আধুনিকমাইক্রো ক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা খুবই সাড়া জাগিয়েছে। আধুনিক এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ মহান ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। যখন দৈনিক আজাদী পত্রিকা প্রকাশিত হয় তখন তিনি এর প্রচার এবং প্রসারের জন্য সে সময়কালের জন্য অভিনব এক পদ্ধতি গ্রহণ করেন।
প্রত্যহ তিনি আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে নামাজ পড়তেন। নামায পড়ে বের হলে ভিক্ষুকেরা ভিক্ষার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেন। তখন তিনি তাঁদেরকে ভিক্ষা না দিয়ে কয়েকটি আজাদী পত্রিকা হাতে ধরিয়ে দিতেন এবং বলতেন, “এটি তোদের মূলধন। এ পত্রিকা বিক্রি করে যা পাবে, তা সব তোমাদের এবং এ পয়সা দিয়ে পরের দিনের পত্রিকা কিনে বিক্রি করবে”। এভাবে তিনি ভিখারিদেরকে পত্রিকার হকার বানিয়েছেন, বানিয়েছেন ব্যবসায়ী।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী চট্টগ্রামের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা জগতের কিংবদন্তী আজাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার। এ অঞ্চলের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার। চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলীর লোভনীয় এবং আর্থিকভাবে নিশ্চিত ভবিষ্যতের চাকরিকে ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চিত আয়কে বুকে নিয়ে নতুন সংগ্রামের সূচনা করে চট্টগ্রামে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন সাংবাদিকতা জগতের কিংবদন্তী এ পুরুষ।
চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত সমৃদ্ধশালী গ্রাম সুলতানপুরে ১৮৯৬ সালের ২০ জুলাই ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ বেলায়েত আলী চৌধুরী। মধ্যবিত্ত পরিবারে এক বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে আবদুল খালেক সবার ছোট। খুবই অল্প বয়সে আবদুল খালেক তাঁর পিতাকে হারান। বড় বোন তামান্না চৌধুরী ও বড় ভাই আব্দুল গণি চৌধুরী, পিতার অভাব যাতে বুঝতে না পারে তার জন্য স্নেহের ভাইটিকে আগলে রাখেন। মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাঁরা সংসারের হাল ধরে রাখেন। সংসারের দুরবস্থায় এক বিশেষ পর্যায়ে চাচা আহমদ মিয়া চৌধুরী তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন ভাইয়ের সংসারকে ঝামেলামুক্ত রাখার।
বাল্যকাল হতে আবদুল খালেক এক ব্যতিক্রমী চরিত্রের মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠছিলেন। আবদুল খালেকের শিক্ষা জীবন শুরু মূলত পরিবারেই। মায়ের মুখের শ্রুত বর্ণমালা ও আরবি শিক্ষাই তাঁর জীবনের প্রথম শিক্ষা। এরপর বড় ভাই ও বড় বোনের কাছ হতে পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করেন। পারিবারিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই ৫ বছর বয়সে রাউজান প্রাইমারি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সে সময়ে লোক মুখে এ স্কুলের নাম ছিল রজনী মাস্টারের স্কুল। সে স্কুলটি পরবর্তীকালে ভিক্টোরিয়া প্রাইমারি স্কুলে নামকরণ হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুতেই তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি ২য় ও ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছিলেন। সে সময়কালে শিক্ষা ব্যবস্থায় ২য়, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল।
৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়ে আবদুল খালেক রাউজান রামগতি রামধন আব্দুল বারি চৌধুরী (আর. আর. সি) ইনস্টিটিউশনে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। হাই স্কুলে তাঁর মেধার বিকাশ আরো উজ্জ্বলতর হয়ে উঠে। মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের আবদুল খালেক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণীতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রথম হয়ে বঙ্গীয় বৃত্তি লাভ করে সর্বমহলে প্রশংসিত ও আলোচিত হন। ১৯১২ সালে তিনি আর আর সি ইনস্টিটিউশন হতে চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম হয়ে প্রথম বিভাগে এন্ট্রাস পাস করেন। ১৯১৪ সালে অংক ও পদার্থবিদ্যাকে মূল বিষয় হিসেবে নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ হতে আবারও জেলা বৃত্তি নিয়ে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন। সে সময়কালে মুসলমান সমাজে শিক্ষা দীক্ষায় এত ভাল ফলাফল ছিল না বললেই চলে। একই গ্রামের দুই জ্ঞাতি ভাই আবুল হাসেম ও আবদুল খালেক লেখাপড়া উল্লেখযোগ্য ফলাফল করে সবার নিকট প্রশংসিত হন। আবুল হাসেম কলিকাতায় ডাক্তারি পড়ছেন। চাচা আহমেদ মিয়া চৌধুরীর ইচ্ছায় ও প্রচেষ্টায় আবদুল খালেক কলিকাতায় শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হন। চাচার একান্ত সহযোগিতায় ১৯১৯ সালে আবদুল খালেক ইলেকট্রিক্যালে কৃতিত্বের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী লাভ করেন।
সুন্দর, সুপুরুষ আবদুল খালেক ইংরেজী, উর্দু ও হিন্দি এতই ভাল বলতে পারতেন যে কেউ বিশ্বাসই করতে চাইতেন না সে বাঙালি ঘরের সন্তান। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক এর কর্মজীবন শুরু হওয়ার কথা ছিল শিবপুরেই। তড়িৎ প্রকৌশলী হওয়ার কারণে সেখানেই লোভনীয় বেতনের ভাল চাকরির প্রস্তাব ছিল তাঁর জন্য। কিন্তু তিনি এসব লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব গ্রহণ না করে মা ও মাতৃভূমির প্রতি অসীম ভালবাসার টানে চট্টগ্রাম চলে আসেন।
চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমান ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের নাম ততদিনে চট্টগ্রামে সকলের মুখে মুখে। রেঙ্গুন হতেও আসে চাকরির প্রস্তাব। কিন্তু তিনি চট্টগ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলে সকলকে সাফ জানিয়ে দেন। অবশেষে ১৯২০ সালে চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ার কোম্পানিতে চাকরি নেন। শুরু হলো তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন। আমৃত্যু সচল ও কর্মী পুুরুষ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের কর্ম জীবনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন -১. চাকরি জীবন ২. ব্যবসায়িক জীবন ৩. সাংবাদিকতার জীবন।
মাত্র ৫/৬ বছরের চাকরি জীবনে তিনি সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে কর্তৃপক্ষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯২৯ সালের দিকে তিনি চাকরির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কর্তৃপক্ষের অনেক অনুরোধে প্রধান প্রকৌশলীর ন্যায় লোভনীয় পদ ও আর্থিক সুবিধার প্রস্তাবও তিনি ফিরিয়ে দেন। অবশেষে তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও পরহিতব্রত এর কাজে নিজেকে আরো বেশী করে জড়িয়ে ফেলার মানসে ১৯৩২ সালে চাকরি হতে ইস্তফা দেন। একজন ত্যাগী, সৎ, কর্মঠ ও নিষ্ঠাবান প্রকৌশলীকে কর্তৃপক্ষ কোন ভাবেই হারাতে চাননি তাই কর্তৃপক্ষ সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে চাকরিতে রাখার। কিন্তু তিনি কর্তৃপক্ষের প্রতিটি অনুরোধ বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। অবশেষে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৩৩ সালে তাঁর পদত্যাগ পত্র কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেন।
চট্টগ্রামের মানুষকে আধুনিক ও শিক্ষিত করে তোলার মানসে অলাভজনক জেনেও চাকরিতে থাকাকালীন ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর লাইব্রেরী। সাধারণ মানুষকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে তিনি এ লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার প্রতি খুবই যত্নবান ছিলেন।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। এটি ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রথম বিদ্যুৎ চালিত প্রেস বা ছাপাখানা, এ ছাপাখানা চট্টগ্রামে ছাপার জগতে বিপ্লবের সূচনা করেছিল। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এ প্রেসের মেশিনম্যানদের মেশিন চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এ প্রেস সে সময়ে চট্টগ্রামের সাহিত্য প্রেমীদের মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সে সময়কালে কোহিনূর লাইব্রেরী ও কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসকে কেন্দ্র করেই শিল্প সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং তাঁর মধ্যমণি ছিলেন আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়ার খালেক সাহেবের কোহিনূর প্রেস হতে ছাপানো হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের অবিস্মরণীয় পুস্তিকা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজে একজন প্রকৌশলী হয়ে সাহিত্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর কোহিনূর প্রেসের কারণে। সে সময়ে তিনি ৮০ টির অধিক পুস্তক রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে এ পর্যন্ত ১৭ টি বইয়ের নাম পাওয়া যায়। ১। প্রাথমিক ভূগোল বিজ্ঞান ও গ্রাম্য জীবন, ২। রচনার প্রথম ছড়া, ৩। উর্দু প্রাইমারি, ৪। বয়েস ইংলিশ গ্রামার, ৫। ফার্স্ট বুক অব ট্রান্সলেশন, ৬। চাইল্ড পিক্চার ওয়ার্ড বুক, ৭। ব্যাকরণ মঞ্জুষা, ৮। তাওয়াফ (হজ্বের বই), ৯। ঝলমল (শিশু পাঠ্য), ১০। মুসলিম বাল্য শিক্ষা, ১১। সহজ পাঠ (শিশু পাঠ্য), ১২। দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন, ১৩। দেশ প্রিয়, ১৪। যতীন্দ্রনাথ, ১৫। শেখ-ই-চাট্গাম কাজেম আলী, ১৬। চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠন, ১৭। বার আওয়ালিয়া ও নেপোলিয়ান উল্লেখযোগ্য। এ ছিল আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার কর্তৃক রচিত বই এর তালিকা। “দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন” পুস্তকটি তাঁর কর্তৃক সংগৃহিত ও সংকলিত।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কখন বিয়ে করেছিলেন তাঁর কোন সঠিক তথ্য জানা নেই। তবে ধারণা করা হয়ে ১৯৩০-১৯৩২ সালের কোন এক সময়ে তিনি একই গ্রামের আব্দুল হাকিম চৌধুরীর মেয়ে মালেকা বেগমের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।
প্রেসের সফলতার পর তাঁর একান্ত ইচ্ছে ছিল একটি পত্রিকা বের করার। দীর্ঘ সাধনার পর ১৯৫০ সালের ২২ ডিসেম্বর কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস হতেই প্রকাশ করেন ‘সাপ্তাহিক কোহিনূর’। এ পত্রিকার যাত্রা শুরু হয় বিশ্বনবী সংখ্যা দিয়ে, পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ২০। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন প্রকাশক ও সম্পাদক। পরে ১৯৬০ এর ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী প্রকাশ করেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমৃত্যু আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার দৈনিক আজাদী প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ধর্ম প্রাণ, আধুনিক সৎ কর্মঠ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন সদালাপী, বন্ধুবৎসল, পরোপকারী পরিপূর্ণ একজন মানুষ।
ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক এক মহান ব্যক্তিত্বের নাম। তিনি সবার শ্রদ্ধাভাজন এবং অনুকরণীয় মানুষ। তিনি ধার্মিক ছিলেন কিন্তু সামপ্রদায়িক ছিলেন না। তিনি মানুষ ও মানব কল্যাণের জন্য নিবেদিত ছিলেন, ফলে সংবাদপত্রের জগতে তিনি নিজেকে কিংবদন্তী রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। আমাদের কর্তব্য তাঁর সেই সব সৃজনশীলতা ও আদর্শিক কর্মকাণ্ডকে গণমানুষের কাছে উপস্থাপন করা। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের।
[তথ্যসূত্র : সাখাওয়াত হোসেন মজনু ও মর্জিনা আখতার প্রণীত ‘মহাত্মা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার’ এবং বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রবন্ধ সমূহ]