চট্টগ্রামে প্রতি দুই দিনে একজনের মৃত্যু

সড়ক দুর্ঘটনা

ঋত্বিক নয়ন | বৃহস্পতিবার , ১৮ মে, ২০২৩ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। তারই সাথে বাড়ছে সাধারণ মানুষের কান্না। প্রিয়তমা স্ত্রীর সামনে মুহূর্তেই স্বামী হয়ে যাচ্ছে লাশ, পিতার সামনে সন্তান হচ্ছে শুধুই মাংসপিণ্ড। প্রতিকারে নেই কোনো ব্যবস্থা। চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি দুই দিনে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। চলতি বছর কেবল গত আড়াই মাসে (মার্চ থেকে ১৬ মে পর্যন্ত) চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪২ জনের প্রাণ গেছে। আহতের সংখ্যা ৩৭ জন। বাস্তবে এ সংখ্যা হয়তো আরো বেশি।

হতাহতদের মধ্যে নগরে ১২ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে জেলায় ৩০ জন মারা গেছে। আহতের সংখ্যা ৩০ জন। এই যে এত এত মৃত্যু এর দায় নিতে চায় না কেউই। পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতৃবৃন্দ দায় চাপায় পুলিশের উপর, পুলিশ বিআরটিএর উপর, আবার বিআরটিএ পুলিশ কিংবা জনগণের উপর।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত কমাতে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং অবকাঠামোর সার্বিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। গত ১৬ মার্চ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের সহায়তায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং জন্স হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিটের যৌথ কর্মশালায় এ মন্তব্য করেন মেয়র। তিনি বলেন, কেবল আইন বা শাস্তি দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু সম্পূর্ণরূপে ঠেকানো সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের গবেষণাভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে বিদ্যমান অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন প্রয়োজন।

সিএমপির উপ পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিকপশ্চিম) তারেক আহমেদ আজাদীকে বলেন, আসলে অনেক কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এর জন্য চালকদের অসচেতনতা যেমন দায়ী, তেমনি রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে পথচারীদের নিয়ম না মানাও দায়ী। এ ছাড়া রাস্তা নির্মাণজনিত ত্রুটি, গাড়ির ফিটনেস না থাকা, রাস্তা ঘেঁষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি, অনেক জায়গায় জেব্রা ক্রসিং না থাকা ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, আমরা নিজ উদ্যোগে চালকদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছি, যা যথেষ্ট নয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া প্রতি বছর তাদের জন্য ঝালাই প্রশিক্ষণের (রিফ্রেশন কোর্স) ব্যবস্থা করতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরীসহ দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে দুর্ঘটনা ঘটছে ট্রাক, বাস ও মিনিবাসের কারণে। আর আন্তঃজেলা সড়ক ও মহাসড়কে বাস ও ট্রাক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। তাছাড়া আন্তঃজেলা সড়ক ও মহাসড়কে দ্রুত গতির পাশাপাশি কম গতির যানবাহন চলাচল করাও দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ। অরক্ষিত, অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং এবং গেটম্যান না থাকার কারণেও প্রায়শই রেল লাইন পার হওয়ার সময় ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ ঘটে। এছাড়া উল্টো পথে মোড় নিতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে এবং চরম যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ থেকে জানা যায়, একদিনে নগরীতে উল্টো পথে গাড়ি চালানো, রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিজনিত কারণেই ৭০ শতাংশ মামলা হয়ে থাকে। জরিমানা আদায় করা হয় বিভিন্ন গাড়ি থেকে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের (আঞ্চলিক কমিটি) সভাপতি মো. মুছা বলেন, সড়ক নিয়ন্ত্রণ করছে যারা তাদের প্রথমে সচেতন হতে হবে। প্রচলিত আইনকানুন সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে নাকি আইন প্রয়োগের নামে নির্যাতন চলছে পরিবহন শ্রমিকের উপর? তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা হলেই চালকের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আগে যে ড্রাইভার পরিবর্তন করার রীতি ছিল এখন তা নেই। নগরীতে বাস মিনিবাসের ১৭টা রুট আছে। বলা হচ্ছে ‘এখানে বাস থামিবে’। যাত্রী ভাবছে ঐ স্থানে গিয়ে সিট নাও পেতে পারেন। চালক ভাবছে, যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে আরো আগে। নির্ধারিত স্থানে যাত্রীতো নেই। কাজেই আগেই বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি আমাদেরও কাম্য নয়। ড্রাইভারের উপর দোষ চাপিয়ে, তাকে শাস্তি দিয়ে যদি সমাধান আসে, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তাতো হবার নয়। সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে, সকল পক্ষকেই সংশোধন হতে হবে।

চট্টগ্রামে গত ১৬ মে নগরের বন্দর থানা এলাকায় বাসচাপায় কামাল উদ্দিন (৩৫) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। ১৪ মে মীরসরাইয়ে হাদি ফকিরহাট এলাকায় অসুস্থ বড় ভাইকে দেখতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন মেজ ভাই মো. ফখরুল আলম বাহার (৬৫)। ১২ মে ফটিকছড়িতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মতিন নামের এক মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হন মোটরসাইকেল চালক। ১০ মে নগরীর পতেঙ্গায় লরি থেকে রিকশার ওপর কন্টেইনার ছিটকে পড়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। ৮ মে ফটিকছড়িতে বাসচাপায় ২ জন নিহত হয়েছেন।

২১ এপ্রিল পটিয়ায় দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়েছেন। ২০ এপ্রিল ভুজপুরের গহিরাহেঁয়াকো হাটহাজারীনাজিরহাট মহসড়কের মেডিক্যাল গেট এলাকায় নাজিম উদ্দীন (৪০) বাড়ি থেকে নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় দ্রুত গতিতে আসা একটি সিএনজি টেঙি তাকে ধাক্কা দিলে তিনি গুরুতর আহত হন এবং ৮ মে হাসপাতালে মারা যান। একই দিন ফটিকছড়িতে বাস চাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী মারা গেছেন। একই দিন চন্দনাইশ উপজেলার দক্ষিণ হাসিমপুরে তেলের ভাউচারের ধাক্কায় এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। ১৩ এপ্রিল বোয়ালখালীতে শাকপুরা ইউনিয়নের রায়খালী এলাকায় বাস ও সিএনজি টেঙির মুখোমুখি সংঘর্ষে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। ১১ এপ্রিল নগরীর কোতোয়ালী থানার কদমতলী ফ্লাইওভারের কদমতলী মোড়ের অংশে টুকটুক গাড়ি উল্টে এক যাত্রী নিহত ও ৬ জন আহত হয়েছেন। ৬ এপ্রিল নগরীর বন্দর এলাকার গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) রুটে তেলবাহী ওয়াগন ট্রেনের সঙ্গে কাভার্ডভ্যানের সংঘষে এক জন মারা গেছে। ৫ এপ্রিল ট্রাকের চাকা মেরামত করতে গিয়ে সীতাকুন্ডে চাপা পড়ে মো. আবুল হোসেন (৪৫) নামের এক গাড়ি মেকানিকের মৃত্যু হয়েছে।

২৩ মার্চ সীতাকুন্ডে পিকআপের ধাক্কায় ইউসুফ ও মহিউদ্দিন নামে দুই বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে। ২২ মার্চ, সীতাকুন্ড থানার বাঁশবাড়িয়া এলাকায় রাস্তা পারাপারের সময় মাইক্রোবাসের ধাক্কায় মিল্টন নাথ (৩৫) নামে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। গত ১৮ মার্চ রাত ১টার দিকে চট্টগ্রামকঙবাজার মহাসড়কে চুনতি ইউনিয়নের বনপুকুর এলাকায় বাসলরি ও রাত দেড়টায় আধুনগর ব্রিজ এলাকায় বাসট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৯ জন আহত হন। এইদিন ভোর ৫টার দিকে লোহাগাড়া ও চকরিয়া উপজেলা সীমান্তবর্তী আজিজনগর এলাকায় কঙবাজারগামী সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে যায়। এতে চালক এরশাদ মন্ডল (৩০) ও হেলপার শিব্বির আহমদ মারুফ (১৯) ঘটনাস্থলে নিহত হন। ১৮ মার্চ নগরের পাহাড়তলী থানাধীন এ কে খান মোড় এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত ও চালক আহত হয়েছেন। একই দিন বোয়ালখালীতে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় আহত হন এক রিকশাচালক। গত ৫ মার্চ একই স্থানে বিজিবির বাসের সঙ্গে যাত্রীবাহী লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হন। ১৪ মার্চ নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের মোড়ে বাস চাপায় সাকিয়াতুল কাউছার (৪৮) নামে এক শিক্ষিকা নিহত হন। ১৩ মার্চ নগরের টোল রোডে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় মোজাহিদুল ইসলাম (৩২) নামে এক ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট নিহত হয়েছেন। ৬ মার্চ ইপিজেড থানার এয়ারপোর্ট রোডে বাস উল্টে তিনজন নিহত হয়েছেন। একই দিন বোয়ালখালীতে নিয়ন্ত্রণহারা মিঙচার গাড়ির ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে গেছে সিএনজিচালিত টেঙি। এতে চালকসহ তিন যাত্রী আহত হন। ৪ মার্চ লোহাগাড়ায় বাসলেগুনা সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হয়েছেন। ১ মার্চ নগরের বাকলিয়ায় বাসের ধাক্কায় মনির আহম্মদ (৬০) নামে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকুতুবদিয়ায় ফিশিং বোট ডুবে জেলে নিহত
পরবর্তী নিবন্ধগৃহকর্মী শিশু খুনের অভিযোগে স্বামী-স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা