চট্টগ্রামে জলাশয় কমছে আশঙ্কাজনকহারে

প্রয়োজন সারফেজে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা

রেজাউল করিম স্বপন | বৃহস্পতিবার , ২৯ জুলাই, ২০২১ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

প্রতিবছর বর্ষায় চট্টগ্রামের সর্বত্র একটা বিষয় খুব আলোচিত হয়। তা হলো জলাবদ্ধতা, যা দিন দিন বাড়ছে।এটি নিরসনে সরকার সিডিএ’র মাধ্যমে ‘জলাবদ্ধতা নিরসন ও সুয়ারেজ ব্যবস্থা চালু’ করার জন্য একটি মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেটি চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সংস্কার, সমপ্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প। যা ২০১৭ সালে একনেকে পাস হয় ও বর্তমানে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেজন্য চট্টগ্রামের সর্বত্র ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও খাল পুনঃখননের কাজ চলছে। অন্যদিকে এটি দ্রুত শেষ করা ও চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতার হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা ও সিডিএ অনেকগুলো বৈঠক করেছে। চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আজাদী এর উপর বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এবং সিটি মেয়র, সিডিএ’র বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদের সাথে অনলাইন সেমিনারও করেছে।
চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার প্রধান দু’টি কারণ হলো বৃষ্টির পানি আর কর্ণফুলী নদীর জোয়ারের পানি। জোয়ারের পানি প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় আসে, যদি ঐ সময় জোয়ারের পানি আটকে দেওয়া যায় তবে খাতুনগঞ্জ, সিডিএ আবাসিক এলাকাসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে না। এ কাজটি করা যায় কর্ণফুলী, হালদা নদী ও সাগরের সাথে সংযুক্ত খালগুলোতে স্লুসগেইট নির্মাণ করে। যেটি এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে। অপর দিকে বৃষ্টির পানির মাধ্যমে যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় সেই পানির জন্য দরকার পর্যাপ্ত লেক ও নিষ্কাশনের জন্য প্রশস্ত খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা। অবশ্য এরপরেও চট্টগ্রামে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ঠিক রাখা খুব কঠিন। কারণ পাহাড়বেষ্টিত চট্টগ্রামে বৃষ্টির পানির সাথে পাহাড়ের প্রচুর পলি এসে ড্রেনেজ সিস্টেমকে অকেজো করে দেয়। অন্যদিকে অতিবৃষ্টিতে যে পরিমাণ পানি সারফেজে পড়ে তা বর্তমানের ড্রেনেজ সিস্টেমের মাধ্যমে নিষ্কাশন করা খুব দুরূহ কাজ। এজন্য প্রয়োজন সারফেজে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ ঢাকায়ও সারফেজের পানি ধরে রাখার জন্য লেকের ব্যবস্থা আছে যাতে অতিবৃষ্টির পানি প্রথমে ঐ লেকে জমে, যা পরবর্তীতে পাম্পের মাধ্যমে নিষ্কাশন করা হয়। সেজন্যই ঢাকায় রমনা, ধানমন্ডি, বনানী, হাতিরঝিল, শুলশান, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় লেকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম শহর পরিকল্পনার সময় ঐ ধরনের কোন লেকের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। একসময় চট্টগ্রামে মূল ও শাখা প্রশাখা মিলে মোট ১১৮টি খাল ছিলো। এগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ছিলো ১৮২.২৫ কিঃমিটার। কিন্তু ২০১৬ সালে এসে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৪০টি খালের অস্তিত্ব পেয়েছে। যার মধ্যে কর্ণফুলী নদীতে পড়েছে ২৩টি, হালদায় ৩টি ও বঙ্গোপোসাগরে ২৪টি খাল। সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ ও ওয়াসার নথিতে নগরীতে ৩৬টি খাল থাকার কথা উল্লেখ করেছে। সিডিএর কাগজপত্রে ৩৬টি খাল থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও ২০১৯ সালের জরিপে খালের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২টি। আরো বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই ২২টি খালের একটি বড় অংশ সরকারি বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে দখল হয়ে আছে। কোন কোন জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আবার অনেকক্ষেত্রে খালের জায়গা দখল করে রাস্তা করা হয়েছে। এছাড়া অবাধে ময়লা আবর্জনা ফেলে খালগুলোর একাংশ ভরাট করা হয়েছে। ফলে প্রতিটি খালগুলো মরতে বসেছে। এতে খালের পানি প্রবাহ দিন দিন কমছে, ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। সমপ্রতি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রামে প্রতি বছর জলাশয়ের পরিমাণ ১০% হারে কমছে। এই গবেষণার উপর ভিত্তি করে এবছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ জার্নাল অব এনভারনমেন্টাল রিসার্চে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় জলাশয় চিহ্নিতকরণ ও শ্রেণীবিভাগ শিরোনামে ও ভারতে পাবলিশার্স স্ট্রেঞ্জারসের জার্নাল অব দ্য ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব রিমোট সেনসিংয়ের ৪৯ নং ভলিউমে স্পেশোটেপার‌্যাল চেঞ্জ অব আরবান ওয়াটার বডিস ইন বাংলাদেশ : আ কেস স্টাডি অব চিটাগং মেট্রো পলিটন সিটি-শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে গবেষণা চালিয়ে এই প্রতিবেদন দুটি তৈরী করা হয়। জরিপের শুরুতে ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১,৩৫২টি জলাশয় চিহ্নিত করে সরেজমিনে গিয়ে ১,২৪৯ টি পাওয়া যায়। অথচ ১৯৯১সালে জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপে জলাশয় ছিল ১৯,২৫০ টি ও ২০০৬,২০০৭ এ সিডিএ’র জরিপে পাওয়া যায় ৪,৫২৩টি জলাশয়। এতে দেখা যায় চট্টগ্রামে ভয়াবহভাবে কমছে জলাশয়। অথচ আমরা জলাবদ্ধতার পরিকল্পনা ও আলোচনায় সেই বিষয়কে মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছি না।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমলে রেলওয়ে পাহাড়তলী এলাকায় বড় বড় কয়েকটি দিঘি ও ফয়েজ লেক স্থাপন করেছিলো সারফেজ ওয়াটার ধরে রাখার জন্য। যার সুফল ঐ এলাকার জনগণ এখনো পাচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই ধরনের পরিকল্পনা আমরা আর করিনি। বিশেষজ্ঞদের মতে বৃষ্টির পানির ৮০% শুষে নেয় মাটি, ১০% বাস্পায়িত হয় ও বাকি মাত্র ১০% নদী বা সাগরে যায়। ভূগর্ভের পানির একমাত্র উৎস হলো সারফেস ওয়াটার। এটি না থাকায় চট্টগ্রামে দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে যা পরিবেশের জন্য ভয়াবহ। বর্তমানে চট্টগ্রামে আমরা খালি কোন জায়গা রাখছি না। কোথাও খালি জায়গা পেলেই স্থাপনা তৈরীর জন্য উঠেপড়ে লাগছি। যেমন নিউমার্কেটের সামনে একটি পার্ক/নার্সারি ছিলো, গরীবুল্লাহ শাহ মাজারের সামনেও একটি নার্সারি ছিলো, যেখানে গড়ে উঠলো মার্কেট। জাতিসংঘ পার্ক ও আউটার স্টেডিয়ামে করেছি সুইমিংপুল ও মার্কেট। সার্কিট হাউজের সামনের মাঠে করেছি শিশুপার্ক। চিটাগং ক্লাবের পূর্বপাশে করেছি তারকা হোটেল। স্টেডিয়ামের আশপাশে করেছি দোকান ও রেস্টুরেন্ট। জাম্বুরী মাঠকে করেছি শিশুপার্ক ও বিনোদন পার্ক। এক সময়ের বিলকে করেছি আবাসিক এলাকা। ফলে কোথাও গাছপালা ও মাটি দেখা যায় না। মাটি পানি শুষে নিতে না পারায় বৃষ্টির সব পানি ড্রেনের মাধ্যমে নিষ্কাশন করতে হয়। তাই এখন একমাত্র ভরসা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সেই ১১৮টি খাল স্থায়ীভাবে পুনরুদ্ধার করে চওড়া ও খনন করা এবং প্রতিবছর পরিস্কার করে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো ও দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা। এই একটি অপশন যদি ঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা দূর হবে, না হয় চট্টগ্রামবাসীর কষ্ট লাঘব হবে না। লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঁচার স্বপ্ন
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল