চট্টগ্রামে সাড়ে ১০ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ

ব্যাহত খাদ্য উৎপাদন, কমছে মাটির পুষ্টি

মোরশেদ তালুকদার | বুধবার , ৩১ মে, ২০২৩ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

দেশের ৯৯ হাজার ৬০০ একর জমিতে তামাক চাষ হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ১০ হাজার ৪১৬ একর জমি রয়েছে। এসব জমিতে ৬ হাজার ৫৪৩ দশমিক ১৩ মেট্রিক টন তামাক উৎপাদন হয়। উৎপাদিত তামাকের মধ্যে রয়েছে ‘জাতি’, ‘মতিহারি’ ও ‘ভারজিনিয়’ প্রজাতি। সবচেয়ে বেশি ৯ হাজার ৩৪৮ একর জমিতে জাতি এবং ৮১১ একর জমিতে ভারজিনিয় তামাক চাষ হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার ১৫ একর জমিতে জাতি এবং ৬ দশমিক ২৪ একর জমিতে ভারজিনিয় তামাক চাষ হয়। বিভাগে মতিহারি তামাক চাষ হয় ২৫৬ একর জমিতে। সর্বশেষ কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, রবি মৌসুমের প্রধান খাদ্য ফসলগুলোর মধ্যে বোরো, গম ও আলু অন্যতম। অথচ এ মৌসুমেই তামাক চাষ হয়ে থাকে। অর্থাৎ তামাক চাষের কারণে রবি মৌসুমের খাদ্য ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যান্য অঞ্চলের মতো এ তালিকায় আছে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলাও।

এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপিত হবে ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে। বিকল্প খাদ্য ফসল উৎপাদন ও বিপণনের সুযোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই ও পুষ্টিকর ফসল চাষে তামাক চাষিদের উৎসাহিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘গ্রো ফুড, নট টোব্যাকো’।

কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, দেশে যে পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ হয় সে একই পরিমাণ জমিতে বোরো ধান আবাদ করলে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন বোরো এবং গম বা আলু করলে ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৯৬৬ মেট্রিক টন গম বা ৮ লক্ষ ৫০ হাজার ৩৮৭ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন করা সম্ভব হতো। রবি মৌসুম ২০২১এ বোরো, গম ও আলুর একরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ৬৮১ কেজি, ১ হাজার ৩৩৫ কেজি এবং ৮ হাজার ৫৩৮ কেজি। এ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, তামাক চাষের কারণে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ মাত্র ৩ কোটি ৭৬ লক্ষ ৭ হাজার একর। তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম।

বিভিন্ন গণেষণার তথ্য অনুযায়ী, উৎকৃষ্ট মানের জমি ক্রমবর্ধমান হারে তামাক চাষে ব্যবহৃত হওয়ায় খাদ্য ফসলের জমি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। অথচ জমি খাদ্য ফসল ফলানোর কাজে ব্যবহার করা গেলে মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তার সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব।

সংশ্লিষ্টরা জানান, তামাক অন্যান্য শস্যের তুলনায় দ্রুত মাটির পুষ্টি নিঃশেষ করে মাটিকে অনুর্বর করে ফেলে। এছাড়া তামাক চাষে অন্যান্য ফসলের তুলনায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকও বেশি ব্যবহার করতে হয়। এসব রাসায়নিক উপাদান পরবর্তীতে পানির সাথে ধুয়ে আশেপাশের নদী, খাল, জলাশয় ও খাবার পানির উৎসগুলোকে দূষিত করে। তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেশের মৎস্য উৎপাদন। বিশেষ করে বছর দুয়েক আগেও উৎপত্তিস্থল খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি ও রামগড়ে ব্যাপকভাবে তামাক চাষের কারণে হুমকির মুখে পড়ে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। সেখানে অবশ্য এখন তামাক চাষ কমে এসেছে।

গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) তথ্য অনুযায়ী, তামাক চাষ কেবল খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি তা নয়। এটা জমি ও তামাক চাষির স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যেমন তামাক চাষিদের মধ্যে ৪ জনে ১ জন গ্রিন টোব্যাকো সিকনেস নামে নিকোটিন বিষক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত। তামাক পাতা নাড়াচাড়ার সময় ত্বকের মাধ্যমে নিকোটিন শোষিত হওয়ার কারণে এই রোগ হয়। এছাড়া ক্ষেতে কাজ করার সময় অজ্ঞাতসারেই একজন তামাক চাষি দিনে প্রায় ৫০টি সিগারেটের সমপরিমাণ নিকোটিন শোষণ করে থাকে।

প্রজ্ঞার তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার জানান, বাংলাদেশের প্রায় ৩১ শতাংশ বননিধনের পেছনে তামাক চাষ দায়ী। গবেষণা অনুযায়ী, কঙবাজার ও বান্দরবান জেলার তিনটি উপজেলায় তামাক পাতা শুকানোর (কিউরিং) কাজে এক বছরেই প্রায় ৮৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে। স্থানীয় বন থেকে এসব কাঠ সংগ্রহ করায় পাহাড়গুলো বৃক্ষহীন হয়ে পড়ছে এবং সেখানকার অধিবাসীরা আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

গ্লোব্যাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়। পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরো কয়েক লাখ।

গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি, ২০১৯এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

প্রজ্ঞার তথ্য অনুযায়ী, তামাকের পরিবেশগত ক্ষতির একটি বড় কারণ পরোক্ষ ধূমপান। বাংলাদেশের চার কোটিরও অধিক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়, যার সিংহভাগই নারী। আচ্ছাদিত কর্মস্থলে এবং গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়, এমন ব্যক্তির সংখ্যা যথাক্রমে ৮১ লক্ষ এবং ২ দশমিক ৫ কোটি।

২০১৯ সালে ‘ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস্‌ের (সিটিএফকে) সহায়তায় ইপসা পরিচালিত এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরের প্রায় শতভাগ পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ভঙ্গ হচ্ছে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন। শহরের ৯৯ শতাংশ সরকারি অফিস, শতভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৯৭ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র, ৯৯ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শতভাগ গণপরিবহনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ভঙ্গ হচ্ছে। ধূমপান হচ্ছে ৫৪ শতাংশ সরকারি অফিস, ৮১ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৩৪ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র, ৫০ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ৮৫ শতাংশ গণপরিবহনে।

আশার আলো : সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে দেশে তামাক চাষের হার ধীরে ধীরে কমছে। ২০১৮২০১৯ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বিভাগের ১৭ হাজার ২৭ একর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছিল, যা ২০১৯২০ অর্থবছরে ছিল ১০ হাজার ৪৮১ একর এবং সর্বশেষ তা কমে ১০ হাজার ৪১৬ একরে আসে।

এরপরও স্থানীয় প্রশাসন কঠোর হলে এ হার আরো কমে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা। তামাক চাষের জন্য বিভিন্ন তামাক কোম্পনির কূটকৌশলকে দায়ী করেন তারা। তারা বলছেন, তামাক চাষের ক্ষতি আড়াল করতে কোম্পানিগুলো তথাকথিত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচিকে (সিএসআর) প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

এ বিষয়ে প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধসহ একটি খসড়া সংশোধনী কেবিনেটের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। খসড়াটি যত দ্রুত চূড়ান্ত হবে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথ ততই ত্বরান্বিত হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি ১৪ জুন থেকে
পরবর্তী নিবন্ধইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের লিজ বাতিল, অভিযান