চট্টগ্রাম নামের ইতিবৃত্ত

পেন্টাপলিস, গঙ্গা, হরিকেল, চাটিগাঁও

ড. সালমা বিনতে শফিক | বৃহস্পতিবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

অনেক অনেক কাল আগের কথা। চট্টগ্রাম নামের কোন অস্তিত্ব তখন ছিল না বিশ্বমানচিত্রের কোথাও। পাহাড়, সাগর, অরণ্য ঘেরা উদ্যান সদৃশ এই অঞ্চলটি তখন ছিল জিনপরীদের রাজ্য। একটি পাথর খণ্ডে চড়ে নদী পাড়ি দিয়ে আসা সাধু পুরুষ বদর পীর তাঁর বসবাসের জন্য কর্ণফুলী নদীর তীরের এক টিলার ওপর ডেরা নির্মাণ করেন। ডেরায় স্থাপিত চাটি বা মাটির প্রদীপ থেকে ঠিকরে বের হওয়া অলৌকিক আলোকচ্ছটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না জিন পরীরা। দ্রুতই অদৃশ্য হয় তারা। পীর বদর স্থানটির নামকরণ করেন ‘চাটিগাঁও’। ধীরে ধীরে মানব বসতি গড়ে ওঠে সাগর পাড়ের এই অনিন্দ্য সুন্দর জনপদে, কালক্রমে যা চট্টগ্রাম নাম নিয়ে পরিচিতি লাভ করে বিশ্ব ইতিহাসের পাতায়।
চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস ও নামকরণ নিয়ে ওপরের গল্পটিতে ঐতিহাসিক বাস্তবতার পরিবর্তে অন্ধবিশ্বাসের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়, তবে আজও অনেকে গল্পটিকে সত্য বলে মানে। জিনপরীদের রাজত্বের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা না থাকলেও পীর বদরের নাম মিশে আছে চট্টগ্রামের সঙ্গে। পীর বদরের সমাধি সংলগ্ন এলাকা বদরপট্টি নামে পরিচিত। বদর পীরের চাটির কথা এখনও অনেক ভক্তি ভরে স্মরণ করে। পীর বদরের নামে যাত্রা শুরু করে জেলে নাবিকেরা, ‘বদর বদর হেঁইয়ো’ বলে হাঁক দিয়ে শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করে দুর্গম সমুদ্র যাত্রার প্রাক্কালে।
অষ্টম শতকের পূর্বের চট্টগ্রাম সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়নি মনে করে এতকাল কুসংস্কারের পক্ষেই পাল্লা ভারী ছিল। কিন্তু খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকেই গ্রীক দেশের বাণিজ্যতরী মিশর পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তরে গঙ্গা নদীর মোহনায় অবতরণ করার দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়, যা থেকে অনুমান করা যায় সুপ্রাচীন কাল থেকেই চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। বাংলার মসলিন, মুক্তা আর মসলার আকর্ষণে ইউরোপের বণিকেরা এ বন্দরে জাহাজ ভেড়াত দু’হাজার বছর আগেও। তাদের অনেকে বাংলা বলতে চট্টগ্রামকেই বোঝাত।
ভারতের স্বর্গভূমি বাংলার প্রবেশদ্বার হিসেবে চট্টগ্রামের খ্যাতি প্রাচীন কাল হতেই। তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হত ব্যস্ততম এই সমুদ্র বন্দরকে। খ্রিষ্টীয় প্রথম অব্দে গ্রীকভাষী এক মিশরীয় নাবিক অজানার উদ্দেশ্যে জাহাজ ভাসিয়েছিলেন মিশরের ম্যাওস হরমোস বন্দর হতে। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গঙ্গা নদীর পূর্ব তীরের এক বন্দরে নোঙর ফেলেন অজ্ঞাতনামা সেই নাবিক। নদীর নামে সেই বন্দরকেও গঙ্গা নামে ডাকা হত। সেই সমৃদ্ধ বন্দরের কথা লিখে রাখেন তিনি তাঁর দিনলিপিতে। ‘পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি’ নামে কালক্রমে অমরত্ব লাভ করে তাঁর রচনা। গ্রীক ভাষায় রচিত এই কালজয়ী গ্রন্থটিতে লেখক গঙ্গা নামের বন্দরের ঐশ্বর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। মসলিন, সুগন্ধি ও মুক্তা এই বন্দর দিয়েই ছড়িয়ে পড়ত বিশ্ববাজারে। ‘কালটিস’ নামের স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত ছিল এই বন্দরে।
গ্রীক জ্যোতির্বিদ, ভূগোলবিদ, গণিতবিদ ও সংগীত তাত্ত্বিক টলেমীর মানচিত্রে উল্লেখিত ‘কাতাবেদাস’ নদীর উত্তরে অবস্থিত ‘পেন্টাপলিস’ শহরই যে পেরিপ্লাসের সেই ‘গঙ্গা’ নগরী তা আজ প্রমাণিত। আর টলেমীর কাতাবেদাসই যে কর্ণফুলী সে বিষয়েও ঐক্যমতে পৌঁছেছেন ঐতিহাসিকগণ। লুসাই পাহাড় থেকে জন্ম নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে সমতলের ওপর দিয়ে আরও অনেকটা পথ পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকে নিজেকে সঁপে দেয় এই নদী। তবে ‘কাতাবেদাস’ কেমন করে কর্ণফুলী নাম পেল! কর্ণফুলীকে ঘিরে পৌরাণিক গল্পগাথা নানান শাখা প্রশাখা বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়েছে লোকমুখে। কিংবদন্তি মতে, আরাকানের রাজকুমারীকে ভালোবাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের এক উপজাতি রাজকুমার। এক পূর্ণিমা রাতে নৌবিহারে বের হয় দু’জন। ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে রাজকুমার প্রেয়সীর কানে ফুল গুঁজে দেয়। অপার্থিব মায়াবী আলোয় উদ্বেলিত রাজকুমারী ঝুঁকে গিয়ে জলস্পর্শ করতে গেলে কান থেকে ফুল পড়ে যায় নদীতে। প্রাণের মানুষের দেয়া এ বনফুল তার কাছে হীরের চেয়ে দামি। ফুল বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজকুমারী। রাজকুমারও ঝাঁপ দেয়, কিন্তু তার আগেই তলিয়ে যায় রাজকুমারী। মনের দুঃখে নদীতেই আত্মাহুতি দেয় রাজকুমার। অমর প্রেমের কাব্যগাথা রচিত হয় এই নদীকে ঘিরে। কানের ফুল নিয়ে যে নদীর বুকে অমর প্রেমের উপাখ্যান রচিত হয়, কর্ণফুলী ছাড়া অন্য কোনো নামে তাকে মানাত কি? তবে কর্ণফুলী নামের উৎস নিয়ে আরও গল্পও প্রচলিত আছে।
কর্ণফুলীর তীর ঘেঁসে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক বন্দর শহরটির নাম কেমন করে চট্টগ্রাম হল, তা নিয়েও আছে নানা মুনির নানা মত। শেকড় সন্ধানী ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম নামের উৎসের অনুসন্ধান করতে গিয়ে অন্তত পনেরটি নাম খুঁজে পেয়েছেন। সবগুলো নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নানা রকম গল্পগাথা। ঐতিহাসিকগণ কোনো গল্পকেই পুরোপুরি বাতিল করে দেননি।
প্রাচীন যুগে সমুদ্র তীরবর্তী এ অঞ্চলটি হরিকেল নামে পরিচিত ছিল। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল নিয়ে হরিকেল রাজ্য গঠিত হলেও, ক্রমান্বয়ে এ রাজ্যের সীমানা আরও বিস্তার লাভ করে। প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের রাজধানী ছিল বর্ধমানপুর, যা লোকমুখে বিকৃত হয়ে বড় উটান (উঠান) নামে উচ্চারিত হচ্ছে। দেয়াং পাহাড়ের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত দেবগ্রাম ছিল হরিকেল রাজ্যের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র।
পরম মমতায় জড়িয়ে রাখা নদ- নদী এই ভূখণ্ডকে উর্বরতা দানের পাশাপাশি প্রাকৃতিক সুরক্ষা বলয়ও তৈরি করে। সমুদ্র তটাঞ্চল লবণ উৎপাদন ও মৎস্য সম্পদের জন্য বিখ্যাত ছিল। সমুদ্রোপকুলবর্তী হওয়ায় নৌবাণিজ্যের মাধ্যমেও দূর দুরান্তের সাথে সংযোগ ছিল, যা হরিকেল রাজ্যের অর্থনীতির মজবুত ভিত রচনা করে দেয়। হরিকেল রাজ্যে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ব্যবহৃত হত, যা এ রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে। চীনদেশীয় পরিব্রাজক ইথ সিং, তেন কাওং, ইউ হে’র বর্ণনায় হরিকেল রাজ্যের সমৃদ্ধির কথা জানা যায়। সপ্তম শতকে আগত পরিব্রাজক হিউয়েন সাং চট্টগ্রামকে ‘ধ ংষববঢ়রহম নবধঁঃু বসবৎমরহম ভৎড়স সরংঃং ধহফ ধিঃবৎ’ বলে উল্লেখ করেন।
জ্ঞানচর্চায়ও প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের সুনাম ছিল। প্রধান বন্দর দেবগ্রাম সংলগ্ন বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র পণ্ডিতবিহার মহাবিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে চীনের সঙ্গে ভারতের নৌ যোগাযোগ স্থাপিত হলে চীন ও দূরপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু, তীর্থযাত্রী ও শিক্ষার্থীরা দলে দলে ভারতে আগমন করে। তেন কাওং ও ইউ হে দেবগ্রামের পণ্ডিত বিহারে অবস্থান করেছিলেন।
আরাকানি রাজবংশের পুঁথি থেকে জানা যায় যে, আরাকনের চন্দ্রবংশীয় রাজা সুলা তাইং সান্ডায়া ৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধাভিযানে বের হওয়ার কিছুদিন পর হরিকেল রাজ্য জয় করে কর্ণফুলী নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত এক শহরে এসে আর যুদ্ধ না করতে মনস্থির করেন। সেই শহরে তিনি একটি বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ করেন, যার ওপর ‘চেত তৌ গং’ শব্দ টি উৎকীর্ণ করা হয়, ইংরেজি অক্ষরে সাজালে শব্দটি হয় ঈযরঃ-ঃধ-মড়হম, যার বাংলা অনুবাদ ‘যুদ্ধ করা অনুচিত’। অমর চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের গুপী বাঘার একটি গানের কথা মনে পড়ে যায়- ‘রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্ব অমঙ্গল, তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল…ও-রে হাল্লা রাজার সেনা…’। কিন্তু আরাকানের দুর্ধর্ষ রাজা যুদ্ধের বেশে রাজ্য জয় করতে এসে মাঝপথ থেকে ফিরে গেলেন কেন? ধারনা করা হয় হরিকেল রাজ্যের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রাজাকে শান্তির বাণী শুনিয়ে যুদ্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে সম্রাট অশোক যেমন করে যুদ্ধ বাদ দিয়ে ধর্মে মন দিয়েছিলেন, আরাকান রাজ সুলা তাইংও সম্ভবত তেমনি করে যুদ্ধ পরিহারের সিদ্ধান্ত নেন। একুশ শতকের মহাশক্তিধর নৃপতিদের মনে শান্তির বাণী পৌঁছে দেওয়ার কেউ নেই বলেই হয়তো দেশে দেশে, নগরে নগরে, জনপদে জনপদে আজও চলছে চলছে যুদ্ধের বিভীষিকা।
তবে হরিকেল রাজ্যও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। পাঁচশ বছরের ইতিহাসে হরিকেল রাজ্যের সীমানা বহুবার বৃদ্ধি পায়, আবার সংকুচিতও হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রতিবেশী বৃহৎ রাজ্যগুলোর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় এ রাজ্য। একাদশ শতকের প্রথম চতুর্থাব্দে আরাকানের প্রতাপশালী পঁগা রাজবংশের সীমা উত্তর ও মধ্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পঁগা রাজবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাজা অলংফিউ (১২৩৭-১২৪৩) আরাকান রাজ্যের সীমানা আরও বৃদ্ধি করেন এবং হরিকেল রাজ্যের সার্বভৌমত্বকে করায়ত্ত করেন।
খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দী থেকে চট্টগ্রামে আরব বণিকদের যাতায়াত শুরু হয় বলে জানা যায়। আরব ঐতিহাসিকগণ তাঁদের রচনায় চট্টগ্রামকে রহমি, সমন্দর, শাতিজাম- বলে উল্লেখ করেন। বাণিজ্যপরায়ণ আরব বণিকদের রাজ্যজয় বা ধর্মপ্রচারের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তবে তাঁদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত কিছু ধর্মপ্রচারক নিজেদের মতো করে ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম মুসলিম পর্যটক হিসেবে যিনি চট্টগ্রাম বন্দরে অবতরণ করেন, তিনি মরক্কোর ইবনে বতুতা। তাঁর বর্ণনায় ‘সাদকাওয়ান’ নামে যে বন্দরের কথা উল্লেখ করেন, তাকে চাটগাঁও বা চট্টগ্রামের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন ঐতিহাসিকগণ। সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের যত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা ছিল, তার বেশীর ভাগই চট্টগ্রামে নির্মিত ছিল ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘রাহেলা’ তে উল্লেখ করেন, যা থেকে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য যে হাজার বছরের, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মধ্যযুগেও ইউরোপীয়দের কাছে চট্টগ্রামের গুরুত্ব এতটুকু কমেনি, বরং বেড়েছে। বলাবাহুল্য, বাংলার সমৃদ্ধ অর্থনীতিই ছিল এই আকর্ষণের কারণ। আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কেন্দ্র তখনও চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের নাম তখন ইউরোপীয়দের মুখে মুখে। ভাস্কো- দা- গামা ভারতের জলপথ আবিষ্কারের পর ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ইউরোপীয় জাহাজের আনাগোনা বেড়ে যায়। ইউরোপীয় নাবিক ও ভ্রমণকারীদের অনেকে একবার চোখের দেখার জন্য হলেও চট্টগ্রামে অবতরণ করেন, এবং সীমাহীন মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে যান। তাঁদের অনেকেই স্মৃতিকথায় সেই অপূর্ব সুন্দর বন্দরটির কথা লিপিবদ্ধ করেন। ইতালির পর্যটক লুডোভিকো ভারথেমা চট্টগ্রাম এসেছিলেন ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে। চট্টগ্রাম নয়, তিনি লিখেছিলেন ‘সিটি অব বাঙ্গেলা’। যত নগর তিনি দেখেছেন, কোনোটাই সিটি অব বাঙ্গেলার মতো করে তাঁকে মুগ্ধ করতে পারেনি। ভারথেমার ভাষায়, ‘এত বেশী ধনী ব্যবসায়ী আমি অন্য কোন দেশে দেখিনি’। কথাটা হয়তো আজকের দিনের জন্যও সত্যি। তবে ‘সিটি অব বাঙ্গেলা’ ছেড়ে যাবার প্রাক্কালে ভারথেমার – ‘আমার ধারনা বাস করার পক্ষে এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর’- এই অভিমতকে আজ আর সত্যি বলে মেনে নেওয়া যায় কিনা, তা এই শহরের আধিবাসীগণই ভাল বলতে পারবেন।
পর্তুগীজ কর্মচারী দুয়ার্তে বারবোসাও চট্টগ্রাম আসেন ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। সমুদ্রের উত্তর ভাগের বন্দর নগরটিকে তিনি ‘বাঙ্গালা’ বলে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, ‘স্বাধীন মুসলমান রাজার শাসনাধীন এ রাজ্যে পৃথিবীর নানা দেশের লোকের বাস। এরা সকলেই বড় বড় সওদাগর। বন্দরে মক্কা ইয়েমেনের জাহাজ আসে, চীনদেশের জাহাজও দেখা যায়। দেশটি খুব বড় ও উর্বর, আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর’। বারবোসার বিবরণ থেকে ষোড়শ শতকের চট্টগ্রামের একটা পরিস্কার ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পর্তুগীজ পর্যটক জোয়াও দে বারোসের বর্ণনায় ষোড়শ শতকের ‘চাটিগাঁও’ শহরের কথা জানা যায়। তাঁর ভাষায়, ‘এই‘চাটিগাঁও’ শহরটিই এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ আর সম্পদশালী শহর”।
এই সমৃদ্ধিই হয়তো কাল হয়েছিল শহরটির জন্য। পর্তুগীজদের চোখ পড়েছিল এই সমৃদ্ধ শহরের ওপর। হোসেন শাহী আমলের স্বর্ণযুগে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে যায় পর্তুগীজ জাহাজ। উত্তাল বঙ্গোপসাগরের প্রতিটি ঢেউ- এ লেখা আছে হার্মাদদের নির্মমতার কথা। ‘অশুভ কালো ধোঁয়া’র মতো মহা ‘আতংকের ছায়া’ ছড়িয়ে পড়ে সাগর তীর থেকে লোকালয়ে। ‘সারি বাঁধা জাহাজগুলো ঢেউ কেটে ক্ষুধার্ত হাঙরের মতো এগিয়ে আসে শিকারের দিকে’। ‘হার্মাদ আসছে’ ভয়ে দিগ্‌িবদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে পালাতে শুরু করে মানুষগুলো- কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের কলমে সেদিনের ছবি আঁকা হয়েছিল অনেকটা এইভাবে।
‘হার্মাদ’ শব্দটির উৎপত্তি স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের জাহাজ বহর ‘স্প্যানিশ আর্মাডা’ থেকে। ষোড়শ শতকে আইবেরিয়ান উপদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত স্পেন ও পর্তুগীজ সাম্রাজ্য একীভূত হওয়ায় আর্মাডা যাত্রা শুরু করেছিল পর্তুগালের লিসবন বন্দর হতে। ক্যাথলিক স্পেন প্রোটেস্টেন্ট ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে শক্তিশালী নৌবহর সাজায়, শেষ পর্যন্ত রানী প্রথম এলিজাবেথের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ইংরেজ নৌশক্তির কাছে তা পরাজিত হলেও ষোড়শ শতকের মাঝামাঝিতে এই আর্মাডাকে অজেয়ই মনে করা হত। উল্লেখ্য, পর্তুগীজদের চট্টগ্রাম জয়ের সময় এক প্রকার অজেয়ই ছিল এই ‘আর্মাডা’। পৃথিবীর নানান ভাষার মতো ‘আর্মাডা’ও চট্টগ্রামে এসে লোকমুখে কিছুটা বিকৃত হয়ে ‘হার্মাদ’ নামে পরিচিত হয়ে যায়, ঠিক যেমন করে ‘ফ্রাঙ্ক’ হয়ে যায় ফিরিঙ্গি। পর্তুগীজ নাবিক ও জলদস্যুদের ফ্রাঙ্কের আঞ্চলিক পরিভাষায় ‘ফিরিঙ্গি’ নামে ডাকা হত। চট্টগ্রাম বন্দরের সন্নিকটে গড়ে ওঠা পর্তুগীজ বসতি এতকাল পরও তাই ‘ফিরিঙ্গিবাজার’ নামে পরিচিত।
বাণিজ্যের নামে হার্মাদ ফিরিঙ্গিরা লুঠতরাজ, নির্যাতন ও দাসব্যবসা চালিয়ে যায়। আর তাদের সঙ্গে আগত যাজক সমপ্রদায় মনোনিবেশ করেন ধর্মপ্রচারে। কর্ণফুলীর তীরে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়ে বন্দরের বিশালতা আর প্রাচুর্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়ে পর্তুগীজ নাবিক। বন্দরের নাম দেয় ‘পোর্টো গ্রান্ডে’ বা বৃহৎ বন্দর। অনেক ছলচাতুরী ও দেন দরবার করে এবং স্থানীয় শাসকদের আন্তঃকোন্দলের সুযোগ নিয়ে স্থাপন করে বাণিজ্যকুঠি (১৫৩৬)। অচিরেই তারা স্থাপন করে শুল্ক ভবন, এবং এরই সুত্র ধরে স্থাপিত হয় পর্তুগীজ উপনিবেশ। বলাবাহুল্য, বণিকবৃত্তি ছাপিয়ে দস্যুবৃত্তিতেই বেশী মনযোগী ছিল পর্তুগীজরা। চট্টগ্রাম থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে ফিরিঙ্গিরা। পর্তুগীজদের পায়ের চিহ্ন ধরে বঙ্গোপসাগর হয়ে কর্ণফুলীর তীরে একে একে নোঙর ফেলে ওলন্দাজ, ফরাসী আর ইংরেজ জাহাজ।
ষোড়শ শতক ছিল চট্টগ্রাম তথা বাংলার জন্য এক অস্থির সময়। সমগ্র ভারতই তখন অতিক্রম করছিল এক ক্রান্তিকাল। দিল্লির সিংহাসন হাত বদল হয়ে রাজদণ্ড চলে আসে মোগলদের কাছে। পর্তুগীজরা কখনও রাজশক্তির কোপানলে পড়ে, আবার কখনওবা অনুগ্রহ লাভ করে। ১৫৩৮ সাল থেকে চট্টগ্রাম কার্যত পর্তুগীজরাই শাসন করে। পরবর্তী ১২৮ বছর আরাকানি মগদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পর্তুগীজ ফিরিঙ্গিরা ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে চট্টগ্রামে। ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খানের নেতৃত্বে মোগল বিজয়ের পর শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃস্থাপিত হয় এই বন্দর শহরে। চট্টগ্রামের নামকরণ করা হয় ইসলামাবাদ। শান্তি স্থাপিত হলেও নৌবাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ে চট্টগ্রাম তথা ইসলামাবাদ, কারণ মধ্য এশিয়া থেকে আগত মোগলরা সমুদ্রকে এড়িয়ে স্থলপথেই সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তাছাড়া একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হওয়ায়ও এ অঞ্চলের অগ্রগতি অনেকটা পিছিয়ে যায়।
শতবর্ষ পরে ভারতবর্ষে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে চট্টগ্রামের গুরুত্ব আরও কমতে থাকে। কলকাতা হয়ে ওঠে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। তবে চট্টগ্রামের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠায় মরিয়া ছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। চট্টগ্রামকে শাসন করার জন্য স্থানীয় সরকারের ভাবনা নিয়ে অবতীর্ণ হয় ইংরেজ প্রতিনিধি। এরই সুত্র ধরে প্রশাসনিক সংস্কার হয়। ক্রমান্বয়ে স্থাপিত হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হয়। উনিশ শতকে প্রতিষ্ঠা হয় রেলপথ। নতুন রূপে সাজতে শুরু করে চট্টগ্রাম, ইংরেজরা যার নাম দেয় চিটাগং।
বর্মী আগ্রাসন তখনও চলছিল কিছুটা বিরতি দিয়ে। ইংরেজ প্রশাসন চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ও উন্নতি বিধানে সচেষ্ট ছিল, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। শুধু চট্টগ্রাম নয়, সমগ্র বাংলা তথা ভারতের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিশেষ মনযোগ দিয়েছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। কিন্তু দৃশ্যমান উন্নয়নই শেষকথা নয়। ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়?’ – এই মন্ত্র বুকে ধারন করে পরাশক্তির অপশাসন থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার শপথ নেয় বাঙালি ও ভারতবাসী। বিপ্লবের ফুল ফোটে চট্টগ্রাম হতেই। এক সাগর রক্তের বিনিমিয়ে বাংলাদেশ নামের সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক সংবাদ প্রথম প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিকে আজাদীতে ‘জয় বাংলার জয়’ শিরোনামে।
বৈচিত্র্য ও বিভ্রান্তিতে ভরা চট্টগ্রামের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে এ বন্দর শহরের সমৃদ্ধির কথা, গৌরবের কথা (একই সঙ্গে বঞ্চনা ও নির্যাতনের কথাও)। তবে প্রাচুর্যই এই সমৃদ্ধি ও গৌরবের একমাত্র উপকরণ ছিলনা। পাহাড়, সাগর, অরণ্য, নদ-নদী সহ প্রকৃতির যাবতীয় আশীর্বাদের পাশাপাশি অধিবাসীদের পারাস্পরিক সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও সৃজনশীলতা এ অঞ্চলকে বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। নানান জাতির নানান ভাষার মানুষের মিলনমেলায় গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও স্বাতন্ত্র্য বৈশিস্ট্য দান করেছে এ অঞ্চলকে। প্রকৃতির দানের সুরক্ষা ও সদ্ব্যবহার আর বৈচিত্র্য অটুট রেখে সম্মিলনেই হতে পারে নতুন দিনের সূর্যোদয়।
তথ্যসূত্র : উত্তর পুরুষ- রিজিয়া রহমান
উপনিবেশ চট্টগ্রাম, ৫০০ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস- হারুন রশীদ
প্রাচীন হরিকেল রাজ্য ও মধ্য চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত- সুনীতিভূষণ কানুনগো
বন্দর শহর চট্টগ্রাম- আবদুল হক চৌধুরী
বাংলাপিডিয়া
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআঁরার ঐতিহ্য আঁরার নুন
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের মানুষ অসামপ্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী : সিএমপি কমিশনার