স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ১৯৭২ –৭৩ সালে প্রথম যে জাতীয় বাজেটটি সংসদে পাশ করে তার মোট আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। ৫২ বছর পরে এসে ২০২৩–২৪ সালের জাতীয় বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বেড়েছে, কমেছে বিদেশ নির্ভরতা। ফলে আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন গতি পেয়েছে। বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে অনেক মেগা প্রকল্প। তবে এটাও ঠিক মেগাপ্রকল্পগুলোতে নানা পন্থায় দুর্নীতি অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রকল্প পরিকল্পনাকালেই এর সূচনা ঘটছে। আবার বিদেশী ঋণে অপ্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্প গ্রহণ করে দেশ ও জাতির ক্ষতি সাধনে তৎপর একটি চক্র। প্রকল্প শুরু হওয়ার পর তা সংশোধন বা সংযোজনের নামে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে নেয় এরা। বাড়ানো হয় প্রকল্প মেয়াদ। এর বাইরে অস্থিত্বহীন ভূতুড়ে এবং অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের সাড়ম্বর আয়োজনও চলে পারস্পরিক যোগসাজশে। কোনও প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দ কম হলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এর বাস্তবায়নে অহেতুক কালক্ষেপণ করার পাশাপাশি ব্যয় বাড়ানোর নানারকম উপায় খুঁজতে থাকেন। এমন প্রকল্পও আছে যেখানে প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ ৯০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মেগা প্রকল্পের নামে বিদেশী ঋণ গ্রহণের প্রবণতাও বেড়েছে। এতে করে দেশ ক্রমেই ঋণগ্রস্ত হচ্ছে এবং আমাদের মাথাপিছু ঋণহার বাড়ছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও দুর্নীতির এসব লুটপাটের মহোৎসবে জড়িত থাকেন রথী–মহারথীরাও। তারা থেকে যান ধরা–ছোঁয়ার বাইরে। ঠিকাদারের সাথে যোগসাজশে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিক বাড়ানোর পেছনে কাজ করে সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট দেশি–বিদেশি ঠিকাদারদের কাছ থেকে বড় ধরনের সুযোগ–সুবিধা নিয়ে নিজেরা নব্য ধনীতে পরিণত হলেও দেশকে ঠেলে দিচ্ছে বিপর্যয়ের দিকে।
উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের পূর্বে প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষাকে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের দলিল হিসেবে মনে করলেও বাংলাদেশে ঘটে উল্টোটা। পরিকল্পনা কমিশনের নিয়ম মানার জন্যে হয়তো লোকদেখানো সমীক্ষা বা সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই মানেই যেন একটা প্রকল্প তৈরির অনিবার্যতা– এমন একটা সংস্কৃতি এখানে চালু হয়েছে। আর যারা সমীক্ষা করেন তারাও জানেন, পরবর্তীতে এটি মানা হবে না, কেউ এর খোঁজও করবে না।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত ৮ আগস্ট ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে বলেছেন, বর্তমানে আমরা উচ্চমাত্রায় ঋণগ্রস্ত। সারাবিশ্ব কঠিন এক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর আঁচ বাংলাদেশেও লেগেছে। সে হিসেবে বাংলাদেশও সংকটকালীন সময় পার করছে। এমন সংকটজনক অবস্থায়ও বিদেশী ঋণে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের তৎপরতা বন্ধ হয়নি।
২
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক অতিব্যস্ততম একটি মহাসড়ক। এটি এখনও চারলেনে উন্নীত করার কাজটি এখনো করা যায়নি। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সীর (জাইকা) কাছ থেকে ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে চারটি স্থানে নতুন আটটি সেতুর নির্মাণ কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। পুরানো দুই লেনের সেতু ভেঙে ফেলে তিন লেন করে পাশপাশি দুটি সেতু নির্মিত হয়েছে আগামীর ছয় লেনের কথা মাথায় রেখে। সেতুগুলি হচ্ছে চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীর এবং দোহাজারীতে সাঙ্গু নদের উপর, চন্দনাইশে বরুমতী খাল এবং পটিয়ার ইন্দ্রপোলে। চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন ধরে। সেটি বাস্তবায়নের কোনও তাড়া নেই। এরই মধ্যে জাইকার কাছ থেকে ৯০০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নতুন আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়নে তোড়জোর শুরু হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় পটিয়া, দোহাজারী, লোহাগাড়া ও চকরিয়া বাইপাস এবং সাতকানিয়ার কেরানীহাটে ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে জাইকা ৩৫০০ কোটি টাকা অর্থায়নে সম্মত হয়েছে। জাপানের সাথে বাংলাদেশের এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির কাজ চলছে। ডিপিপি চূড়ান্ত হলে তা একনেক সভায় উত্থাপিত হবে। প্রকল্পের অধীনে চারটি বাইপাস ও একটি ফ্লাইওভারের মোট দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার। এরমধ্যে দোহাজারী এবং চকরিয়ায় সাঙ্গু এবং মাতা মুহুরী নদীর উপর নতুন করে চারটি সেতু তৈরি করা হবে। সম্প্রতি নদী দুটির উপর পুরানো ব্রিজ ভেঙে তিন লেনের দুটি করে সেতু তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পর আবার কাছাকাছি নতুন করে সেতু নির্মাণ করতে হবে বাইপাসের কারণে। এ নিয়ে নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। অনেকেই ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হবে। সবচেয়ে বড় কথা অপ্রয়োজনীয় এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হবে। বিদেশী ঋণের বোঝা জাতির ঘাড়ে চাপবে। ঋণ করে ঘি খাওয়ার এক মহাউদ্যোগ হচ্ছে এই প্রকল্প। বাইপাস যদি করার চিন্তা থাকে তাহলে সাঙ্গু–মাতা মুহুরীর উপরে ছয় লেনের নতুন সেতু করার আগে কেন তা করা হল না? তাহলে একই নদীতে কাছাকাছি স্থানে পুনরায় সেতু নির্মাণের প্রয়োজন পড়ত না। তাছাড়া চারলেনে উন্নীত করার অতি জরুরি কাজটি ফেলে রেখে অপ্রয়োজনীয় সেতু–বাইপাস কেন জরুরি হয়ে পড়ল?
৩
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করতে ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই টানেল অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি পাল্টে দেবে এমনটাই আলোচিত হচ্ছে। আলোচনায় আছে আনোয়ারা– বাঁশখালী–পেকুয়া হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন মহাসড়ক নির্মাণের। যা হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৫০ কিলোমিটারের বেশি কমে যাবে। টানেলকে শতভাগ ব্যবহার করতে এই বিকল্প মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ পরিকল্পনায় রয়েছে। ঢাকাসহ বাইরের জেলাগুলির সকল যানবাহন চট্টগ্রাম মহানগরী এড়িয়ে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজার যাওয়া–আসা করবে। এতে পুরাতন চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের উপর চাপ কমবে। এটাকে বিবেচনায় না নিয়ে যানজট এড়ানোর নামে সাঙ্গু– মাতামুহুরীতে কাছাকাছি আবার নতুন সেতু নির্মাণের এই বিলাসী উদ্যোগ কাদের স্বার্থে? সাঙ্গু ও মাতামুহুরীতে অপরিকল্পিত সেতু চাপিয়ে দিয়ে মেরে ফেলবেন না। এমনিতেই বর্তমানে সাঙ্গু নদের উপর ১০ টি সেতু হয়েছে। এগুলি হচ্ছে বাঁশখালী–তৈলারদ্বীপ সেতু, বৈলতলী সেতু, দোহাজারী নতুন নির্মিত ২টি সেতু, রেল সেতু, পুরানগড়– চৌকিদারফাঁড়ি সেতু ( নির্মাণাধীন), বান্দরবান বালাঘাটা সেতু, রুমা সেতু ও থানচি সেতু। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী রেমাক্রি ইউনিয়নের বড় মোদকে সাঙ্গুর উপর ঝুলন্ত সেতুটি হিসেবে ধরলে সাঙ্গুর উপর মোট সেতুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ টি। এমনিতেই এত সেতুর কারণে খরস্রোতা সাঙ্গু (শঙ্খ) নদের বেহাল অবস্থা। একসময় বান্দরবানের সাথে যোগাযোগের একমাত্র পথ ছিল এই নৌপথটি। পণ্যবাহী বড় বড় গদু নৌকা চলাচল করত। নদটির সেই অবস্থা নেই। যেখানে সেতু হয়েছে সেখানেই নদের উজানে ও ভাটিতে বড় বড় চর জেগে উঠেছে। বর্ষাকাল ছাড়া নদে এখন নৌযান চলাচল দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এর উপর আরও সেতুর বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সাঙ্গুকে মৃত বানিয়ে ফেলবেন না।
আবার কেরানীহাট হচ্ছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র যেটি পর্যটন জেলা বান্দরবানের প্রবেশদ্বার। সেখানে ফ্লাইওভার করার যুক্তিটা কোথায়? এতে একদিকে বান্দরবানে সহজ যোগাযোগে সমস্যা সৃষ্টি করবে অন্যদিকে বাণিজ্যকেন্দ্র কেরানীহাটের ব্যবসা– বাণিজ্য সব লাটে উঠবে। এ মুহূর্তে চট্টগ্রাম –কক্সবাজার সড়ককে চারলেনে উন্নীত করে মহাসড়কে পরিনত করাটাই যেখানে জরুরি সেখানে বাইপাস– ফ্লাইওভারের এই তুঘলকি পরিকল্পনা কেন? এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়ের এই আয়োজন বন্ধে হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।
৪
বাংলাদেশে ব্যবসা–বাণিজ্যের সিংহভাগই নিয়ন্ত্রিত হয় ঢাকা–চট্টগ্রাম থেকে। আমদানি–রফতানি বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। যে কারণে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কটি হচ্ছে দেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম একটি সড়ক। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে চট্টগ্রাম বন্দর এবং দেশের সার্বিক ব্যবসা– বাণিজ্যে গতি সঞ্চার করে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এই মহাসড়কটিই এঙপ্রেসওয়ে করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা বিবেচনায় নেওয়াই হয়নি। নেওয়া হয় চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প। সেই প্রকল্প শেষ হতে দফায় দফায় ব্যয় এবং মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে যখন প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয় তখনই বের হয়ে আসতে থাকে পরিকল্পনায় অসংখ্য গলদ এবং দুর্বল দিকগুলি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প নিয়ে তাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে – ‘ঢাকা–চট্টগ্রাম মহসড়ক চারলেনের যে ডিপিপি তৈরি করা হয়েছিল তাতে ছিল দুর্বলতা। যে কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নকালেই দেখা দেয় নানা বিপত্তি। প্রকল্পটি শেষ করতে অতিরিক্ত সময় যেমন লেগেছে তেমনি ব্যয়ও বেড়েছে অনেক। সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই প্রকল্প গ্রহণ এবং সঠিক ট্রাফিক ফোরকাস্ট না করায় প্রকল্পটি শেষ হওয়ার দুই বছর যেতে না যেতেই কোথাও কোথাও রাস্তা দেবে গিয়ে উঁচু–নিচু হয়েছে। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ফলে অনেক জায়গায় রাস্তার ঢাল ভেঙে গেছে। রোড মার্কিংয়ের অবস্থাও ভালো নেই। সংশ্লিষ্টদের সঠিক দায়িত্ব পালন না করায় রাস্তা টেকসই ও যুগোপযোগী হয়নি। শুরুতে মহাসড়কটি এক্সপ্রেসওয়ে মানের তৈরির সুযোগ ছিল, যা বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শীতার কারণে হয়নি। এখন তা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে এবং অতিরিক্ত খরচও হবে।’
৫
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি বিভাগ তাদের মূল্যায়ন রিপোর্টে ঢাকা– চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ কাজে অনেক গলদ ও ক্রটি–বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার তাদের নেই। দায়ী কারা তারাও কখনো জবাবদিহিতার আওতায় আসেন না। ফলে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের তুলনায় অনেক বেশি খরচ করে বাংলাদেশ। এই বাড়তি খরচের জন্য উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়া ও দরপত্রে প্রতিযোগিতা না থাকাকে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যংককে খুশী করতে নয়, নিজেদের স্বার্থেই প্রকল্প পরিকল্পনায় আরও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রকল্প কাজ শেষ হলে মূল্যায়ন নয়, আশা করি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কাজ শুরুর আগেই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণে বাধ সাধবেন।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক