চাকতাই-খাতুনগঞ্জের গৌরবময় ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে

| শনিবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

চাকতাই-খাতুনগঞ্জ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ইতিহাসে ঐতিহ্যবাহী নাম। এই দুটি নাম যেমন অনন্য, তেমনি ঐতিহাসিকও। চট্টগ্রামের এই দুই বাণিজ্যিক এলাকার অবস্থান কাছাকাছি। পাশাপাশি উচ্চারিত হয় নাম দুটি। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার। চট্টগ্রাম নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের আনাগোনায় প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এ দুটি বাজার। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য এসে জমা হয় এই বাজারের আড়তগুলোতে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, প্রায় দেড়শ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ বাজারগুলোর সাথে দেশের অর্থনীতির প্রবাহ সমৃদ্ধি ও উন্নতির বিষয় ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এ বাজার দুটি মূলত দেশের সকল প্রকার খাদ্য-নিত্যপণ্যসহ মানুষের মৌলিক চাহিদার অধিকাংশই যোগান দিয়ে থাকে। এই বাজারের উপর নির্ভর করে দেশের পণ্যদাম, পণ্য সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ। এখান থেকেই তৈরি হয়েছে দেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সমাজপতির। চট্টগ্রামসহ দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বের বিশাল একটি অংশ এ খাতুনগঞ্জ-চাকতাই থেকেই উঠে এসেছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যিই যে চাকতাই-খাতুনগঞ্জের সেই জৌলুস আর নেই। নানা রকম সংকটে জর্জরিত এ দুটি বাজার। গত ৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে ‘ব্যবসা কমছে চাকতাই-খাতুনগঞ্জে/খালে ভিড়তে পারছে না বড় নৌকা রয়েছে অন্য সংকটও’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় ও জোয়ারের পানিতে ডুবে যাচ্ছে চাকতাই-খাতুনগঞ্জ। এছাড়া চাক্তাই খালের কর্ণফুলী মোহনায় স্লুইচ গেট নির্মাণের কারণে ঘাটে ভিড়তে পারছে না বড় নৌকা। অপরদিকে সরু সড়কে নিত্য যানজট, অবকাঠামোগত সমস্যা এবং চেক প্রতারণাসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীর টাকা মেরে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনাও বাড়ছে। এসব সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে ইতোমধ্যে অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ চাকতাই খাতুনগঞ্জ থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। চাকতাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিভিন্ন সমস্যার কারণে চাকতাই খাতুনগঞ্জে ব্যবসা কমে গেছে। এছাড়া শত শত বছর ধরে চলে আসা মৌখিক বিশ্বাসের ওপর লেনদেনের সংস্কৃতিতেও ধরেছে বড় ফাটল। অন্যদিকে বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগা হাটের ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেলের কারণে অনেক আমদানিকারক নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ এবং যশোর নওয়াপাড়াতে পণ্য আনলোড করছেন। আগে এক সময় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি সব পণ্য চাকতাই খাতুনগঞ্জে আসতো। তারপর সেখান থেকে নৌপথে এবং সড়কপথে আশপাশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় যেত।
নানাবিধ সমস্যা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শত বছর ধরে চাকতাই খালের মাধ্যমে নৌ-পথে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় চাকতাই-খাতুনগঞ্জের গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রতিবছর পানিবদ্ধতায় ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থার অবসান জরুরি। চাকতাই খাল খননসহ ওই এলাকাকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তাঁরা বলেন, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ সরকারি বিনিয়োগের তিন গুণ যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে থাকে। তাই চাকতাই-খাতুনগঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্য নির্বিঘ্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে।
এ কথা ঠিক যে, ওজন স্কেলের কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সারাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এমনকি চট্টগ্রাম শহরেও অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের তুলনায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তাঁরা। একারণে দেশে ভারসাম্যহীন বাণিজ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ওজন স্কেলের কারণে পণ্য পরিবহনে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অন্য জেলার ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম থেকে মালামাল কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম থেকে মালামাল আনা নেওয়ার জন্য আগে দৈনিক ১০ থেকে ১২ হাজার গাড়ির প্রয়োজন হতো। এখন প্রতি গাড়িতে আগের মত পণ্য পরিবহন সম্ভব হচ্ছে না বলে দ্বিগুণ ট্রিপ লাগছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেন, চাকতাই-খাতুনগঞ্জসহ নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, চিটাগাং চেম্বারসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাকে এক সাথে কাজ করতে হবে। চাকতাই-বদরখালীসহ বিভিন্ন খাল দখলমুক্ত করা, পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা, ময়লা-আবর্জনা-বর্জ্য ফেলে খাল ভরাট প্রতিরোধ করা দরকার।
মনে রাখতে হবে, চাকতাই খাতুনগঞ্জের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিরূপ এতে প্রভাব পড়ছে আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতিতেও। এছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক ও মানসিক ক্ষতির কারণও জলাবদ্ধতা। ব্যবসায়ীরা জলাবদ্ধতার কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, ব্যবসায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এতো সমস্যার মধ্যেও চাকতাই-খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ীদের মূল ভরসার জায়গা। আমরা চাই, নতুন করে প্রাণ ফিরে পাক ঐতিহ্যবাহী এই দুই বাজার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে