ব্যাংকিং লেনদেনে জালিয়াতি ঠেকাতে কয়েক বছর থেকে উঁচুস্তরের নিরাপত্তা সম্বলিত এমআইসিআর (ম্যাগনেটিক ইংক ক্যারেকটার রিকগনিশন) চেক চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১ জুলাই থেকে সরকারি ব্যয়ের বিল পরিশোধের জন্য ট্রেজারি বিলের ক্ষেত্রেও এমআইসিআর চেক চালু করেছে সরকার। তবে দেশের কোথাও এখনো এ ধরনের চেক ইস্যু হয়নি। জুন মাসে বিভিন্ন খরচের জন্য হিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পরিশোধিত নন এমআইসিআর চেক নগদায়ন আটকে দেওয়ায় চট্টগ্রামে বিপাকে পড়েছেন শত শত ঠিকাদার ও সাপ্লাইয়ার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার নন এমআইসিআর চেক নগদায়ন করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব চেকের মেয়াদ আগামী ২৬ জুলাই পর্যন্ত রয়েছে।
সোনালী ব্যাংক লিমিটেড আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখার ডিজিএম মনির হোসেন আজাদীকে বলেন, ১ জুলাই থেকে সব সরকারি বিলে এমআইসিআর চেক ইস্যু করবে। কিন্তু গত জুন মাসে বিভিন্ন পেমেন্টের জন্য জুলাই মাসের মেয়াদ দিয়ে নন এমআইসিআর চেক ইস্যু করেছে। কিন্তু অর্থবিভাগের একটি সিদ্ধান্ত ছিল, আগে ইস্যু করা নন এমআইসিআর চেকগুলো ২৬ জুলাই পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। চেকে মেয়াদ লেখা আছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক চেকগুলো পাস করছে না। তারা বলছে, ১ জুলাই থেকে এমআইসিআর চেক কার্যকর। চট্টগ্রামে সব সরকারি ডিপার্টমেন্টের শত শত কোটি টাকার চেক আটকে দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে এসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়া সরবরাহকারীদের কাছ থেকেও বিভিন্ন সময়ে সেবা ও পণ্য সংগ্রহ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব ব্যয়ের বিল সাধারণ হাতে লেখা নন এমআইসিআর চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হতো। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে সরকারি ব্যয়ের বিল এমআইসিআর চেকের মাধ্যমে পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নেয়। কিন্তু বিপত্তি তৈরি হয় জুন মাসের নন এমআইসিআর চেক নগদায়ন নিয়ে।
এদিকে অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে স্বাভাবিক সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। সোমবার থেকে ব্যাংকিং সেবা চালু হওয়ার পর জুন মাসের শেষের দিকে পাওয়া চেক ব্যাংককে নগদায়নের জন্য জমা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা ফেরত দেয়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডস ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী শাহজাহান চৌধুরী আজাদীকে বলেন, আমাকে আগামী ২৬ জুলাই পর্যন্ত মেয়াদের ট্রেজারি চেক দেওয়া হয়েছে। সোমবার ব্যাংকে জমা দেওয়ার পর মঙ্গলবার এসব সরকারি চেক ফেরত এসেছে। এখন আমার চলমান প্রকল্পগুলোর ব্যয় নির্বাহে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। চট্টগ্রামে কমপক্ষে ৫শ কোটি টাকার সরকারি চেক পাস করাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
রয়েল এসোসিয়েটসের স্বত্বাধিকারী দিদারুল আলম আজাদীকে বলেন, আমার কাছে গণপূর্তের তিনটি চেক রয়েছে। তিনটি চেক প্রায় ১০ কোটি টাকা উপরে। গত চার-পাঁচ দিনে কোনো চেক পাস হয়নি। আমরা বিষয়টি গণপূর্ত বিভাগকে জানিয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যেকটি প্রকল্পে ব্যাংক লোন রয়েছে। এখন চেকগুলো জমা দিতে পারলে তারা ৩০ শতাংশ কেটে রাখত। এতে ব্যাংক থেকে ওয়েভার (সুদ মওকুফ) পেতাম। এখন এসব লোনের বিপরীতে বেশি সুদ বহন করতে হবে।
গণপূর্ত চট্টগ্রাম ডিভিশন-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন আহমদ আজাদীকে বলেন, আমরা জুন মাসে যেসব চেক ইস্যু করেছি সবই নন এমআইসিআর চেক। জুলাই মাস থেকে সরকারি সিদ্ধান্তে নন এমআইসিআর চেক বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। এখন যেগুলো জুন মাসে ইস্যু করা হয়েছে সেগুলোর মেয়াদ ২৬ জুলাই পর্যন্ত রয়েছে। এই চেকগুলো বিভিন্ন জেলায় নগদায়ন হচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রামে এসব চেক নগদায়ন হচ্ছে না। রাঙামাটিতেও নন এমআইসিআর চেক নগদায়ন হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে কথা বললেও তারা মাথা ঘামাচ্ছে না। সমস্যাটি সমাধানে মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের অফিসার (অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস) অপরাজিতা দত্ত আজাদীকে বলেন, আমাদের এখন থেকে এমআইসিআর চেক ইস্যু হবে। এখনো সফটওয়্যারটি ডেভেলপ হয়নি। সফটওয়্যার ডেভেলপ হলে এমআইসিআর চেক ইস্যুর কাজ শুরু করব। তিনি বলেন, জুন মাসে অনেক চেক দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মেয়াদ ২৬ জুলাই পর্যন্ত রয়েছে। এগুলোর কোনো সমস্যা নেই। এসব চেক ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে নগদায়ন করতে হবে। এ সময়ের বাংলাদেশ ব্যাংক এসব চেক নগদায়ন করতে বাধ্য।
তিনি বলেন, হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয় থেকে যেসব চেক ইস্যু করা হয়েছে সেগুলো পাল্টানোর কোনো সুযোগ নেই। ২৬ জুলাইয়ের পর নন-পেমেন্টের জন্য এলে তখন অর্থ বিভাগের অনুমোদন লাগবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপত্র নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, নন এমআইসিআর চেকগুলো জেলা পর্যায়ে ক্লিয়ারেন্স হতো। এখন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ১ জুলাই থেকে সব চেক এমআইসিআর করতে হবে। এসব চেক ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নগদায়ন করা হবে। তিনি বলেন, কারো নন এমআইসিআর চেক নগদায়ন না হয়ে থাকলে এ নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সিদ্ধান্ত আসবে। এ জন্য হয়ত সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে এসব চেক পরিশোধ করা হবে। না হয় বিকল্প চেক ইস্যু করবে সরকার।