চট্টগ্রামে বৃষ্টি, ডুবল পতেঙ্গা জেলেপাড়া

মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৭ মে, ২০২৪ at ৭:২৭ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল চট্টগ্রামে সরাসরি আঘাত করেনি। গতকাল রোববার দুপুরে ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ পটুয়াখালীর খেপুপাড়া উপকূল স্পর্শ করে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে এর কেন্দ্রভাগ ১২০ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে উপকূলে আঘাত হানে।

অবশ্য ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নগরের উপকূলীয় এলাকা পতেঙ্গার আকমল আলী রোড সংলগ্ন জেলেপাড়া অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে দুর্ভোগে পড়ে সেখানকার প্রায় ৩০০ পরিবার। এছাড়া বন্দরে এলার্ট৪ জারি করে জেটি, বহির্নোঙর এবং ইয়ার্ডে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১২ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু টানেলও। দুপুর ১২টা থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সার্বিক কার্যক্রম পরবর্তী ১৭ ঘণ্টার জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

গত রাত ১১টায় এ রিপোর্ট লেখাকালীন নগরে কোথাও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। রেমালের প্রভাবে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে গতকাল। এদিন বিকাল ৩টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। তবে সন্ধ্যায় বন্ধ থাকলেও গভীর রাতে বৃষ্টি হয়। এর আগে চট্টগ্রামে রেমালের আঘাত হানার আশঙ্কায় সকাল ৮টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে (ক্রমিক ১০) চট্টগ্রাম ও কঙবাজার সমুদ্রবন্দরের জন্য ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করে। এরপর সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে নগর ও উপজেলায় বিভিন্ন সতর্কতামূলক কার্যক্রম শুরু করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও জেলা প্রশাসন। প্রস্তুত করা হয় আশ্রয়কেন্দ্র। এর মধ্যে গত রাত ৮টা পর্যন্ত ৬ উপকূলীয় উপজেলা সন্দ্বীপ, মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও বাঁশখালী উপজেলার ৪৫৩ আশ্রয়কেন্দ্রে ১১ হাজার ৮০৬ মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেয় জেলা প্রশাসন।

এছাড়া চসিক দিনভর রেড ক্রিসেন্টের সহায়তায় উপকূলীয় এলাকার লোকজনকে নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করে। পাহাড়ের পাদদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকা বাসিন্দাদেরও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে সরে যেতে মাইকিং করা হয়। চসিক তাদের ৮১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখে।

সব স্কুল আজ বন্ধ : রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট সম্ভাব্য দুর্যোগ বিবেচনায় আজ সোমবার চট্টগ্রাম জেলার সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে গতকাল অফিস আদেশ জারি করে জেলা প্রথমিক শিক্ষা অফিস। এছাড়া আজ নগরে চসিক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকবে বলে জানান মেয়র।

এদিকে জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তম খীসা স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে চট্টগ্রাম জেলার মাধ্যমিক অথবা সমপর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ২৭ মে তারিখের শ্রেণি কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের অবকাঠামো ব্যবহার করার জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধানগণকে প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়।

পতেঙ্গা জেলেপাড়ায় জোয়ারের পানি : রেমালের প্রভাবে উত্তাল ছিল সমুদ্র। বেড়েছে জোয়ারের উচ্চতা। এতে ডুবে যায় পতেঙ্গা বেড়িবাঁধ সংলগ্ন আকমল আলী রোডের জেলেপাড়া। এটি বেড়িবাঁধের বাইরে। তাই সেখানে দ্রুত পানি ঢুকে যায়। এ জেলেপাড়ার প্রায় সব ঘর ও দোকাপাটে পানি ঢোকে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা সংকেত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জাল, নৌকাসহ নিজেদের প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে নিরাপদে আশ্রয় নেয় তারা। তাই বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়।

জেলেপাড়ার সর্দার হরিদাস সাংবাদিকদের বলেন, দুপুরে জোয়ারের পানি ঢুকে সব তলিয়ে যায়। জাল এবং জিনিসপত্র আগেই সরিয়ে নেওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে ঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানকার ঘরগুলো কাঁচা। বাঁশের বেড়া ও টিন দিয়ে তৈরি এসব ঘর পানি ও বাতাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে জোয়ারের পানি নেমে যায়। কিন্তু রাতে আবার জোয়ারের সময় পানি ঢোকার আশঙ্কা করছেন বাসিন্দারা।

জেলেপাড়ার বাসিন্দা সুবল দাস বলেন, জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়েছি। কিন্তু ঘরে পানি ঢোকায় পুরো এলাকা কাদায় একাকার হয়ে গেছে।

এদিকে গতকাল বিকালে জেলেপাড়াসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেছেন সিটি মেয়র। এ সময় প্যানেল মেয়র গিয়াস উদ্দিন, কাউন্সিলর ছালেহ আহম্মদ চৌধুরী ও আবদুস সালাম মাসুম উপস্থিত ছিলেন।

চসিকের নানা প্রস্তুতি : দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে গতকাল জরুরি সভা করে চসিক। এতে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সোমবার (আজ) চসিকের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানলে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কর্পোরেশনের ৮১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোকে আশ্রয়কেন্দ্রে হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

তিনি বলেন, শনিবার সকালেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থানরত জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য মাইকিং করার নির্দেশ দিয়েছি। দামপাড়াস্থ চসিকের বিদ্যুৎ উপবিভাগ কার্যালয়ে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগের নম্বর ২৩৩৩৩৮৯১২১ অথবা ২৩৩৩৩৮৯১২২। এছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নিজ নিজ ওয়ার্ডের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থানরত জনসাধারণকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার বিষয়টি আন্তরিকতার সাথে তদারক করতে নির্দেশ দিয়েছি।

মেয়র বলেন, চসিকের সবগুলো বিভাগ দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সক্রিয় আছে। এছাড়া রেড ক্রিসেন্টও সহযোগিতা করছে। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সাথেও যোগাযোগ করব, যাতে ঝড়ে গাছ পড়লে বা দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে কোনো সংস্থার গাফিলতির জন্য মানুষ কষ্ট না পায়।

সভায় প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা লতিফুল হক কাজমী বলেন, ৪১টি ওয়ার্ডে বৃষ্টির পানি যাতে নালায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না করতে পারে সেজন্য ছোট ছোট টিম গঠন করে পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চলছে।

চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমাম হোসেন রানা বলেন, কন্ট্রোল রুমের সাথে সমন্বয় করে ৩ শিফটে ৩টি মেডিকেল টিম ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় থাকবে। এছাড়া ৬টি উপকূলীয় ও পাহাড় সমৃদ্ধ এলাকার জন্য গঠন করা হয়েছে স্পেশাল টিম।

বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল বারী জানান, দুর্যোগে নগরীর বিদ্যুতায়ন ও আলোকায়ন অব্যাহত রাখতে চসিকের গঠিত রেসকিউ টিম সক্রিয় আছে।

সিটি রেড ক্রিসেন্টের সেক্রেটারি আবদুল জব্বার জানান, শনিবার সকাল থেকেই চসিকের সাথে যৌথভাবে কাজ করছে রেড ক্রিসেন্টের ভলান্টিয়াররা। এছাড়া সরকারের গাইডলাইন বাস্তবায়নে কাউন্সিলর ও স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

চট্টগ্রামে ভূমিধসের ঝুঁকি : আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে (ক্রমিক১৩) বলা হয়, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারী বর্ষণের প্রভাবে চট্টগ্রাম, কঙবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার জন্য দেওয়া পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসেও ভূমিধসের আশঙ্কার কথা বলা হয়।

এছাড়া আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কঙবাজার, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচন্দনাইশ উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী জসিমকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধআঘাত হেনেছে রেমাল