চাটগাঁইয়া ‘রসম’ এবং একটি অভিনব প্রতিবাদ

ডেইজী মউদুদ | সোমবার , ৩ জুলাই, ২০২৩ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

আমাদের চট্টগ্রামের ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সারা বাংলাদেশ থেকে একেবারেই আলাদা। বিশেষ করে অতিথি আপ্যায়নে চট্টগ্রামের জুড়ি মেলা ভার। তবে চাটগাঁইয়া রসমবলে যে রীতি এখানে চালু আছে, তা হচ্ছে ছেলেমেয়েদের বিয়ে শাদীতে দেনা পাওনা ও আদান প্রদান বিষয়ক। ছেলের শ্বশুরালয় থেকে বিয়ে উপলক্ষে কী কী পাবে, এই নিয়ে উন্মুখ থাকেন সমাজের ৯৯% মানুষ। একই ভাবে মেয়ের বিয়েতে মেয়েকে কী কী দেবেন, সেই চিন্তায় অধীর বেশ কিছু মা বাবা। অথচ আমি এমনো শুনেছি, আমাদের দাদী নানীদের যুগে সোনার গিনি আর মোহর পাল্লা দিয়ে মেপে মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে মেয়েকে আনা হতো শ্বশুরবাড়িতে অতি সম্মানের সাথে। আমি আমার মাকে দেখেছি, বছরের বার মাসের তের পার্বণে তিনি শীতকালে পিঠা রস, মধুমাসে আম কাঠাল, ভাদ্র মাসে মধুভাত আর তালের পিঠা, শবে বরাতে হালুয়া রুটি, রোজাতে ইফতারি, ঈদে সেমাই চিনি নারকেল, কাপড় চোপড়, কোরবানীতে চালের রুটি, গরুর রান, ছাগল, মহরমে দুরুছ পোলাও, নতুন জামাইয়ের ৫ নাস্তা পাঠাতেন সানন্দে। এখানে কিন্তু কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। ছিল পরমানন্দ। আমি ছোট বেলায় দেখেছি, পাড়ায় এক বাড়িতে বউ আনলে বর যাত্রীর সাথে তোলা খানা দিয়ে দিতেন। খেয়েও আসবেন, আবার নিয়েও আসবেন। তো গভীর রাতে খাঞ্চা ভরে ঘরে ঘরে কোরমা পোলাও জর্দা রোস্ট বিলি করা হতো। আবার বউটাকে ফিরানি নিতে আসছেন ৫ নাস্তা, পিঠাপুলি, মিষ্টি, পান সুপারি নিয়ে। সেগুলো বিলিতে আরেক মহাযজ্ঞ। আমি আমার আত্মীয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে ট্রাক ভর্তি খাবার আসতে দেখেছি। ভালো কথা। যাদের সাধ্য আছে, যারা বিত্তবান, তাদের জন্য এটি কোনো বিষয় না। কিন্তু এই দেনা পাওনা যখন সমাজে ‘রসমনামে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো, ক্ষতিগ্রস্ত হলো সমাজ, এই প্রথা পরিণত হলো অন্যায় আর অনাচারে। যে মেয়ের পরিবার দিতে পারছে না, সেই মেয়ের মনটি একেবারেই ছোট হতে থাকলো, ক্ষেত্র বিশেষে বঞ্চনা ও মানসিক পীড়নের শিকার হতে লাগলো। আবার এসব যে পরিবারে চলে আসে সেখানে অযোগ্য মেয়েও কদর পেয়ে যায়।এই চিত্র দীর্ঘদিনের। আমি লিখে শেষ করতে পারবো না। আমি স্বজন আর বন্ধু পাগল মানুষ। প্রতি ঈদে প্রিয় ও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠদের কাছে ছুটে যাই। যেতে না পারলেও ফোনে কথা বলি। গতকাল বোন কোহিনুরের সাথে কথা হচ্ছিল। গল্প আর কথার ফাঁকেফাঁকে তার অভিনব এবং নতুন এক অভিব্যক্তির পরিচয় পাই। সে নাকি, এই কোরবানীতে আমার মামা আর মামী মানে ওর মা বাবার জন্য একটি ছাগল উপহার পাঠিয়েছে। চমৎকার, চমৎকার। নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ উদ্যোগ। আমি বললাম, কি রে, ব্যাপার টা উল্টো হয়ে গেলো না! সাধারণত মেয়ের বাড়ি থেকেই পাঠানোর রেওয়াজ। সে বলে কি, যতোদিন এই অনাচার চলবে, ততোদিন আমি এই কাজটিই করবো।এটিই আমার প্রতিবাদ। আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কেন তুমি এই নজীর সৃষ্টি করলে? উত্তরে সে বলে, আপু, আমাদের এই বাজে রীতিগুলো নিয়ে আমাদের অনেক কথা শুনতে হয়। তা ছাড়া এই ধরনের নিয়ম আর আচারের কথাতো কোথাও লেখা নেই। আমাকে দেখে যদি অন্তত, একজন মেয়েও (যদি তার সাধ্য থাকে) এই কাজটি করে, আমি বলবো, আমি সার্থক। আর যদি কোনো ছেলের বাবা স্ট্রিক্টলি মেয়ের বাড়িতে নিষেধ করে দেয়, কিছু না পাঠাতে, তাহলে এই অনাচার ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। আর আমি ভাববো, আমি মোটিভেট করতে পেরেছি। এটি আমার সাহসী এক প্রতিবাদ। এই অনাচারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে একাই দাঁড়িয়ে যাবো। আমি ওর কথায় যতো না অবাক হয়েছি, লজ্জিত হয়েছি, ততোধিক। কারণ, আমার বেয়াইনের নিষেধ সত্ত্বেও আমি উনার জন্য নানা জিনিস পাঠাতাম, কেবল শখের বশে। এবার ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে পাঠানো ছাগলটাও রান্না করে বিলি করেছি। কোহিনুরের উদার, আধুনিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে মুগ্ধ করলো। আমার মামা একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও দৈনিক আজাদীর সম্পাদক আবদুল মালেক। তার কন্যা যে সাহসী পদক্ষেপ হাতে নিল, এতে অবাক হবার কিছুই নেই, যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা। আমি দেখতে পাচ্ছি, মোগল দরবার থেকে চুরি করা ইংল্যান্ডের রাণীর মুকুট কোহিনুর তোমার শিরে জ্বলজ্বল করছে। তুমি মিষ্টি একটি মেয়ে। জগতের যাবতীয় সুন্দর আজীবন তোমায় ঘিরে ছিল। কি সুকণ্ঠী। কি ভালো গাইতে। আমি এখনো গুণ গুণ করে তোমার গান গুলো গাই আপন মনে। বন্ধুরা,আসুন, আমরা সমাজের অনাচারগুলো রুখে দিতে একই কাতারে সামিল হই। জয় হোক মানবতার।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধএসএসসির ফল ২৫-২৭ জুলাই প্রকাশের প্রস্তাব
পরবর্তী নিবন্ধবাপের বাড়ি থেকে ছাগল দেওয়ায় অপমান, গৃহবধূর আত্মহত্যা