যানজটের শহরগুলোর একটা তালিকা করলে চট্টগ্রামের নাম আসবেই। কিন্তু, এমন একদিন ছিল, সারা শহর জুড়ে তখন কোনো যানবাহন ছিল না। মানুষ পায়ে হেঁটে চলাচল করছে। তারপর একদিন রুক্ষ পথের বুক মাড়িয়ে চট্টগ্রাম শহরের বুকে নেমে আসল একটি যন্ত্র দানব। একজন ইংরেজ ভদ্রলোক ভুঁ করে চালিয়ে গেল একটি গাড়ি। দিনটি ছিল ১৯০৫ সালের ২৯ অক্টোবর। ইংরেজ ভদ্রলোকটি হলেন রেলওয়ের কর্মকর্তা মি. জেমস। মি. জেমস চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম মটর কার চালান। ঘোড়ার গাড়ির মতো ইংরেজরা প্রথম মটর যানের ব্যবহার শুরু করেন চট্টগ্রামে। এ শুনে মানুষ অবাক। যারা দেখেছে তারা হতভম্ব। আশ্চর্যের অন্ত নেই। বিস্ময়ের শেষ নেই। এ পরিবর্তনটা মেনে নিতে পারল না ঘোড়ার গাড়ির চালক কোচোয়ানরা। তারা শহরে মটর যান চালানোর প্রতিবাদ করে। ১১ ডিসেম্বর ধর্মঘট আহবান করে। একটি সফল ধর্মঘটের মাধ্যমে তারা সেদিন শহর চট্টগ্রামে প্রথম মটর গাড়ি চালনার প্রতিবাদ জানায়।
এমনই ছিল এ চট্টগ্রামের অবস্থা। মানুষ পায়ে হেঁটে কিংবা নৌপথে যাতায়াত করত। তখন ‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা’ নামত এ জনপদে। রূপকথার গল্পের মতো জোনাকিরা ঝিলমিল করত এ শহরের অলি–গলিতে। সে সমস্ত দিনের কথা মনে করে, সে সমস্ত পূর্ব পুরুষের কথা মনে করে পথ হাঁটতে ভালো লাগে। আলো জ্বলা পথ। ছায়া ঘোমটা পথ। কাটা পাহাড় পথ। জামাল খাঁন, বাদশা মিয়া চৌধুরী সডক, মেডিকেল কলেজের দক্ষিণ–পশ্চিম কোণ, চট্টেশ্বরী সড়ক, চারুকলা ইনস্টিটিউট পথ, ফিনলে গেস্ট হাউসের নিকটবর্তী পাহাড়ি ঢালু পথ, সমতল ভূমির পথ, রেলওয়ের পাহাড় ঘেষা সুনসান নীরব পথ। ফেরিওয়ালার গলা ফাটিয়ে চমকে দেওয়া পথ। সব ধরনের পথ ধরে হেঁটে যেতে ভালো লাগত। আমাদের একজন অঞ্চল দাদা আছেন। তিনি অনেক লম্বা লম্বা পথ আমাদের নানান ধরনের উদ্ভট গল্প আর তর্ক জুড়ে দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে আসতেন এখান থেকে ওখানে। আমরা তখন বুঝে না বুঝে তাঁর পেছন পেছন হেঁটে ছিলাম পথের পর পথ। ক্লান্তি বোধ করলেও বিরক্ত বোধ করিনি। এমনই তো ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের কাল। কিংবা মহাকাল।
হাজার দু’হাজার বছর আগের কথা। তখন সড়ক ছিল না। নদী পথে মানুষ যাতায়াত করত। নদী পথে মানুষের যাতায়াতের বাহন ছিল নৌকা বা সাম্পান। নৌকাগুলোর সামনের দিকটা উঁচু আর বাঁকানো। পেছনটা থাকে সোজা। প্রয়োজনে এর সঙ্গে পাল থাকে আবার কখনও থাকে না। মাঝিচালিত এ নৌকা মাল পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এক সময় বড় আকারের সাম্পান দেখা যেত চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে। এখন তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সাতজন মাঝি থাকত আর থাকত তিনকোণা আকারের তিনটি পাল। সাম্পান একটি ক্যান্টনিজ শব্দ। ‘সাম’ মানে তিন। ‘পান’ মানে কাঠের টুকরো। এর আভিধানিক অর্থ ‘তিন টুকরো কাঠ’। ইতিহাস বলে, এক সময় চট্টগ্রামে তৈরি হতো সমুদ্রে চলাচল উপযোগী বড় বড় জাহাজ। প্রাচীন বাংলা নৌ শিল্পের জন্য খুব বিখ্যাত ছিল। এখানে তৈরি হয়েছে অনেক বড় জাহাজ। জাহাজ তৈরির কারখানা ছিল। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে ব্যবসায়ী–বণিকরা চট্টগ্রামে আসত নৌকা কিনতে। ছোট, বড় নৌকা তৈরি সে তো নস্যি! এখান থেকে ব্যবসায়িরা জাহাজে করে ব্যবসা করতে যেত মালাবার, জাভা, আন্দামান, মালদ্বীপ, লাক্ষাদ্বীপ, সুমাত্রা ইত্যাদি দেশে। চট্টগ্রামের নাবিকদের দুরন্ত সমুদ্র পাড়ি দেবার সুখ্যাতি ছিল।
অনুমান করি, এ জনপদের মানুষের যোগাযোগের আদিমতম বাহন ছিল নৌকা। হয়ত তখন নৌকা তৈরি হতো কলা গাছ দিয়ে। কিংবা কাঁচা বাঁশ দিয়ে। সভ্যতার ক্রম বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নৌকায় গুণগত পরিবর্তন এসেছে। এখন তো নৌকা আর দাঁড় বেয়ে চালানো হয় না। বদর বদর করে মাঝিরা গানও করে না। মধ্যযুগে জলদস্যুরা ডাকাতি করত নৌকা চালিয়ে। যুদ্ধও করত। শৈশবে শুনেছি, বর্ষাকালে নৌপথে ডাকাতরা এসে ডাকাতি করে আবার পালিয়েছে। চট্টগ্রামের শিকলবাহায় নাকি ডাকাতের আড্ডা ছিল।
নৌকার কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল। এক চৈত্র সংক্রান্তির রাতে কর্ণফুলী নদীতে নৌকা ভ্রমণ করেছিলাম। সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। এয়াকুবনগর ঘাট থেকে উঠেছিলাম। আবদুল হালিম দোভাষের একটা মাছ ধরার নৌকা ছিল। নৌকায় খাওয়া–দাওয়া করি। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করেছিলাম সে রাতে। দূরে নৌকায় কুপি বাতিগুলো বাতাসে একবার নিবে, আরেক বার জ্বলে। চাঁদের আলোর অপূর্ব রোশনায় অন্যরকম স্বর্গীয় মাদকতা তৈরি হয়। নৌকার পাটাতনে চিৎ হয়ে শুয়ে ধবল দুধের মতো পূর্ণিমার চাঁদ দেখি। নিজেকে কেমন জানি শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, শ্রীকান্ত মনে হতে লাগে। নৌকা আর নৌকার মাঝি বাংলার শিল্প–সাহিত্যে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে নিয়েছে। গানও আছে অনেক। চট্টগ্রামের এক বিশেষ ধরনের নৌকাকে বলে সাম্পান। সাম্পান নিয়ে চট্টগ্রামে অনেক গান আছে। সেসব গান চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতির বড় এক সম্পদ। এর মধ্যে এখনও মুখে মুখে ঘুরে– ‘বাঁশখালী মইশখালী/পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান/গুরগুরাই টানে/আয় তোরা কন্ কন্ যাবি/আঁর সাম্পানে। (কথা, সুর ও শিল্পী : সনজিত আচার্য)। কিন্তু এখন আর গুরগুরাইয়া চলে না কর্ণফুলীর সাম্পান। কর্ণফুলী বা শঙ্খ নদীতে সাম্পান চলার সে চেনা সুর ‘ক্যাঁ কোরত, ক্যাঁ কোরত’ এখন আর শোনা যায় না। সে সাম্পান এখন নেই। এখন নদী দাপিয়ে বেড়ায় ইঞ্জিন নৌকা। স্যালো নৌকার তেল–মোবিলে নদীর পানি দূষিত হয়।
লেখক নাসির উদ্দীন হায়দারকে আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল গফুর হালী বলেছেন, অতীতদিনের কথা। ওখানে আছে, ‘আজ থেকে ৪০/৫০ বছর আগেও আমার গ্রাম পটিয়ার রশিদাবাদ থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার একমাত্র মাধ্যম ছিল সাম্পান। সন্ধ্যায় শঙ্খ খালের ঘাটে গিয়ে সাম্পানে উঠতাম, চানখালী খাল দিয়ে মধ্যরাতে সাম্পান পৌঁছাত পটিয়ার ঈন্দ্রপুলে। সেখানে যাত্রাবিরতি। বাড়ি থেকে আনা ‘ভাতের মোচা’ খুলতাম আমরা। খাওয়ার পর আবার রওনা দিতাম। সকালে চাটগাঁ শহরের সদরঘাটে পৌঁছাত সাম্পান। তখন তো গাড়ি ছিল না। সাম্পান ছিল মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’ তখন পটিয়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসতে একদিনের বেশি সময় লাগত। আঞ্চলিক গানের আরেক প্রবীণ গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী এম এন আখতারের কথাতেও একই সুর। তিনি ছোটবেলায় চট্টগ্রামের রাউজানের গ্রামের বাড়ি মোহাম্মদপুর থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসতেন সাম্পানে চড়ে, কর্ণফুলী নদী দিয়ে। আমরাও শৈশবে খেয়া নৌকায় পারাপার হয়েছি। দাঁড় টানা নৌকায় একবার এয়াকুবনগর ঘাট থেকে গিয়েছিলাম আনোয়ারা পঞ্চানন চৌধুরীর বাড়ি। সন্ধ্যা নামলে আবার শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। পথঘাট আবছা আবছা লাগছে। দূরে কোথাও কেরোসিনের কুপি বাতি জ্বলছে। কোথায় বৈদ্যুতিক বাতি। বাণিজ্যিক কেন্দ্র চাক্তাই খালে দেখেছি গদি নৌকা। গ্রামের হাট বাজারে তখন মালামাল সরবরাহের প্রধান বাহন ছিল এসব নৌকা।
সময় বয়ে যায়। সড়ক ব্যবস্থা উন্নত হয়। নৌকার পাশাপাশি যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে চট্টগ্রামে যুক্ত হয় ঘোড়ার গাড়ি। ধন সম্পদের মালিক যাঁরা, তাঁরা ঘোড়ার গাড়িতে চড়েন। ঘোড়ার গাড়িতে তখন সাধারণত ইংরেজদের পাশাপাশি অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা চলাচল করত। চট্টগ্রামে প্রথম কে কবে ঘোড়া গাড়ির প্রচলন করেন জানা যায়নি। ইতিহাসে আছে, এ উপমহাদেশে ইংরেজরা চলাচলের সুবিধার জন্য ঘোড়ায় টানা গাড়ির প্রচলন করে। এটি টমটম নামে পরিচিত। তবে এর আরও নাম আছে। এক্কাগাড়িও বলে। যারা চালাত তাদের বলা হতো কচোয়ান। ঘোড়ার গাড়ি একটা কিংবা দুটো ঘোড়া দিয়ে চালানো হতো।
বিয়েতে, নাইওড়ি নিতে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। শহর চট্টগ্রামে কোঁ–ওঁ–ওঁ–ওঁ শব্দে গরুর গাড়িতে মালামাল টানতেও দেখেছি। একারণে গরুর গাড়ি বেশি ছিল চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ, সদরঘাট, বন্দর এলাকায়। বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হতো। অনুমান করি, গরুর গাড়ির প্রচলন প্রায় নৌকার সমকালে। শুকনো মৌসুমে নৌকার বিকল্প হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হতো। বিয়ে ইত্যাদি কাজে তখন গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হতো। বাপের বাড়ি নাইওর যেতে ধনীর দুলালীর জন্য গরুর গাড়ির ব্যবস্থা থাকত। গরু গাড়ি নিয়েও আছে লোক গান। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’–এসব গানের অন্যতম।
বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত প্রথম সড়ক নির্মাণ করেন। এটি প্রথম উন্নতমানের সড়ক। এরপরে শাহ সুজা আরাকান সড়ক নির্মাণ করেন। ১৭৭৪ সালে চট্টগ্রাম–কুমিল্লা–ঢাকা সড়ক নির্মাণ হয়। ১৮৫৪–৬৫ সালে এ সড়কটি কলকাতা ও বার্মার মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হতো। সড়কটি ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিত ১৮৮৪ সালে চট্টগ্রাম জেলা বোর্ড গঠন হলে সড়ক নির্মাণের বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব লাভ করে। সড়ক নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনেও আসে পরিবর্তন। মানুষ নৌকা, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িতে চলাচলকে সীমাবদ্ধ রাখল না। মোটর গাড়ি, রেল, বিমান ব্যবহার শুরু করে। এখন তো দোতলা বাসও দেখা যায়।
তথ্য সহায়িকা : ১. আবু রেজা: আমাদের লোক ঐতিহ্য আমাদের লোকশিল্প; ২. নাসির উদ্দিন হায়দার: ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে (ভোরের কাগজ, ঈদ সংখ্যা ২০১৯); ৩. হাজার বছরের চট্টগ্রাম, দৈনিক আজাদী, ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা, ৪. হুমায়ুন আজাদ : লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী; ৫. আলী ইমাম: আলোর পাখি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যজন।