চট্টগ্রামে আক্রান্তদের প্রতি ৫ জনে একজন ডায়াবেটিক রোগী

সুস্থ হওয়ার পরও ভুগছেন নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে করোনা নিয়ে চবি চমেকসহ চার প্রতিষ্ঠানের গবেষণা

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২০ at ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের প্রতি পাঁচজনের একজনই ডায়াবেটিক রোগী। আবার করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার পর ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীই দীর্ঘমেয়াদী নানা সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা অনুভব করছেন। কারো চলাফেরায় সমস্যা হচ্ছে। এমন কি নিজের যত্ন নেয়ার ক্ষমতাও হারিয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ ভালোভাবে ঘুমুতে পারছেন না এবং প্রতিনিয়ত দুঃস্বপ্ন দেখছেন। লোপ পাচ্ছে স্মৃতিশক্তি এবং দেখা দিয়েছে চুলপড়া সমস্যা। তবে সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার পর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এজন্য বাড়াতে হচ্ছে ইনসুলিনের মাত্রা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক), জেনারেল হাসপাতাল এবং বিআইটিআইডি’র যৌথ গবেষণায় এসব তথ্য ওঠে এসেছে। ‘ডায়াবেটিস এন্ড মেটাবলিক সিনড্রোম : ক্লিনিক্যাল রিসার্চ এন্ড রিভিউস’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধটি গতকাল প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা ‘এলসেভিয়ার’।
এ গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামে প্রতি এক শতাংশ করোনা রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার পর নতুনভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। ‘এইচবিএওয়ানসি’ পরীক্ষার মাধ্যমে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে গবেষকদল। অবশ্য ইতোপূর্বে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইটালি ও সিংগাপুরে অনেকেই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর নতুন করে ডায়বেটিসে আক্রান্ত হয়েছে।
গবেষকদের পরিচয় : গবেষণা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান। গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এইচ. এম. হামিদুল্লাহ মেহেদী, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. আবদুর রব মাসুম, বিআইটিআইডি এর ল্যাবপ্রধান ও অণুজীববিজ্ঞানী ডা. শাকিল আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুব হাসান এবং তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে নেতৃত্ব দেন গবেষণা শিক্ষার্থী আসমা সালাউদ্দিন ও সাখাওয়াত হোসেন মিয়াজি। গবেষণাকর্মটির সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ছিল ডিজিজ বায়োলজি এন্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ, চট্টগ্রাম।
প্রতি পাঁচজনে একজন ডায়াবেটিস রোগী : গবেষকরা জানিয়েছেন, গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসময়ে চার হাসপতাল তথা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, জেনারেল হাসপাতাল, বিআইটিআইডি ও ফিল্ড হাসপাতালে ৭৩৪ জন কোভিড রোগী চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। এর মধ্যে ১৪৬ জন ছিল ডায়াবেটিস রোগী। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন করোনা সংক্রমিতদের মধ্যে একজন ডায়াবেটিস রোগী।
এছাড়া মোট করোনা সংক্রমিতদের সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৯ এর মধ্যে। এবং এ বয়সের ডায়াবেটিস রোগীরাই সবচেয়ে বেশি শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। করোনা সংক্রমিতদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ পুরুষ এবং এসব পুরুষের ৭৬ দশমিক ৭ শতাংশই ডায়াবেটিস রোগী।
দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা : করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন ডায়াবেটিস রোগীরা। যা ডায়াবেটিস নাই এমন রোগীদের মধ্যে তুলনামূলক কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন ২৮ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরও চলফেরা করতে সমস্যা হচ্ছে। ১০ শতাংশের বেশি নিজের যত্ন নিতে পারছেন না। প্রায় ৪৪ শতাংশ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা অনুভব করছেন। ২৫ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছেন। প্রায় ৩৭ শতাংশ ভালোভাবে ঘুমাতে পারছেন না বা তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে এবং এর মধ্যে ১ দশমিক ৭ শতাংশ দুঃস্বপ্ন দেখছেন। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর ১৩ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রায় ২৯ শতাংশ একাগ্রচিত্তে মনোযোগ দেয়ার শক্তি হারিয়েছেন এবং প্রায় ২৫ শতাংশের স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার চার সপ্তাহ পর চট্টগ্রামের ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে কোভিড-১৯ এর তীব্রতা, উপসর্গ এবং কোভিড পরবর্তী অবস্থা সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়েছে।
বাড়ছে ইনসুলিনের মাত্রা : সাধারণত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের পাশাপাশি ইনসুলিন নেয় রোগীরা। রক্তে গ্লুকোজ ও শর্করা নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন নিতে হয়। যেসব ডায়াবেটিস রোগী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন সুস্থ হওয়ার পর তাদের চল্লিশ শতাংশের ইনসুলিনের মাত্রা তিনগুণ করতে হয়েছে। এছাড়া বেশিরভাগকে দ্বিগুণ ইনসুলিন নিতে হচ্ছে।
ডায়াবেটিস রোগীর উপসর্গ বেশি : করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের মধ্যে যাদের ডায়াবেটিস নাই তাদের মধ্যে কোভিড-১৯ এর উপসর্গের মাত্রা কম দেখা গেছে গবেষণায়। অথচ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে যারা করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন তাদের নব্বই ভাগেরই জ্বর, ষাট ভাগের কফ ও কাশি এবং পঁয়তাল্লিশভাগের শারীরিক ব্যথা দেখা দিয়েছে। ষাট ভাগের অধিক রোগীর ফেরিটিন ও ডি ডাইমারের পরিমাণ অধিক পাওয়া গেছে। মাত্র চার শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পর কোন উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায়নি।
অন্যান্য : গবেষণায় আরো কিছু তথ্য পাওয়া গেছে যা কোভিড বিষয়ে অধিকতর গবেষণায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। যেমন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় তুরস্ক ও অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিসিজি বা যক্ষ্মার টিকার কার্যকারিতা দাবি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এ টিকা দেয়া থাকলে তাদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কম। কিন্তু চট্টগ্রামের গবেষক দল তাদের গবেষণায় ভিন্ন তথ্য পেয়েছেন। কারণ করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের ডায়াবেটিস রোগীদের সাতাশি ভাগেরই বিসিজি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব টিকা দেয়া ছিল। কাজেই বিসিজি টিকা দেয়া থাকলে করোনা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কম ভাবার সুযোগ নাই।
এছাড়া গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, মোট করোনা সংক্রমিতদের ৭০ দশমিক ২ শতাংশ শহর এলাকার বাসিন্দা। এদের আবার ৭৪ শতাংশের ডায়াবেটিস আছে। বিপরীতে গ্রামের বাসিন্দাদের করোনা সংক্রমিতের হার মাত্র ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং এদের ২৬ শতাংশই ডায়াবেটিস রোগী।
গবেষণার গুরুত্ব : পৃথিবীতে প্রতি দশজনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অর্থাৎ ১৫ কোটি জনসংখ্যা হলে প্রতি ১৫ জনে একজন ডায়াবেটিস রোগী আছে আমাদের দেশে। পৃথিবীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ অষ্টম। এছাড়া চট্টগ্রামে প্রায় দশ লক্ষের অধিক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কাজেই ডায়াবেটিসের তীব্রতার কারণে করোনাভাইরাসের সাথে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক, প্রতিক্রিয়া, সুস্থ হতে জটিলতা ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা জরুরি বলে মনে করেছেন গবেষকদল।
তাছাড়া বিশ্বেও ডায়াবেটিসকে করোনাভাইরাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ডায়বেটিস ফেডারেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের মাঝে ২০ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১১ শতাংশ, এবং চীনে দশ শতাংশ রোগী ডায়াবেটিস রোগী আছে।
গবেষকরা যা বলছেন : গবেষকদলের নেতৃত্বপ্রদানকারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান দৈনিক আজাদীকে বলেন, বাংলাদেশে দিন দিন ডায়াবেটিস রোগী আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। আগামী বছর নাগাদ এ সংখ্যা দুই কোটির কাছাকাছি বা বেশি হতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের অন্য যে কোন সংক্রমণশীল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একইভাবে কোভিডের ক্ষেত্রেও ডায়াবেটিস রোগী ঝুঁকির মুখে। কাজেই বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে।
ডায়াবেটিস রোগীদের করোনভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে গবেষণা দলের ক্লিনিক্যাল প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার বলেন, ডায়াবেটিক রোগীর যেকোনো সংক্রমণ হলে স্ট্রেস হরমোন বেড়ে যায়, যা রক্তে গ্লুকোজ বৃদ্ধি করে। একইভাবে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীরও এই স্ট্রেস হরমোনের কারণে ডায়াবেটিস মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। তাছাড়া করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের কারণেও ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। বেশি সংক্রমণের কারণে ইনসুলিনও ঠিকমত কাজ করতে পারে না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ডায়াবেটিস রোগীদের বিশেষ সুরক্ষা ও সতর্কতা প্রয়োজন এবং করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার পরবর্তী সময়ে নিয়মিত চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে।
গবেষণা দলের সহ-তত্ত্বাবধায়ক ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এইচ. এম. হামিদুল্লাহ মেহেদী দৈনিক আজাদীকে বলেন, গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি, ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে যারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের ডায়াবেটিস কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে তাদের ইনসুলিনের ডিমান্ড দুই থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ডায়াবেটিস রোগীরা করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদী কিছু সমস্যায় ভুগছেন, যা ডায়াবেটিস নেই এমন রোগীদের মধ্যে তুলনামূলক কম। যেমন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা, দুর্বলতা, অল্পে হাঁপিয়ে ওঠা এবং শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহার
পরবর্তী নিবন্ধদিনভর বৃষ্টি, নিচু এলাকায় পানি