চর্যার হরিণীদের গল্প শেষ হয়নি এখনও

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ১০ জুলাই, ২০২১ at ৮:১৯ পূর্বাহ্ণ

তখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যুক্ত হইনি। অথবা ফেসবুকই আবিষ্কার হয়নি। সারা ঘর জুড়ে রাজ্যের নিস্তব্ধতা। ছেলেটা ঢাকায় আর মেয়েটা দেশের বাইরে লেখাপড়া করছে। ইমরান অফিসে চলে গেলে একাকীত্ব আরও ঝাপটে ধরে। কাজের সাহায্যকারীদের সাথে দু’চারটা কথা সারাদিনে। তখন সময় কাটাতে লেখালেখিটা শুরু করলাম। ২০০৭ এর দিকে। ছাত্রজীবনে লিখেছি। তারপর সংসারে ডুবে ও-মুখো আর হইনি। ইমরানের উৎসাহে আবারও শুরু করলাম। আমার প্রথম লেখাটা ছিল মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। ইমরান অফিসে যাওয়ার সময় আমার লেখা আজাদী অফিসে রেখে গেল। এরপর আজাদী অফিস থেকে আমাকে ফোন দিলেন প্রয়াত সিদ্দিক ভাই। তিনি লেখার প্রশংসা করে বললেন, আপনি লিখে যান। প্রকাশিত হওয়ার পরপর আরও দুটো ফোন পেলাম। ফাহমিদা আমিন আপা ও ফেরদৌস আরা আলীম আপার ফোন। তখনও উনাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। আজাদী অফিস থেকে আমার ফোন নাম্বার যোগাড় করে আমাকে ফোন করেছেন। আমি বিস্মিত ও আবেগ আপ্লুত। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি এই তিনজনকে। একজন নতুন লেখকের জন্য এটা যে কত বড় প্রাপ্তি তা বলে বুঝানো যাবে না। উনাদের প্রশংসা আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। উনাদের মধ্যে দুইজনই প্রয়াত।
আমাদের চট্টগ্রামে অগ্রগণ্য এবং প্রাজ্ঞ দুই-একজন ‘নারীলেখক’ থেকে লেখকের মর্যাদায় আসীন হয়েছেন তার মধ্যে ফেরদৌস আরা আলীম আপা অন্যতম। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা দৈনিক আজাদীর নারী পাতায় তিনি দীর্ঘদিন ধরে লিখেছেন। সারাদেশ জুড়ে বা কখনও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্রগুলো তাঁর লেখায় তুলে আনেন। এছাড়াও বাংলাদেশের অতীত-বর্তমান, চলমান রাজনীতি, সমাজের অসংগতিগুলো খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন সমাজের নীচতা, চতুরতা ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও। সবসময় অন্যায় ও অন্যায্য বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর কলম নিভৃতে বলিষ্ঠ আবেদন তৈরি করে। নারী পাতায় তাঁর লেখা পড়ে-পড়ে আমার একধরণের আসক্তি তৈরি হয়েছে। ব্যাপারটা আমার মতো আরও অনেকের নিশ্চয়ই। কতদিন হয় তাঁর লেখা পড়ি না !
প্রাণঘাতি করোনা তছনছ করে দিয়েছে আমাদের স্বাভাবিক জীবন। কত পরিবার নিঃস্ব হয়েছে, কত মানুষ প্রিয়জন হারিয়ে দিশেহারা অবস্থা তার কোন হিসেব নেই। দেশের অনেক বরেণ্যজনকে আমরা হারিয়েছি। হারিয়েছি প্রিয় মুখ, বন্ধু, স্বজন। আমরা যে বেঁচে যাব এমন নিশ্চয়তাও নেই। এখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের দুঃসহ বাস। প্রিয় মাতৃসমা ফেরদৌস আরা আলীম আপা হারিয়েছেন তাঁর জীবনসঙ্গী সজ্জন ব্যক্তিত্ব আলীম সাহেবকে। প্রায় তিন মাসের কাছাকাছি। আপা কিছুতেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। ফোন করলে আপার কান্নায় বুকটা ভেঙে যায়। এই বয়সে সঙ্গী হারানোর কষ্টটা অনেক বেশি। অনুরোধ করেছিলাম, ব্যস্ত থাকুন, লেখাটা শুরু করুন। জবাবে বলেন, অনেক সময় নষ্ট করেছি লেখালিখি করে, আর নয়! এটা হয়তো উনার কষ্টের কথা। আপা, আপনি নিজেই তো লিখেছেন ‘আমার চারপাশের যে জীবন-জগৎ চরাচরে লীন হয়ে আছে, যাকে দেখেশুনে ছুঁয়েছেনে ঝাপটে জড়িয়ে চেখেশুঁকে আমার বাঁচা সেই জীবনটাতেই আমি যাপন করি। সেই জীবনটা যে আমাকে কেবল আনন্দ দেয়, কেবল মুগ্ধ করে, গান শোনায় তা-তো নয়। সে দুঃখ দেয়, বঞ্চনা দেয় তাতে কী! সব মিলিয়ে জীবন। আমি তাকে ভালোবাসি।’
এই অমৃতবাণী সবারই মনে রাখা প্রয়োজন। এভাবেই তো জীবনকে আপনি দেখেছেন। আমার লেখা কিছুদিন বন্ধ থাকলে ফোন করে বকেছেন, সংসারে লীন হয়ে যেতে বারণ করেছেন। বারবার আপনার স্নেহে ধন্য হয়েছি।
আপা আপাদমস্তক একজন শিক্ষক। শিক্ষকতায় তাঁর জীবন কেটেছে। হওয়ার কথা ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুর্ভাগ্যবশত হননি। এজন্য উনার আক্ষেপও নেই। পাহাড়তলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে আপা অবসর নিয়েছেন। চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। শুধু তাই নয় ঢাকায়ও আপা যথেষ্ট পরিচিত। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের একটি ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন ঈট ঋৎরবহফং মৎড়ঁঢ় এর বর্ষা বরণ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান স্যার এসেছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে। স্যার প্রথমে যার কথা জানতে চেয়েছিলেন তিনি ফেরদৌস আরা আপা। তিনি আপার লেখার প্রশংসা করলেন। একবার ঢাকায় সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সাথে দেখা হলে আপা কেমন আছেন জানতে চাইলেন।
১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় উনার প্রথম গ্রন্থ ‘কালো জল শাদা ফেনা’। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, ‘যতদিন আছে চন্দ্র সূর্য।’ ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় ‘কোথাও নতুন দিন।’ ২০০১ সালে ঋত্বিক প্রকাশনা সংস্থা ঢাকা থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘হনন সুখ’। মাওলা ব্রাদার্স থেকে অনুবাদ গ্রন্থ নজরুল জীবনী বের হয় ২০০৩ সালে। এছাড়া ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় বেঙ্গল প্রকাশনা থেকে ‘নির্বাচিত নিমপ্রবন্ধ।’ সর্বশেষ ২০১৮ তে প্রকাশিত হয় ‘চর্যার হরিণী তুই।’
প্রিয় ফেরদৌস আরা আপা, আপনার অগণিত পাঠক আপনার লেখা পাঠের অপেক্ষায় আছে। আপনার কলম শোক কাটিয়ে আবার সচল হয়ে উঠুক প্রার্থনা করি। সেই সাথে আপনার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা কামনা করছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএই করেছো ভালো নিঠুর হে !
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত ৬০৩, মৃত্যু ৩ জনের