২০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭, বঙ্গবন্ধুর সগৌরব উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ শুভ উদ্বোধনের প্রভাত-সূর্য উদিত হয়েছিল। মেডিক্যাল শিক্ষাদানের সঙ্গে ’৬০ সাল থেকে যুক্ত হতে থাকে হাসপাতাল অবকাঠামো ঘিরে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। সেই হিসাবে লুসাই পাহাড় উৎসমুখ হতে প্রবাহিত কর্ণফুলির ঢেউয়ের তালে সাত দশকের অনন্য সময় পার করতে চলেছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের প্রায় পাঁচকোটি জনসমষ্টির রোগ নিরাময়ের প্রধান ভরসাস্থল এই চিকিৎসা – শিক্ষা, বিশেষজ্ঞ-সেবা প্রদানকারী বিদ্যাপীঠ। তারই প্রদীপ্ত জ্ঞানালোকে প্রতিথযশা অসংখ্য চিকিৎসক-বিজ্ঞানী দেশ-বিদেশের আঙিনায় কীর্তিনামা রচনা করে চলেছেন-প্রতিনিয়ত।
১৫ জুন, ২০২১ দৈনিক আজাদী প্রতিবেদনে উল্লেখিত-চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতালে, ‘ওয়ান স্টপ ইর্মারজেন্সি কেয়ার’ চালু সংক্রান্ত সানন্দ সংবাদ পাঠ করে এই বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এক সাধারণ প্রাক্তন ছাত্র এবং শিক্ষক হিসাবে এই লেখাটির সবিনয় অবতারণা। শুরুতে এইরকম এক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সম্মানিত হাসপাতাল পরিচালক ও কর্তৃপক্ষ, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক মণ্ডলী, বিএমএ নেতৃত্বও চিটাগাং ক্লাব কর্তৃপক্ষকে জানাই সহস্র সাধুবাদ-অভিবাদন।
অধুনা পৃথিবীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা সাধিত হচ্ছে প্রায় বিদ্যুৎগতিতে। সুতরাং একজন মেডিক্যাল শিক্ষার্থী এবং চিকিৎসক-কে সেইভাবে চিকিৎসা-শাস্ত্রে প্রতিটা মুহূর্ত নিবিড় থেকে মানদণ্ডে নিজ অবস্থান ধরে রাখতে হয়। এই কথাও ঠিক, এখন যে কোনো চিকিৎসক মানে ‘বৈশ্বিক চিকিৎসক’। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে কালের পরিক্রমায় স্নাতক ‘এমবিবিএস’ শিক্ষা গ্রহণের সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে স্নাতকোত্তর বিভিন্ন্ বিশেষজ্ঞ শাখায় পাঠদান। গঠিত হয়েছে বিভিন্ন স্পেশাল চিকিৎসা সেবা ইউনিট। এইসব মিলিয়ে বাংালাদেশের এই স্বনামধন্য চিকিৎসা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এতো বছরের পথচলায় উন্নতির ধারাবাহিকতা যেমন নজরে পড়ে, তেমনি সম্ভাবনার নানা দিগন্ত ও বিশ্বমানে পৌঁছানোর প্রয়াস নিয়ে নানা জিজ্ঞাসা থেকে যায়। একটা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল যেসব ভূমিকা পালন করে এবং তারি বিবেচনায় এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কোথায় তা উপলব্ধি করা যেতে পারে এইভাবে-
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাদান: মূলত এই ধরনের বিদ্যাপীঠের প্রধান উদ্দেশ্য দেশ ও বিশ্বের নিরিখে এমবিবিএস ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির অধুনা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কঠোর অনুসরণ। মাঝে এক বা দুই বছরের জন্য শুধুমাত্র আর্থিক সক্ষমতার জেরে প্রাইভেট মেডিক্যালে ভর্তি হতে পেরেছিলেন অনেকে। এমনকী দেশে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতাহীন অনেকের বাইরের দেশ থেকে ‘চিকিৎসক সনদ ’ নিয়ে আসার পথও ছিল খোলা। এ-নিয়ে কিংবদন্তী শিশু চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর এম.আর খান স্যার‘-কে ‘ব্যাঙের ছাতার মতো মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ’ গজিয়ে ওঠা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে ও হঁশিয়ারি সমেত উচ্চকন্ঠ হতে দেখেছি। তবে এইসব বিরূপ পরিস্থিতি উৎরাতে একটা জাতীয় নির্বাচনী পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যালে ভর্তি এবং বাইরে থেকে সনদ নিয়ে আসা চিকিৎসকদের ‘বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন’ পেতে বিএমডিসি কর্তৃক অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ কার্যকর পদক্ষেপ। ‘এমবিবিএস’ কোর্সের মান নিয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। এঁরা হলেন দেশের স্বাস্থ্য-সেবা ও ভবিষৎ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার প্রধান বুনিয়াদ ও উৎস। দেশের সোনার টুকরো মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরাই কেবলমাত্র মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পান। তাঁদের সঠিকভাবে অনুপ্রাণিত ও পরিচালনা করা গেলে কাক্সিক্ষত অর্জন সম্ভবপর।
শিক্ষা-চিকিৎসা গবেষণা :এই প্রতিষ্ঠানে বহু তারকা চিকিৎসক সবসময় ছিলেন ও থাকেন। যাঁরা আন্তর্জাতিক স্তরে চিকিৎসা গবেষণায় যুক্ত। বর্তমানে স্থাপিত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল শিক্ষা গুণমানে এবং গবেষণা কার্যক্রমে সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের-ও চিকিৎসা গবেষণায় সম্পৃক্ত করা উচিত।
চিকিৎসা সেবা : এইরুপ প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা সেবা প্রদানের অঙ্গ মূলত তিনটা-ক. জরুরি বিভাগ, খ. বহির্বিভাগ, গ. অন্তর্বিভাগ। আমার শিক্ষকতাকালীন তৎকালীন সম্মানিত হাসপাতাল পরিচালক সমূহের পৌরহিত্যে এই চিকিৎসা-সেবা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কী-ভাবে এর নতুন প্রাণ-সঞ্চার সম্ভব, তার রূপরেখা তৈরির কাজও চলছিলো।
দ্বিধা ছিল না বলতে-হাসপাতালের প্রতিটা বিভাগে শয্যা-সংখ্যার প্রায় তিন-চার গুণ ভর্তিকৃত রোগির চিকিৎসা সন্তোষজনক থাকার প্রধান শক্তি অভিজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসক ও এক ঝাঁক তীক্ষ্ণ মেধাবী তরুণ চিকিৎসক দল, সাথে প্রশিক্ষিত নার্স। সেকারণে এই সেবার মান কখনো তলানিতে নামে না। তবে সত্যিকার অর্থে একে বিশ্বমানে পৌঁছাতে হলে রোগী আনুপাতিক নার্স, চিকিৎসক, সরঞ্জামাদি বহাল রাখা জরুরি।
দেখেছি-শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে সর্বদা শয্যাসংখ্যার তিন-চার গুণ বেশি অসুস্থ শিশুর চিকিৎসা শেষে ‘মারাত্মক নিউমোনিয়ায়’ আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুহার থাকতো ১-২ শতাংশের ঘরে, যা উন্নত বিশ্বে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত ছুঁয়ে যেতো। কিন্তু এই স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নততর করে গড়ে তুলতে হলে অবিলম্বে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ওয়ানস্টপ ‘ইনভেস্টিগেশন টাওয়ার’। স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীর প্রচলিত শিক্ষা-কোর্স সমূহের বৈশ্বিক মান ধরে রাখার জন্যও এর বিকল্প নেই। তাছাড়া এই অঙ্গনে স্থাপন করা যায় সময়ে সময়ে মহামারি পরিস্থিতি সামলানোর মতো একটা ‘মহামারি ডেডিকেটেড’ স্থাপনা।
বলা বাহুল্য-বিএসএমএমইউ ব্যতিরেকে প্রথমোক্ত দুটো-জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগ বাংলাদেশের কোনো সরকারি মেডিক্যাল হাসপাতালে পুরো সক্ষমতা সমেত কাজে লাগানো যায়নি। যদিও এই দুটো বিভাগের মাধ্যমে প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা এবং হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পান। জরুরি বিভাগ আউটডোর ভর্তিকালীন সময়ের বাইরে হাসপাতালে ভর্তির একটা পয়েন্ট বা দ্বার হিসাবে কাজ করছিল প্রধানত। অনেকটা ‘ পেশেন্ট রিসিভিং জোন’ এর মতো। এতে ইমার্জেন্সি হয়ে ওয়ার্ডে শয্যা পেয়ে চিকিৎসার আওতায় আসতে যে সময় যায়, তাতে ‘ মারাত্নক অসুস্থ রোগীর’ প্রাণ রক্ষা করা কঠিন হয়ে ওঠে।
তাই জরুরি বিভাগ, শিশু, ইনজুরি, কার্ডিয়াক ও ইমার্জেন্সি কেয়ারের আওতায় থাকা সকল বিষয়ের তাৎক্ষণিক ‘লাইভ সেভিং রেসকিউ টিম’ সমেত সদা প্রস্তুত থাকার ব্যবস্থা যে এই মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতালে বিন্যস্ত হতে যাচ্ছে-তা অনেক বড় সুখবর।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতাল কেবল বাংলাদেশের এক গৌরবদীপ্ত চিকিৎসা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাত্র নয়। পাহাড় ঘেরা সবুজ পরিবেশের সাথে প্রায় ৮০ একরের মতো সুবিশাল আয়তনের নান্দনিক অবস্থান নিয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রয়োজনে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হোক- তাতেও ক্ষতি নেই, তবুও খণ্ড-ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত প্রকল্প গ্রহণ না করে, বড় চোখ, বৃহৎ অন্তর্দৃষ্টিসহ সামগ্রিক, সুসমন্বিত ছক বিন্যাসে একে আন্তর্জাতিক স্তরের চিকিৎসা-শিক্ষা-গবেষণার সর্বোচ্চ ইমেজে রূপদান করা যায়। তাতে সাধিত হবে আমাদের ‘সোনালি শিশু’ ও জনগণের ‘চাই বল-চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু ’।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।