বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ২১ জুন, ২০২১ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

বৃষ্টির পানি নিয়ে ভাবনা
বর্ষাকালে চট্টগ্রাম শহরে প্রচণ্ড জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি থৈ থৈ করে, এজন্য বর্ষাকাল চট্টগ্রাম শহরের মানুষের জন্য দুর্ভোগের হেতু হয়ে উঠে। এখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এই সমস্যা ছিলো না। তখন নগরের আয়তন ছোট ছিল। চারিদিকে ছিল পুকুর এবং দিঘি, খালগুলি সচল ছিল। ভারী বৃষ্টি হলে খুব কম সময়ের মধ্যে পানি নীচু এলাকায় চলে যেতো। ষাটের দশকে আমি কখনো চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা দেখিনি। চৈত্র মাসের শেষের দিক থেকে মানুষ বৃষ্টি আশা করতো। বৃষ্টি হলে ধানের বীজতলা তৈরি করা যেতো। রবি শস্যের চাষীরা ফাল্গুন মাসেও বৃষ্টি আশা করতো। তখন মাঘ মাসের শেষে সামান্য বৃষ্টি হলে লোকে বলতো, যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্যদেশ। আষাঢ় শ্রাবণ দুইমাস ভারী বৃষ্টি হতো। আমি শিশু বয়সে একটানা এগারো বারো দিন বৃষ্টি হতে দেখেছি। বর্ষাকালকে আমি জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ হিসেবে কাউকে বিবেচনা করতে দেখিনি। বৃষ্টি মানুষকে চাষাবাদের সুযোগ করে দিতো। বৃষ্টিতে আমরা পুকুরের পানি বের হওয়ার পথে (জান) কিংবা জমির আইলে ‘চাঁই’, ‘ডুগ’ বসিয়ে মাছ ধরতাম। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে উজানে উঠা কৈ, শিং, মাগুর মাছ ধরতাম। বর্ষাকালকে আমরা আল্লাহ্‌র রহমত মনে করতাম। কিন্তু আজ বর্ষাকাল নগরবাসীর জন্য মহাবিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি থৈ থৈ রাস্তাঘাটে। যানজটে, জলজটে মানুষ নাকাল। কিন্তু আমরা চাইলে বর্ষার এই অথৈ পানিকে বিশাল সম্পদে পরিণত করতে পারি। বৃষ্টির পানি এতো মূল্যবান সম্পদ-তা আমরা অচিরেই উপলব্ধি করতে পারবো। এখন বৃষ্টির পানি ধরে রাখা বা রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, বিজিএমইএ, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ সকল সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে বৃষ্টির পানি নিয়ে নতুন চিন্তা ভাবনা করতে হবে। এবং সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে কাজটা করতে হবে।
এখন চট্টগ্রাম নগরীতে যত হাইরাইজ ভবন আছে সব ভবনে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হয়। আমরা যখন ওয়াশরুমে গোসল করি, হাত-পা ধুই, কমোডে ফ্লাশ করি তখন আমরা প্রচুর পানি ব্যয় করি। এ পানি দিয়ে আমরা গাড়ি ধুই, ফ্লোর পরিষ্কার করি, বাগানে পানি সেচ দিই, কিন্তু এই পানির উৎস সম্পর্কে আমরা ভাবি না। এভাবে ব্যাপক ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে প্রতি বছর পানির স্তর ১০ থেকে ৩০ ফুট নীচে নেমে যাচ্ছে। এতে আমাদের জন্য ঝুঁকি তৈয়ারি হচ্ছে। ১৯৬০ সালের জলোচ্ছ্বাসের পর ৫০ থেকে ৬০ ফুট টিউবওয়েলের পাইপ ব্যবহার করলে প্রচুর পানি পাওয়া যেতো। আমাদের হালিশহর পতেঙ্গা এলাকায় ৬০ ফুটের বেশি গভীরে টিউবওয়েলের পাইপ বসাতে হয়নি। এখন ৫০০ ফুট গভীরেও পানি পাওয়া যায় না। ষাটের দশকে আনোয়ারা এলাকায় সামান্য গভীরতায় কুয়া খুঁড়লে সেটি পানিতে ভরে যেতো। আমাদের হালিশহরেও অসংখ্য কুয়া ছিল। এখন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নীচে নেমে গেছে। শিল্প কারখানাগুলিতে প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয়। ইস্পাত কল বা পোশাক শিল্পে কাপড় ধোয়ার জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। ডাইং এবং ওয়াশিং ফ্যাক্টরিগুলি মাটির তল থেকে অনেক পানি উত্তোলন করে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আমরা ভূমিধস বা ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবো। এই প্রেক্ষাপটে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং নিয়ে আমাদের চিন্তা ভাবনা করা উচিত।
২০০৫ কিংবা ২০০৬ সালের দিকের একটি ঘটনা এখনো আমার মনে আছে। আমি চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে আমার বাসায় আসছিলাম। তখন আমি একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, কলেজের সরকারি বাসায় আমি থাকতাম। প্লেনে আমার সাথে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যানের সাথে দেখা হয়। গাড়িতে উঠার সময় সিডিএ’র চেয়ারম্যান আমাকে বললেন, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে, আপনি যদি আমার গাড়িতে উঠেন তাহলে যেতে যেতে আলাপ করতে পারবো। গাড়িতে বসে উনি আমাকে বললেন, চট্টগ্রামে সিডিএ যখন ভবন নির্মাণের প্ল্যান দেয় তখন প্রত্যেক ভবনে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার অবকাঠামো সংযুক্ত করে দেওয়ার কথা আমরা ভাবছি। সারফেস ওয়াটার নষ্ট করা আমাদের জন্য ঠিক হচ্ছে না। যদি ভবন নির্মাণের সাথে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার অবকাঠামো বানানো যায় তাহলে ছয় মাসের পানি ধরে রাখা সম্ভব। অন্তত বাথরুমে এই পানি ব্যবহার করা যায়। বিদেশে ছোট আকারের পানি ট্রিটমেন্টের যন্ত্র আছে। সেরকম যন্ত্রও কিনে আনা যায়। তাহলে অন্তত ছয়মাস ভবন মালিকেরা কিংবা চট্টগ্রামের নাগরিকেরা ওয়াসা অথবা ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল থাকবে না। আমি বৃষ্টির পানি ধরে রাখা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি, অনেকের সাথে কথা বলেছি। আপনি তো লেখালেখি করেন, আপনার অনেক পাঠক আছে, আপনাকে আমি বিস্তারিত তথ্য দিবো। আপনি বিষয়টি নিয়ে লিখতে পারবেন? তারপর থেকে আমি রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং নিয়ে আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে নিবন্ধ পেলে তা মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। বর্তমানে কিছু মানুষ এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। উনাদের সাথেও কথাবার্তা বলেছি। এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাথরুমে একবার ব্যবহারিত পানিকে গ্রে ওয়াটার বলা হয়। গ্রে ওয়াটার ফেলে না দিয়ে তাকে ট্রিটমেন্ট করে পুনরায় ফ্লাসে ব্যবহার করা যায়। সে ব্যবহারিত পানিকে ব্ল্যাক ওয়াটার বলা হয়। এই ব্ল্যাক ওয়াটারকে আবার ট্রিটমেন্ট করে গ্রে ওয়াটার বানানো যায়।
এরপর আমি রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সম্পর্কে চট্টগ্রামের একজন সাবেক মন্ত্রীর বক্তব্য শুনি। এরকম জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য আমি কম শুনেছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মিটিংয়ে ২০১৯ সালে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এই বক্তব্য দেন। একই সিনেট মিটিংয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সম্পর্কে বক্তব্য দেন। উনাদের দুইজনের বক্তব্য প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নানও সংক্ষিপ্ত মতামত দেন। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হাজার একরেরও বেশি পাহাড়ি ভূমিতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার রিজার্ভার বা লেক, জলাধার বানানোর প্রস্তাব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন পানি এক বিশাল সম্পদ এটা একদিন মানুষ বুঝতে পারবে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বলেছেন মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এর ব্যাপারে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ভূগর্ভস্থ পানি একদিন শেষ হয়ে যাবে। ব্যক্তিগত ব্যবহার থেকে শুরু করে শিল্প কলকারখানার প্রয়োজনের সব পানি ভূগর্ভ থেকে তুললে একদিন পুরো চট্টগ্রাম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে। এই বক্তব্যকে জোরালোভাবে সমর্থন করে আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এর ব্যাপারে অনেক তথ্য তার বক্তব্যে উপস্থাপন করেছিলেন। সিঙ্গাপুরে এক সময় পানির আকাল ছিল। সমুদ্রের লোনা পানি ছাড়া ঐ দ্বীপে পানি ছিলোনা বললেই চলে। তাদেরকে মালয়েশিয়া থেকে জাহাজ ভর্তি করে পানি কিনে আনতে হতো। এখন তারা সমুদ্রের পানি ট্রিটমেন্ট করে ব্যবহার উপযোগী করেছে। তারা পানির অপচয় করেনা। এমনকি বাথরুমের পানি ট্রিটমেন্ট করে পুনরায় ব্যবহার করার ব্যবস্থাও তারা করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে, তা ব্যবহার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। রাজউক ইতিমধ্যে ভবন নির্মাণকারীদের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের শর্ত প্ল্যানে জুড়ে দিয়েছে।
আমাদের দেশের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির একগজ কাপড় ধোয়ার জন্য কয়শো লিটার পানি খরচ হয় তার হিসাব আপনারা পাবেন। আগে যতো সহজে কারখানা মালিকেরা ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করতো, এখন অবস্থা সেরকম নাই। ভূগর্ভস্থ পানি নীচে নেমে যাওয়ার পর এখন পানির সাথে নানা রকম কেমিক্যাল চলে আসে। টাকা খরচ করে সে পানি পিউরিফাই করতে হয়। কিন্তু বৃষ্টির পানি কেমিক্যাল বিহীন। এটা সহজেই ব্যবহার করা যায়। এখন চট্টগ্রামে অনেক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বৃষ্টির পানি ধরে রাখার অবকাঠামো বানিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গ্রীণ ফ্যাক্টরি এখন বাংলাদেশে। বিজিএমইএ বলেছে তারা রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এর ব্যাপারে আরো তৎপর হবে। চট্টগ্রামের একটি ইস্পাত ফ্যাক্টরি সীতাকুণ্ডে তাদের কারখানা ক্যাম্পাসের ভিতরে ৫৫ একর জমির উপরে একটি লেক বানিয়েছে যাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয়। এই ফ্যাক্টরির নাম জিপিএইচ ইস্পাত। তারা বৃষ্টির পানি দিয়ে তাদের কারখানা চালায়। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ সাহেব আজ থেকে আড়াই বছর আগে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এর ব্যাপারে যেসব কথা বলেছিলেন আজ তা আমরা বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি। চট্টগ্রামের সকল আবাসিক ভবনে এবং কলকারখানায় আজ হোক বা কাল হোক বৃষ্টির পানি ধরে রাখার অবকাঠামো ভবন নির্মাণের প্ল্যানের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। ৯০’র দশকে আমি লক্ষ্মীপুর কলেজে চাকরি করেছি। সেখানে প্রায় সকল টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক আসতো। এই পানি খাওয়া যেতো না। খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়তো। সেখানে খাবার পানি সরবরাহের জন্য ড্যানিডার একটি প্রকল্প ছিল।
প্রাচীন কাল থেকে আমরা পুকুর বা দীঘির পানি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তখন কেউ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতো না। তখন পানি বলতে বুঝাতো সারফেস ওয়াটার। তখন পানি নিয়ে আমাদের কখনো কোন চিন্তা ভাবনা করতে হয়নি। আমরা যদি সম্পূর্ণরূপে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হই তাহলে আমরা বিপর্যয়ের হাত থেকে চট্টগ্রামকে রক্ষা করতে পারবো না। চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার পেছনেও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ না করা অন্যতম কারণ হতে পারে। কয়েক বছর আগে যখন জলাবদ্ধতা দূরীকরণের প্রকল্পগুলি বানানো হয়, তখন মনে করা হয়েছিল ৭০ শতাংশ বৃষ্টির পানি খাল, নালা দিয়ে নদী বা সাগরে চলে যাবে। ৩০ শতাংশ পানি মাটি শুষে নিবে। তা ভূগর্ভে চলে যাবে। এখন খাল, নালা যেমন ভরে গেছে তেমনি শহরের বিশাল অংশ ভবনে ঢেকে গেছে। শহরে এখন আর মাটি দেখা যায় না। ফলে ৩০ শতাংশ বৃষ্টির পানি মাটি শুষে নিতে পারে না। এটা জলাবদ্ধতাকে আরো জোরদার করে। এর বিকল্প হিসেবে শহরের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানির ৩০ শতাংশ টিউবওয়েলের পাইপের মধ্য দিয়ে ভূগর্ভে ফেরত পাঠানোর কৌশল নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা-শিক্ষা : আধুনিকায়ন প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধঅন্যকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই ফাঁসলেন র‌্যাবের জালে