বদিউল আলম চৌধুরী ‘বিশ্ব ইসলামী সেন্টার ও জমিয়াতুল ফালাহ’র পর পর ২ (দুই)বার নির্বাচিত গভর্নর ও পরবর্তীতে উপদেষ্টা ছিলেন। এ প্রসঙ্গে প্রাক্তন জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব এ কে এম রফিকউল্লাহ চৌধুরী তাঁর ‘বিশিষ্ট সমাজকর্মী বদিউল আলম চৌধুরী স্মরণে’ শীর্ষক স্মৃতিচারণে বলেন, “জনাব বদিউল আলম চৌধুরী চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি দুই-দুইবার নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে জমিয়তুল ফালাহ’র গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ৫-৭)। উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালের সামরিক সরকার ‘বিশ্ব ইসলামী সেন্টার ও জমিয়াতুল ফালাহ’র পরিচালনার ভার সরকারের হাতে ন্যস্ত করার পর থেকে বদিউল আলম চৌধুরী উক্ত প্রতিষ্ঠানে আমৃত্যু উপদেষ্টা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
বদিউল আলম চৌধুরী সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেকে সরাসরি সম্পৃক্ত করে সব সময় মানুষের সেবায় নিয়োজিত থেকে এবং তাদের কল্যাণার্থে সে সকল প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করেছেন। বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত প্রমাণ করে তাঁর নেতৃত্বকালীন সময়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ ঘটেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি (এমইএস)’র উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ। প্রসংগত উল্লেখ্য, বদিউল আলম চৌধুরী ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিখ্যাত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির নির্বাহী পরিষদের সদস্য, সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও সহসাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এছাড়া, ১৯৮৫-৮৬ সালে ২ (দুই) বৎসর ঐ প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির প্রভূত উন্নয়নে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এ প্রসঙ্গে প্রাক্তন জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব এ কে এম রফিকউল্লাহ চৌধুরী তাঁর ‘বিশিষ্ট সমাজকর্মী বদিউল আলম চৌধুরী স্মরণে’ শীর্ষক স্মৃতিচারণে বলেন, “জনাব বদিউল আলম চৌধুরী সারা জীবন বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন।…জনাব বদিউল আলম চৌধুরী ষাটের দশক থেকে ‘মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি চট্টগ্রাম’-এর সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি কয়েকবার এই সমিতির বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি এই সমিতির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। …..তিনি প্রায় দুই বৎসর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর এই দুই বৎসরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির নিজস্ব তিনতলা জরাজীর্ণ ভিআই হোস্টেল নীলামে বিক্রি করে মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি প্রায় ৭ লক্ষ টাকা পেয়েছিলো। এত বড় একটা বিল্ডিং ভেঙে বিক্রি করার সাহস কেউ করেনি। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে এত বড় একটা কাজ সম্পাদন করায় মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির প্রত্যেক সদস্যই তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছে” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ৫-৭)। এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট এম নূরুল হুদার এক স্মৃতিচারণ পর্যালোচনায় দেখা যায়, “বদিউল আলম চৌধুরী ও আমি মুসলিম এডুকেশন সোসাইটিতে একসঙ্গে কাজ করেছি। যদিও রাজনীতিতে আমাদের অবস্থান ছিল দুই মেরুতে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর নীতি ও প্রজ্ঞার জন্যে আমি তাঁকে সম্মান করতাম। কোন কিছুই তাঁর কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে মরহুম সমিতির কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।…..মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির বর্তমান অবস্থান বদিউল আলম চৌধুরীসহ আমাদের আন্তরিকতার সুফল। সোসাইটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তদানীন্তন ভিআই হোস্টেলকে নিলামে বিক্রি করে বিক্রিলব্ধ অর্থ দিয়ে স্কুল গৃহ, স্কুলের মাঠ এবং সোসাইটির বাণিজ্যিক ভবন, অফিস মিলনায়তন তৈরির মানসে আমাকে আহ্বায়ক ও বদিউল আলম চৌধুরীকে সচিব করে এক কমিটি গঠন করা হয়। ভিআই হোস্টেলের প্রকৃত মূল্যায়ন করা এবং নিলামে বিক্রি করা খুবই কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু আমাদের কঠোর শ্রম ও অকৃত্রিম মমতার কারণে ৭ লক্ষ টাকায় বিক্রি করার সেই কঠিন কাজ করা সম্ভব হয়েছিল। সর্বপ্রকার লোভ লালসার ঊর্ধ্বে থেকে বদিউল আলম চৌধুরী দৃঢ়তার সাথে সমিতির স্বার্থ রক্ষা করেন” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)।
মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি (এমইএস)’র উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সংক্রান্তে বদিউল আলম চৌধুরীর সবিশেষ অবদানের কথা আরো কিছু স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- এমইএস উচ্চ বিদ্যালয়ের জনাব মোহাম্মদ ইউসুফ এর ‘আমার দেখা বদিউল আলম চৌধুরী’ শীর্ষক স্মৃতিচারণ। বদিউল আলম চৌধুরীর সাথে এমইএস’এ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুবাদে তাঁর পক্ষে অনেক কিছুই কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল, যা তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে এভাবে তুলে ধরেন, “আমার মনে হয় বদিউল আলম চৌধুরীর মত নির্ভীক সাহসী পুরুষের জন্ম না হলে এমইএস শপিং কমপ্লেঙ ভবন নির্মাণ, এমইএস উচ্চ বিদ্যালয় ৪র্থ তলায় উন্নীত করা, ওমরগণি এমইএস কলেজ নাসিরাবাদে স্থানান্তর, মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির সাথে শাহী জামে মসজিদের সৃষ্ট সীমানা নির্ধারণ বিরোধ মীমাংসা, কুমিল্লার মামার মাজার চট্টগ্রামে হওয়া- উল্লেখিত কাজসমূহ হতো না। তিনি সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন এসব করেছিলেন। তিনি এ সমস্ত কাজসমূহ করতে গিয়ে বহু বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হন। কিন্তু সমস্ত বাধাকে সাহসের সাথে অতিক্রম করে সৃষ্টির নেশায় সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিটি সভা-সমিতিতে গুটিকয়েক সদস্য তাঁর মতের বিরোধীতা করলেও পরে তাঁর আচার-আচরণে একমত পোষণ করতেন। সবাই জানতেন চৌধুরী যে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হউক না কেন কোন আর্থিক অনিয়ম হবে না। কারণ চৌধুরী আর্থিক অনিয়ম নিজেও করতেন না, অপরে করলেও বরদাস্ত করতেন না। অনিয়মকারী সমাজের যত উচ্চস্তরের হউক না কেন, তিনি প্রতিবাদ করতেন। সমাধান করেই শেষ করতেন। উপরোক্ত কাজসমূহ করার সময় চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সভাপতি হিসেবে চৌধুরীকে বলতেন, সদস্যদের বিরোধিতা সত্ত্বেও কেন আপনি কাজসমূহ করতে আগ্রহী? কি স্বার্থ আপনার? তিনি বলতেন, ‘আমার স্বার্থ একটাই, আমি কর্মকে ভালবাসি, কর্মই আমাকে স্মরণীয় করবে, আমার আত্মবিশ্বাস আছে। আমি ছোটবেলা থেকে যে কাজে হাত দিয়েছি, সফলতার সাথে শেষ করেছি। ইনশাআল্লাহ উক্ত কাজসমূহও আমি আপনাদের সহযোগিতা পেলে সমাধা করতে পারব’। তিনি আরও বলতেন, ‘পৃথিবীর মানুষ ২ ভাগে বিভক্ত। যে কোন কাজে কেউ না বলবে, কেউ হ্যাঁ বলবে, আমি হ্যাঁ এর মধ্যে থাকি। যতদিন বাঁচি ততদিন নতুন সৃষ্টির কাজে ‘হ্যাঁ’ পক্ষে থাকব’। কোন কিছুতে ঘবমবঃরাব ংরফব চিন্তা করতেন না। চড়ংরঃরাব ংরফব চিন্তা করতেন” (সূত্রঃ ব.আ.চৌ.স্মা.স., পৃষ্ঠা ৪১-৪২)।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব বদিউল আলম চৌধুরী ২০০৭ সালের ১০ অক্টোবর এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্তলোকে পাড়ি জমান। আল্লাহ্ তাঁর সকল ভালো কাজ কবুল করে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন। আমিন।
লেখক : মরহুমের কন্যা ও সরকারের যুগ্মসচিব